মৃত্যুর একদিন আগে এন্ড্রু কিশোর বলেছিলেন, ‘আমার জন্য কফিন বানাতে দিয়ে দাও’
‘একটা ঘরের ঠিকানা পেয়েছি আমি, শুনেছি এ ঘরের চেয়ে অনেকখানি দামি। ও ঘরে থাকতে হবে একা একা জানি।’ সম্পূর্ণ নতুন একটি গান।
জনপ্রিয় সুরকার ইথুন বাবু গানটি লিখেছেন, সুরও দিয়েছেন তিনি। গানটিতে কণ্ঠ দিতে চেয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। তা আর সম্ভব হয়নি। বরং গানটাই বাস্তব হয়ে গেছে।
ইথুন বাবু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গানের কথা ও সুরের বর্ণনা এন্ড্রু কিশোরকে আগেই তিনি ইমেইলে পাঠিয়েছিলেন। এন্ড্রু কিশোর তার স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রুর ইমেইলের মাধ্যমের সবার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন।’
গত বছর সেপ্টেম্বরে অসুস্থ হওয়ার দিন কয়েক আগে গানটি রেকর্ড করার জন্য এন্ড্রু কিশোর ঢাকার মগবাজারে ইথুন বাবুর স্টুডিওতে হাজির হয়েছিলেন বলেও জানান তিনি।
বলেন, ‘দাদা স্টুডিওতে এসেই বললেন— “বাবু, তুই আমাকে এরকম একটা গান কেন দিলি রে?” আমি বললাম, “কেন দাদা কি হয়েছে?” দাদা বললেন, “না, তোর ভাবি গানটা দেখে বলছিল, দেখ, বাবু তোমাকে কঠিন একটা গান পাঠিয়েছে”।’
‘দাদা খুবই চাপা স্বভাবের ছিলেন। নিজের কোনো অসুবিধার কথা কাউকে জানতে দিতেন না। সেদিনও তিনি চা পান করলেন। গানটি রেকর্ড করার জন্য স্টুডিওতে ঢুকলেন। রেকর্ডিং শুরুর আগ মুহূর্তে হঠাৎ তিনি বললেন, “বাবু আজ থাক, আজ মনে আমি গান গাইতে পারব না”। এই বলে তিনি সরাসরি বাসায় চলে যান।’
‘আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। এরকম ঘটনা আগে কখনোই ঘটেনি। আমি যেহেতু দাদাকে ভালো করে চিনতাম, আমিও তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। চার দিন পরেই জানলাম, দাদা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পরে তো দাদা আর স্টুডিওতে ফিরতেই পারলেন না,’ দীর্ঘ নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন ইথুন বাবু।
ইথুন বাবু বয়সে এন্ড্রু কিশোরের চেয়ে দশ বছরের ছোট। কিন্তু, রাজশাহীতে তারা দুজনেই ছিলেন ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর সুরবানী সংগীত বিদ্যালয়ের ছাত্র। সে সময়ে একই ওস্তাদের সাগরেদ ছিলেন রিজিয়া পারভীন, এম এ খালেক, ইফফাত আরা নার্গিস, রফিকুল আলম ও আরও অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী।
সত্তরের দশকেই বিদ্যালয়টির স্থান পরিবর্তন হয়েছে তিনবার। প্রথমে শহরের মধ্যবর্তী অঞ্চল রানীবাজার, পরে ভূবনমোহন পার্কের পাশে এবং পরে শহরের আরেক প্রান্ত বেলদারপাড়ায়।
তখন শহরের পশ্চিমাঞ্চলে পদ্মাপাড়ের ব্যাপ্টিস্ট খ্রিষ্টান মিশনের কাছে তাদের বাড়ি থেকে এন্ড্রু কিশোর সাইকেলে করে গান শিখতে আসতেন।
‘দাদা দিনের প্রত্যেক বেলাতেই গানের রেওয়াজ করতেন। আমরা যখনই কেউ তার বাসায় যেতাম প্রায়শই তাকে রেওয়াজরত অবস্থায় দেখতাম। একটা সাইকেলে করে গান শিখতে বিদ্যালয়ে আসতেন। কখনো সাইকেল নষ্ট হয়ে গেলে হেঁটেই চলে আসতেন। কোনদিন বিদ্যালয় মিস করেননি।’
‘মনে আছে, আমি অনেকদিন দাদার সঙ্গে তার সাইকেলে চড়ে রাজশাহী মিষ্টান্ন ভান্ডারে গিয়ে সকালের নাস্তা লুচি দিয়ে সেরেছি,’ যোগ করেন ইথুন।
আরও বলেন, ‘আশির দশকে দাদা ঢাকায় পাড়ি দেওয়ার আগে আমি তবলা বাজাতাম। দাদা হারমোনিয়ম বাজিয়ে গান করতেন। আমরা অনেক স্টেজ শো করেছি। কলেজগুলোর নবীনবরণ অনুষ্ঠানে, বিশেষ করে রাজশাহী কলেজে বহুবার শো করেছি। পাড়া মহল্লার অনুষ্ঠানে, জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে গান করেছি।’
তার মতে, ‘দাদা যেখানেই গান গেয়েছেন সেখানেই শ্রোতার অভাব হতো না। শ্রোতারা তার গানের সময় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকতেন। দাদার গানের গলা সেই শৈশব থেকেই ছিল যাদুকরী, তার গলায় যে গানই পড়েছে তা সোনা হয়ে গেছে।’
‘পরে ঢাকায় সংগীত পরিচালক আলম খানের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর দাদাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’
‘দাদার সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যেত তিনি জীবনদর্শন ভালোভাবে উপলব্ধি করতেন। তিনি তার ওস্তাদকে ভালোবাসতেন। তার ওস্তাদেরও প্রিয় ছিলেন তিনি। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় ছিল প্রখর।’
‘এই দেখুন না, দাদা বেঁচে থাকতেই নিজের জন্য কফিন তৈরির কথা বলেছিলেন। একদিন আগে তার স্ত্রীকে বলেছেন, “আমার জন্য কফিন বানাতে দিয়ে দাও”। এই কফিন বানাতে গিয়েই তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তিনি এটাও বলে গেছেন যে তার মৃত্যুর পর করণীয় কী হবে। তার দেহ কোথায় নেওয়া হবে, কোথায় হবে না। তিনি তার মা-বাবার পাশেই চিরনিদ্রায় থাকতে চেয়েছিলেন। তার পরিবার সে রকমভাবেই সব প্রস্তুতি নিয়েছেন।’
গত সোমবার সন্ধ্যায় এন্ড্রু কিশোর মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন। তার দেহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজের হিমঘরে রাখা হয়েছে। পারিবারিক সূত্রগুলো জানিয়েছে যে কিশোরের দুই ছেলে-মেয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শুরু হবে।
Comments