শ্রোতাদের উদ্দেশে এন্ড্রু কিশোরের শেষ দুলাইন
‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, রইবো না আর বেশি দিন তোদের মাঝারে’— জনপ্রিয় এই গানটির একটি লাইন গত ২ জুলাই রাতে পোস্ট করেন এন্ড্রু কিশোর। এরপরে লেখেন, ‘আমি আমার প্রিয় ভক্ত-শ্রোতাদের অনুরোধ করছি আমার গান ভালবেসে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, আমার গাওয়া গানকে স্বাভাবিক ও সাবলীল রেখে এবং বিকৃত না করে যত্ন করে রাখবেন।’
বাংলা সিনেমার প্লেব্যাক সম্রাটখ্যাত শিল্পী এন্ড্রু কিশোর অনেকটা সময় ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করেছেন। সেই সময়ের কিছু কথা এবং অপ্রতাশিতভাবে পাওয়া কষ্টের কথা জানিয়েছেন তার স্ত্রী প্রকৌশলী লিপিকা এন্ড্রু। ফেসবুকে কিংবদন্তি এই শিল্পীর অফিসিয়াল পেইজে (https://www.facebook.com/andrewkishorofficial/) তিনি স্মৃতিচারণ করেন। তাদের পারিবারিক বন্ধু, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. দীপকেন্দ্রনাথ দাস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, লিপিকার অনুরোধে তিনি নিজেও ফেসবুকে পোস্টগুলো শেয়ার করেছেন।
নিজের মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই দেশে ফিরে এসেছিলেন এন্ড্রু কিশোর। কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিলেন তিনি। কেবল বাংলাদেশ নয়, ভারতের বাংলা প্লেব্যাকেও তার কীর্তি রেখে গেছেন। জীবদ্দশায় তাকে দুবার মৃত্যুর ভুল সংবাদ দেখে যেতে হয়েছে। সে জন্য কষ্টও পেয়েছেন তিনি।
স্বজনরা জানিয়েছেন, ‘জটিল ও কষ্টদায়ক ক্যানসারে ভুগছিল মানুষটি। তাকে দেখে রাখার পর নিজেদের কষ্ট সামলে মিডিয়ার সামনে বক্তব্য রাখা শুধু অসম্ভবই ছিল না, ছিল অসহনীয়।’
এন্ড্রু কিশোর নিজেও মর্মাহত হয়েছিলেন। ৫ জুলাই বিকালে তার মৃত্যুর ভুল সংবাদ প্রচারের পর তিনি ফেসবুকে লেখেন, ‘বর্তমানে আমার সম্পর্কে অনেক ভ্রান্ত খবর বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রচার করছে। ভুল সংবাদ বিশ্বাস করবেন না। আমি এখন আমার পরিবারের সাথে সময় কাটাচ্ছি। আমার জন্য দোয়া করবেন।’
এটাই ছিল সামাজিক মাধ্যমে শিল্পীর শেষ প্রকাশ।
এন্ড্রু কিশোরের অবস্থা সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ ও কৌতুহলের কথা পরিবারকে জানানো হলে সেদিনই রাতে লিপিকা এন্ড্রু এক দীর্ঘ পোস্টে সব কিছু ব্যাখ্যা করেন। সেখানেই তিনি জানান যে, আগের পোস্ট দুটিতে কিশোরের কথা তিনি লিখে দিয়েছেন। তারপর তিনি নিজের কথা লিখেছেন।
তিনি লেখেন, গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর কিশোরকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়ার পরই তার উভয় এড্রিনাল গ্রন্থিতে ক্যানসার ধরা পড়ে। তার ক্যানসারের ইংরেজি নাম ডিফিউস লার্জ বি সেল লিমফোমা। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসক লিমের অধীনে চিকিৎসা চলছিল। কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি চলতে থাকে এ বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের পক্ষ থেকে চিকিৎসা শেষ হয়েছে। এই চিকিৎসাতেই তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগস্ট মাসে আবার ফলোআপ করতে যেতে বলা হয়।
কিশোরের স্ত্রী লিপিকা লিখেছেন, এ রকম অবস্থায় ১৩ মে তারা কিশোরকে নিয়ে দেশে ফেরার প্রস্ততি নিয়েছিলেন। কিন্তু যাত্রা বাতিল করতে বাধ্য হন।
‘কিশোর শারীরিকভাবে খুব দুর্বল ছিল। ডাক্তার জানিয়েছিলেন, এই দূর্বলতা কেমোর জন্য। আস্তে আস্তে ভালো হয়ে যাবে, সময় লাগবে’— লেখেন লিপিকা। ১০ জুন তারা দেশে ফেরার প্রস্ততি নেন।
