‘মানুষের উপকারেই স্বর্গ, আনন্দ’
বয়স সাত কিংবা আট বা আরেকটু বেশি। হঠাৎ একদিন দেখলেন বাড়ির কাছেই এক লোক তার স্ত্রীকে মাছ মারার কোচ দিয়ে মারছে আর রক্ত ছিটকে দেয়ালে পড়ছে। মার খেয়ে স্ত্রী তার স্বামীকে বলছিলেন, ‘তুমি (স্বামী) আমার ধর্ম বাপ লাগো। আমাগো দুইটা সন্তান আছে। আমারে মারো কিন্তু মাইরা ফালাইয়ো না।’
এ দৃশ্য দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলেন না। ছোট মেয়েটি তার মাকে নিয়ে আসলো নির্যাতিত নারীটিকে উদ্ধারে। মা এসে উদ্ধার তাকে।
‘এই একটু ঘটনা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আমার মা যদি পারে নির্যাতন বন্ধ করতে আমি কেন পারবো না? সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যদি এ সমাজে পরিবর্তন না আনতে পারি তবে আমি বিয়ে করবো না। এখনো পারিনি পরিবর্তন আনতে,’ বলছিলেন নারী মুক্তির আলোকবর্তিকা অ্যাঞ্জেলা গোমেজ।
অ্যাঞ্জেলা গোমেজ যিনি সব ধরনের প্রচারণা থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে গত ৪৫ বছর থেকে গ্রামের নারীদের বাঁচতে শিখানোর কাজটি করে যাচ্ছেন নিভৃতে। তার প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটির নাম ‘বাঁচতে শেখা’।
বলছিলেন তা শুরুর দিনের সংগ্রামের কথা। মাত্র ১২ বছর বয়সে শিশুদের পড়ালেখা শেখানোর সঙ্গে যুক্ত হন অ্যাঞ্জেলা। ১৯৭৪ সালে যশোর মহিলা কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন তিনি।
‘ভাবলাম দেখি এক বছর চেষ্টা করে গ্রামের নারীদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আনতে পারি কিনা। যেহেতু আমি বোর্ডিংয়ে থাকতাম তাই আমাকে বলা হলো এখানে থেকে এই কাজ করা সম্ভব না। তখন আমি এক ফাদারের বাড়িতে থেকে কাজ শুরু করি,’ তিনি বলছিলেন।
‘কিন্তু, পরিবেশ ছিল প্রতিকূল। এলাকার মানুষের নানান কটু মন্তব্যের কারণে আমি ফাদারের বাড়ি থেকে চলে যাই গ্রামে। আমার নাম হয়ে যায় আঞ্জুমারা। আমার স্বামী বিদেশে থাকে। আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে নারীদের হাতের কাজ শিখাই। তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করতে থাকি।’
‘১৯৮১ সালে এসে আমি আমার প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন করাই,’ করে অ্যাঞ্জেলা জানান, হস্তশিল্পের কাজের মান উন্নয়নের জন্যে তিনি কাশিমপুর, পাগলাদহ, নূরপুর, খোলাডাঙায় ঘর নির্মাণ করেন৷ গ্রামের শত শত নারীকে তার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে এগিয়ে নিতে থাকেন। নারী শিক্ষা, মানবাধিকার, হস্তশিল্প, নারী স্বার্থ ছাড়াও নারীর স্বাবলম্বীর জন্যে অ্যাঞ্জেলা ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেন৷
তারপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া। সংগ্রাম নারীদের কাছে অনুপ্রেরণার নাম অ্যাঞ্জেলা গোমেজ। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন দেশি-বিদেশি নানা পুরস্কার।
১৯৮৮ সালে পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ সমাজকর্মী পুরস্কার, ১৯৯২ সালে ডা. এম আর খান ও আনোয়ারা ট্রাস্ট স্বর্ণপদক, ১৯৯৯ সালে বেগম রোকেয়া পদক, একই সালে র্যামন ম্যাগসাসে পুরস্কারসহ আরো অনেক পুরস্কার।
কিন্তু অ্যাঞ্জেলা গোমেজ মনে করেন, তার এখনো অনেক কাজ বাকি।
‘অনেক কাজই এখনো বাকি। নারীদের জীবনে কাক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারি নাই। ঈশ্বরের কাছে আরেকটা জীবন চাই যেন নারীদের জন্য একটা নিরাপদ সমাজ গড়ে তুলতে পারি।’
অ্যাঞ্জেলা মনে করেন ‘বাঁচতে শেখা’ তার নিজের প্রতিষ্ঠান নয়, সব নারীর প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান মানুষকে বাঁচতে শেখাবে। সংসারে পুরুষরা নারীদের দাবিয়ে রাখবে না। পরিবারগুলো হয়ে উঠবে এক একটা স্বর্গ।
তার মতে, ‘মানুষের উপকারেই স্বর্গ, মানুষের কল্যাণেই আনন্দ। আমরা যেন মানুষ হয়ে মানুষকে শান্তি দেই। আমাদের সবার এই ব্রত হওয়া উচিত।’
১৯৫২ সালের এই দিনে বাবা অগাস্টিন গোমেজ এবং মা ইসাবেলার ঘরে আসেন অ্যাঞ্জেলা। নয় ভাই-বোনের মধ্যে অ্যাঞ্জেলা সপ্তম। গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার নাগরি ইউনিয়নের মাল্লা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
জন্মের পরেই বাবা তার নাম রেখেছেন ‘ফুল’। সবাই আদর করে তাকে ‘ফুল কুমারী’ বলে ডাকতেন। এখনো তার নিকট জনেরা তাকে ফুল বলে ডাকেন। আর সবার প্রিয় অ্যাঞ্জেলা ফুলের মতো সৌরভ ছড়িয়ে যাচ্ছেন আমাদের মাঝে।
ফুলের মতোই জীবন। অন্যের উপকার করতে করতে নিজের জন্য কিছুই করেননি। ‘আমার কোনো সম্পদ নেই। ব্যাংকে আমার ব্যক্তিগত কোনো টাকা নেই,’ বলছিলেন তিনি।
বিয়ের কথা জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আমি তো আমার প্রতিজ্ঞা ভুলিনি। সমাজে নারী নির্যাতন এখনো বন্ধ হয়নি।’
করোনাকালে ফোনে অনেকক্ষণ কথা হলো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলাম। কখন যে ঘণ্টা পার হয়ে গেল টেরই পেলাম না।
এই মহিয়সী নারীর জন্মদিনে শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন অ্যাঞ্জেলা গোমেজ।
Comments