জীবনবোধের চির আধুনিক কবি
‘আমরা তো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্তকালের
উদয় ও অস্তের ক্লান্তি আমাদের কোনোদিনই বিহ্বল করতে পারেনি।
আমাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত,
আমাদের রক্তে সবুজ হয়ে উঠেছিল মুতার প্রান্তর।
পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুল ফোটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত!’
রবীন্দ্র-উত্তর আধুনিককালের কবিদের মধ্যে যিনি শব্দচয়নে, জীবনবোধে, শব্দালংকারের নান্দনিকতায়, বর্ণনায় অসামান্য আর ধ্রুপদী, তিনি কবি আল মাহমুদ। উপরে উল্লেখিত সৃষ্টিতে বিশ্বাসীদের অনুভূতিকে সময়কালের বাংলা ভাষার প্রধান কবি তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন আলোকিত চেতনার আবেগ। তার সেই চেতনাকে মূর্ত করেছেন শব্দে, অনুভূতির অবয়বে। কবিতায় ফুটে উঠেছে তার বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি, প্রকাশ পেয়েছে দৃঢ়তা আর জীবনের গন্তব্য, তাতে নেই সংশয়, শঙ্কা।
এ ছাড়া, যিনি দীর্ঘ সময় ধরে কবিতার খাতায় এঁকেছেন বাঙালিয়ানার এক চিরায়িত ছবি। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের দলে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে— এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থটি একটি মাস্টারপিস হিসেবেই সমাদৃত হয়েছে, এমনকি কবির একচোখা সমালোচক ও নিন্দুকদের মাঝেও। এই কাব্যগ্রন্থটি অনুবাদ হয়েছে অনেকগুলো ভাষায়। কবিতার শব্দ ব্যবহারের স্বতঃবেদ্য স্বাভাবিকতা এবং বিশ্বাসের অনুকূলতা নির্মাণে তিনি নিঃসংশয়ে আধুনিক বাংলা ভাষায় একজন অন্যতম প্রধান কবি।
‘পঞ্চাশ দশকের আরও দুই উল্লেখযোগ্য কবি হচ্ছেন— শামসুর রাহমান ও শহীদ কাদরী। আল মাহমুদসহ এরা তিন জনই পৃথক। তবে ছন্দ প্রকরণে কেউ’ই তিরিশের ধারাকে অতিক্রম করতে পারেননি বা ভাঙতে পারেননি। এরা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা কাব্যভাষা নির্মাণ করেছেন। শামসুর রাহমান ও শহীদ কাদরী শহুরে ভাষাকে কাব্যে প্রধান করেছেন। আল মাহমুদ এক্ষেত্রে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছেন। তিনি লোকায়ত বাংলার চিরায়ত শব্দ সুষমাকে আধুনিক বাক্য বন্ধনে উপস্থাপন করেছেন। গ্রামের চিত্র, পল্লীর সবুজ প্রকৃতি, বহতা নদীর উচ্ছলতা, পাখির কলতান ও নারীর সৌন্দর্য তিনি চিরায়িত করে তুলছেন। এক্ষেত্রে তিনি জসীমউদ্দীন থেকে আলাদা। জসীমউদ্দীন যেখানে গ্রাম বাংলার বহু বিচিত্র রূপ ও জীবন যাত্রাকে বিপুলভাবে তুলে ধরেছেন, আল মাহমুদ সেখানে আধুনিক জীবন যাত্রার বর্ণনাস্থলে পল্লী সৌন্দর্যেও নিখাত চিত্রকে প্রতীক হিসেবে তুলনাবাচক বিষয় হিসেবে তুলে ধরেছেন।’ (আল মাহমুদের চিত্রকল্প: একটি প্রধান বিষয়/ হাসান আলীম)
আমরা দেখি আধুনিক কবিতার একটি মৌলিক বিষয় শব্দের সমাহার বা চিত্রকল্পের ব্যবহার। এক্ষেত্রে আল মাহমুদ গ্রাম বাংলার সৌন্দর্যকে আশ্চর্য শক্তিময় শব্দ বিন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। প্রখ্যাত সমালোচক অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় বলেন, ‘সমকালীন যে দুজন বাঙালি কবির দুর্দান্ত মৌলিকতা এবং বহমানতা আমাকে বারবার আকৃষ্ট করেছে, তাদের মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশের আল মাহমুদ, অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের শক্তি চট্টোপাধ্যায়।’
অধ্যাপক ড. রাজীব হুমায়ুনের মতে, তিনি (আল মাহমুদ) চল্লিশের পরবর্তী কবিদের মধ্যে অন্যতম মৌলিক কবি, নতুন কবি। সমালোচকরা ‘তার মৌলিকত্ব এবং নতুনত্ব’ দেখেছেন আল মাহমুদের ‘গাঁয়ে ফেরার পিপাসায়’ এবং ‘অনিবার্য শব্দ, উপমা, চিত্রকল্পে সে পিপাসার প্রকাশে’।
পঞ্চাশ দশকের প্রধান কবি আল মাহমুদ গ্রামে ফিরলেন এবং গ্রামের মেঠোপথ বেয়ে চলতে গিয়ে রচনা করলেন: এখন কোথায় যাওয়া যায়?/ শহীদ এখন টেলিভিশনে।/ শামসুর রাহমান সম্পাদকীয় হয়ে গেলেন।/ হাসানের বঙ্গজননীর নীলাম্বরী বোনা/ আমার দ্বারা হবে না। জাফর ভাই ঘোড়ার গায়ে হাত বোলান।/ অতএব কবির কোথাও যাওয়া হলো না, কেননা:/ আমার সমস্ত গন্তব্যে একটি তালা ঝুলছে। (আমার সমস্ত গন্তব্যে)