তিনি লেখেন, ‘২ জুন কিশোরের হালকা জ্বর আসে। ৩ জুন রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। ৪ জুন হাসপাতালে ভর্তি করে নেন ডাক্তার। জ্বর বার বার আসতে থাকে। কোনো medicine তার শরীরে কাজ করছিল না। হাসপাতালের ডাক্তার আমাকে ফোন করে বলেন, তাকে আবার পরীক্ষা করতে হবে। তার ক্যানসার আবার ফিরে আসছে কি না দেখতে হবে। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম, মনে মনে শুধু ঈশ্বরকে ডেকেছি। কারণ শুরুতে ডাক্তার বলেছিলেন, Lymphoma যদি একবারে নির্মূল না হয়। যদি ফিরে আসে, তাহলে সেটা দ্বিগুন শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে আর খুব দ্রুত ছড়ায় এবং সেটা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।’
আশঙ্কা ভয়ঙ্করভাবে বাস্তবে রূপ নিয়েছিল।
লিপিকা লিখেছেন, ‘৯ জুন কিশোরের পরীক্ষা হয়। সেদিন রাতে ডাক্তার আমাকে ফোন করে বলেন যে, পরদিন মানে ১০ জুন সকাল ১০টায় আমার সাথে পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে আলাদা করে কথা বলতে চান। ৯ জুন রাতটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রাত। আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি। সকালে ১০টার আগে হাসপাতালে গিয়ে বসে থাকি কিশোরের পাশে। কিশোর আমাকে বললো, ডাক্তারকে বলবা, হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিতে। আমরা দেশে ফিরবো। আমি ভয়ে চুপ করে থাকলাম। শুধু বললাম দেখি ডাক্তার লিম কী বলেন। কিছুক্ষণ পরে একজন নার্স এসে আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল, বললো ডাক্তার ডাকছেন। ডাক্তার লিম আমার সামনে এসে একটাই কথা বললো তার ক্যানসার ফিরে আসতে শুরু করেছে। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। বুঝলাম সব শেষ।’
‘ডাক্তার বললেন, এন্ড্রুকে বলব? আমি বললাম, বলতে তো হবে। ডাক্তার আমাকে কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে নিয়ে গেলেন এবং দেখালেন। তার এড্রিনাল গ্রন্থিতে কিছু নেই। তবে ক্যানসার (Lymphoma ভাইরাস) ডান দিকের লিভার এবং স্নায়ুতে ছড়িয়ে গিয়েছে এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অল্প অল্প করে বাড়তে শুরু করেছে। আমি কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। চোখের জল ঠেকাতে পারছিলাম না। অনেক কষ্টে ডাক্তার কে বললাম, এরপর কী করার আছে। ডাক্তার বললেন, আমি দুঃখিত, আমার আর কিছুই করার নাই। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ে যাচ্ছিল। নিজেকে এত অসহায় লাগছিল যে, কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। কিশোর বুঝতে পেরেছিল, আমাকে ডাকতে থাকে’— লেখেন লিপিকা।
তিনি লেখেন, ‘ডাক্তার কিশোরকে জানায়। কিশোর ডাক্তারকে বলে, তুমি আজই আমাকে রিলিজ করো। আমি আমার দেশে মরতে চাই, এখানে না। আমি কালই দেশে ফিরব। আমাকে বলে, আমি তো মেনে নিয়েছি, সব ঈশ্বরের ইচ্ছা। আমিতো কাঁদছি না তুমি কাঁদছ কেন? কিশোর খুব স্বাভাবিক ছিল। মানসিকভাবে আগে থেকে প্রস্তুত ছিল। যেদিন থেকে জ্বর এসেছিল সেদিন থেকে। কিশোর হাই কমিশনে ফোন করে বলে, কালই আমার ফেরার plane করে দিন। আমি মরে গেলে আপনাদের বেশি ঝামেলা হবে। জীবিত অবস্থায় পাঠাতে সহজ হবে। ১০ জুন বিকালে হাসপাতাল থেকে ফিরি এবং ১১ জুন রাতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে ফিরে আসি আমরা।’
লিপিকা লিখেছেন, ‘ঈশ্বরের কী খেলা, ১০ জুন আমরা সম্পূর্ণ পজিটিভ রেজাল্ট নিয়ে ফিরতে চেয়েছিলাম অথচ ১১ জুন ফিরলাম পুরো নেগেটিভ রেজাল্ট নিয়ে। আমি ডাক্তারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আর কতদিন, তিনি লিখে জানিয়েছিলেন, এটা আন্দাজ করা কঠিন। এ রকম ক্ষেত্রে বছরের হিসাব না করে মাসের হিসাব করা যেতে পারে।’
কিশোরের মৃত্যুর আগের রাতে লিপিকা লেখেন, ‘এখন কিশোর কোনো কথা বলে না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। আমি বলি কী ভাবো? বলে, কিছু না। পুরানো কথা মনে পড়ে আর ঈশ্বরকে বলি আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও। বেশি কষ্ট দিও না। ক্যানসারের শেষ পর্যায় খুব যন্ত্রণাদায়ক ও কষ্টের হয়। এন্ড্রু কিশোরের জন্য সবাই প্রাণ খুলে দোয়া করবেন, যেন কম কষ্ট পায় এবং একটু শান্তিতে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যেতে পারে। এটাই শেষ পোস্ট, এরপর আর কিছু বলা বা লেখার মতো আমার মানসিক অবস্থা থাকবে না। এখনো মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন মনে হয়, কিশোর থাকবে না অথচ আমি থাকবো, মেনে নিতে পারছি না।’
পরদিন সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় রাজশাহীর মহিষবাথান এলাকায় বোনের বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এন্ড্রু কিশোর। তার বাল্যবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার ইকবাল বাদল বলেন, ‘কিশোরের চিকিৎসা সহযোগিতায় যখন দেশের সংগীত শিল্পীরা একজোট হয়ে অর্থ জোগাড় করতে শুরু করেন, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এন্ড্রু কিশোরকে ডেকে নেন এবং সিঙ্গাপুরে তার চিকিৎসা ব্যয় বহনের দায়িত্ব নেন। তার চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য এন্ড্রু কিশোর রাজশাহীতে ভদ্রা আবাসিক এলাকার তার একটি ফ্ল্যাটও বিক্রি করেন।’
তিনি বলেন, ‘কিশোর আমার চেয়ে ১০ বছরের ছোট।’
রাজশাহী শহরে সুরবাণী সংগীত বিদ্যালয়ে বাদল গান শিখতেন। কিশোরের বড় বোন ডা. শিখা বিশ্বাস সেখানে গিটার শিখতেন। পরে কিশোর বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ওস্তাদ আব্দুল আজিজের কাছে গান শিখতে আসেন। সেখানেই কিশোরের সঙ্গে তার পরিচয়। তারপর তারা দুজনে বয়সের ব্যবধান পেরিয়ে বন্ধু হয়ে ওঠেন।
‘কিশোর ছিলেন আপাদমস্তক শিল্পী। গানই ছিল তার জীবন-প্রাণ। রাজনীতির সঙ্গে তার শিল্পী স্বত্তাকে কখনো মিলিয়ে দেননি। সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে তিনি অন্য শিল্পীদের রাজনৈতিক অবস্থানকে তোয়াক্কা করেননি। এ কারণে কিন্তু রাজনীতি তার অনেক ভালো কাজের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে’— বলেন বাদল।
তিনি বলেন, ‘এন্ড্রু কিশোর তার শিক্ষক ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু স্মৃতি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর মাধ্যমে রাজশাহী সংস্কৃতি অঙ্গনের সকল ধারার মানুষকে একত্র করতে চেয়েছিলেন। তার সে চেষ্টা সম্পূর্ণ হতে পারেনি, তবে তার অসুস্থ হওয়ার আগের তিন বছর ত্রৈমাসিক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন থাকতো রাজশাহীতে।’
ড. দীপকেন্দ্রনাথ দাস বলেন, ‘কিশোরের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হবে তার দুই ছেলে-মেয়ে দেশে ফেরার পর। তার ছেলে সপ্তক এন্ড্রু ও মেয়ে সংজ্ঞা এন্ড্রু অস্ট্রেলিয়াতে থাকেন। তারা দেশে ফিরলে এন্ড্রু কিশোরকে রাজশাহী খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের গোরস্থানে সমাহিত করা হবে। সে পর্যন্ত এন্ড্রু কিশোরের মরদেহ থাকবে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের হিমঘরে।’
Comments