আল মাহমুদ লোকজ অভিমুখে যাত্রা করে লোকায়ত বাংলার চিরায়ত শব্দ সুষমাকে আধুনিক বাক্যবন্ধনে উপস্থাপন করলেন। তার নির্মিত পটভূমির কেন্দ্রবিন্দু মানবতাই আত্মবিশ্বাস। জসীম উদ্দিন এবং জীবনানন্দ, উভয়ের থেকে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির কবি। কারো প্রতিধ্বনি নয়, নির্মীয়মাণ স্বকীয়তাই তাকে আধুনিক জগতে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী করেছে। ক্রমশ হয়ে উঠেছেন আস্থাশীল এক কাপ্তান। আল মাহমুদই আমাদের বিপুল জনসমষ্টির জীবনধারার অভিজ্ঞতাকে তার কবিতায় ব্যবহার করেছেন।
স্পন্দমান আবেগের ভূগোল, দেশজ চেতনা, লোককাহিনি ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সৌন্দর্যে আপ্লুত আল মাহমুদ একজন মিথলজিক্যাল রোমান্টিক কবি। যেমন তিনি তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘সোনালী কাবিন’ এ মাতৃভূমির ইতিহাস খনন করে তুলে এনেছেন ঐশ্বর্যময় ও বীর্যবান অনুষঙ্গসমূহ। তিনি এখানে শক্তিমত্তার সঙ্গে রোমান্টিসিজম প্রবেশ করিয়েছেন। যা ‘সোনালী কাবিন’ সনেট গুচ্ছকে করেছে অনন্য।
‘সোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়ো না হরিণী/ যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি/ আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনোকালে সঞ্চয় করিনি/ আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;/ ছলনা জানিনা বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি।’
আসলে ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রিয়জনকে দিতে কোনো অর্থ-বিত্ত বা দেন মোহর কোন কিছুই গুরুত্ব বহন করে না ভালোবাসা ছাড়া। তাই কবির এইসব পংক্তিতে বিনয়ের উদার বটপাতায় ভেসে উঠেছে ভালোবাসার চিত্র। ‘সোনালী কাবিন’ সনেটগুচ্ছ কবি উপমা রূপকের চর্চার কুশলতার যে নিদর্শন রেখেছেন, আমাদের কবিতার ক্ষেত্রে তা নতুন এবং আন্তরিক সততায় উজ্জ্বল।
কবি অতীত গৌরব, সাম্য মানসিকতা, ইতিহাস থেকে ঐতিহ্যের সঙ্গে ধর্মের মিথলজিক্যালের ব্যবহার করেছেন। আল মাহমুদ মানুষের মানবিক মেধা ও মননের বিষয়গুলো খুব চমৎকারভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। কবির দৃষ্টিভঙ্গি যুগপৎ সমাজনিষ্ঠ।
আল মাহমুদ যে মৌলিক ও নতুন কবি, তা আগেই বলা হয়েছে। একজন কবির বড়ত্ব তার কাব্যভাষা, চিত্রকল্প ও ছন্দের নতুনত্বে। আল মাহমুদের বড়ত্ব তার নিজস্ব বাক্যরীতি প্রবর্তনে এবং অদ্ভুত সুন্দর চিত্রকল্প নির্মাণে। সৌন্দর্য বিভায় উদ্ভাসিত তার কবি হৃদয় সর্বদা সুন্দরের পূজারি। তিনি তার কাব্যে বহু বিচিত্র বিষয়ের চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন।
অন্যদিকে সাহিত্যক্ষেত্রে বাংলাদেশের কবিতার মেজাজ ও মন বুঝতে সহজে হলে আমাদের আল মাহমুদের সংসারে প্রবেশ করতেই হবে—
‘কবিতা কি?
কবিতা তো শৈশবের স্মৃতি
কবিতা চরের পাখী, কুড়ানো হাসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস
স্নান মুখ বউটির দড়িছেঁড়া হারানো বাছুর
কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।’
শুধু তাই নয়, কবির কবিতায় ফুটে উঠেছে তার বিশ্বাস। তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার কথাও স্মরণ করেছেন। আর সেই মৃত্যুচিন্তার অনুভূতিগুলো ফুটে উঠেছে বিদগ্ধ শব্দচয়নে—
‘স্মৃতির মেঘলাভোরে শেষ ডাক ডাকছে ডাহুক/ অদৃশ্য আত্মার তরী কোন ঘাটে ভিড়ল কোথায়?
কেন দোলে হৃদপি, আমার কি ভয়ের অসুখ?/ নাকি সেই শিহরণ পুলকিত মাস্তুল দোলায়!
আমার যাওয়ার কালে খোলা থাক জানালা দুয়ার/ যদি হয় ভোরবেলা স্বপ্নাচ্ছন্ন শুভ শুক্রবার।’
আজ কবি নেই। তবে একজন জীবিত কবির চেয়ে দেহান্তর কবি অনেক বেশি শক্তিশালী। তিনি জ্বলবেন না আর, তবে জ্বালাবেন নীরবে ও নির্ঝুমতায়, তুলবেন অতীত দিনের কল্লোল। যারা পড়বেন, সমৃদ্ধ হবেন।
জন্মদিনে তার কীর্তিতে শ্রদ্ধা। দীর্ঘজীবনে কবি কী পেলেন আর কী হারালেন? শেষ করি তার কবিতা থেকে—
‘কাব্য লেখায় নব্য আমি আর কিছুকাল/ আমার গেল ছেলেখেলায় সন্ধ্যা-সকাল
এখন হাতের মুঠো খুলে দেখছিরে ভাই/ কেবল আছে আয়ুরেখা আর কিছু নাই।’
ইমরান মাহফুজ, কবি ও গবেষক
Comments