ফুটপাত থেকে ফেসবুকে

১৯৮৮ সালে নরসিংদী থেকে ঢাকা আসেন ৬৪ বছর বয়সী হাবিবুর রহমান। এরপর গত ৩২ বছর ধরে এই শহরে তিনি বই বিক্রি করছেন। বর্তমানে ছেলের সহায়তায় অনলাইনে বই বিক্রি করা শুরু করেছেন হাবিবুর রহমান। অনলাইনে বই বিক্রির বিষয়টি তার কাছে বিস্ময়কর।
বিগত ১৬ বছর ধরে হাবিবুর রহমান শাহবাগে ফুটপাতে বই বিক্রি করেন। ছবি: লাবিবা ফাইয়াজ বারীর ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

১৯৮৮ সালে নরসিংদী থেকে ঢাকা আসেন ৬৪ বছর বয়সী হাবিবুর রহমান। এরপর গত ৩২ বছর ধরে এই শহরে তিনি বই বিক্রি করছেন। বর্তমানে ছেলের সহায়তায় অনলাইনে বই বিক্রি করা শুরু করেছেন হাবিবুর রহমান। অনলাইনে বই বিক্রির বিষয়টি তার কাছে বিস্ময়কর।

হাইকোর্টের সামনে এবং সদরঘাটের ফুটপাতে বই বিক্রি করা শুরু করেন হাবিবুর রহমান। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্থায়ী হন। বিগত ১৬ বছরে তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে অনেক ক্রেতার খোঁজ পেয়েছেন যারা তার কাছ থেকে নিয়মিত বই কেনেন।

হাবিবুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘শহরের অনেক এলাকাতেই আমি বই বিক্রি করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু, মানুষের কাছে আমার কাজটি সম্মানজনক না। তাদের কাছে আমি কেবলই একজন ফেরিওয়ালা। কিন্তু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা আমাকে এবং আমার পেশাকে সম্মান করেন। তারা আমাকে সাদরে গ্রহণ করেছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘মাঝে মাঝে তারা আমাকে বিভিন্ন বই এনে দিতে বলেন। কঠিন পরিস্থিতিতে তারা আমাকে আর্থিকভাবেও সহায়তা করেছেন। এটা আমার কাছে অনেক। আমি আর অন্য কোথাও এমন ভালোবাসা পাইনি।’

কিন্তু, যখন বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে বন্ধ হয়ে যায় হাবিবুর রহমানের ব্যবসাও। ক্যাম্পাসের ফুটপাতে থাকা তার দোকানে করোনাকালে ক্রেতা কমে যায়। কখনো কখনো ক্রেতাই থাকে না।

হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আগে আমি দৈনিক প্রায় তিন হাজার টাকার বই বিক্রি করতাম। এখন ৫০০ টাকার বই বিক্রি করতেও কষ্ট হয়ে যায়।’

তবে ছেলে মো. ইমন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাকে আবার নতুন করে আশা জোগাচ্ছে।

ইমন বলেন, ‘গত ১১ জুলাই থেকে আমি “বুক ডেসটিনি” নামে একটি ফেসবুক পেইজ পরিচালনা করছি। মাত্র দুই দিনেই আমরা বিপুল পরিমাণ সাড়া পেয়েছি। পেইজটিতে বর্তমানে প্রায় নয় হাজার লাইক রয়েছে।’

হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এই সংকটে আমি আমার ছেলের কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। আমি অনলাইন ব্যবহারে পারদর্শী না। আমার ছেলে ফেসবুক পেইজটা পরিচালনা করছে।’

বই বিক্রির ব্যবসাতে আগেও বাবাকে সহায়তা করতেন ইমন। তিনি (ইমন) খুচরো বিক্রির জন্য বাংলাবাজার থেকে বই নিয়ে আসতেন।

ইমন বলেন, ‘আসলে আমাদের একজন নিয়মিত ক্রেতাই আমাদেরকে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করার পরামর্শ দেন। মাঝেমধ্যে আমি নিজে গিয়েই বই ডেলিভারি দিয়ে আসি, আর মাঝেমধ্যে ডেলিভারি সার্ভিসের সহায়তা নেই।’

‘বুক ডেসটিনি ইতিমধ্যে মিরপুর, মগবাজার, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, ফার্মগেট ও খিলগাঁও এলাকায় বই ডেলিভারি করেছে’, বলেন তিনি।

এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের ব্যাপারে ইমন বলেন, ‘আমার মুঠোফোনটি পুরনো মডেলের। সে কারণে আমি অনেক বেশি ক্রেতার সঙ্গে সবসময় যোগযোগ করতে পারি না। এছাড়া, আমরা ঢাকার বাইরে এখনো এই সেবা চালু করিনি।’নতুন করে যেহেতু অনলাইন ব্যবসা শুরু হলো, ইমনের আশা তাদের ডেলিভারি ব্যবস্থা আরও দক্ষ হবে এবং ঢাকার বাইরেও তারা এই সেবা দিতে পারবেন।

অনলাইনে ব্যবসা শুরু করার কারণে হাবিবুর রহমান তার অনেক পুরনো ক্রেতাকেই ফিরে পেয়েছেন। এক ফেসবুক পোস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী লাবিবা ফাইয়াজ বারী লিখেন, ‘আমি গত ৫ বছর ধরে শাহবাগের হাবিব চাচার কাছে থেকে বই কিনি। এই পর্যন্ত তার কাছে থেকে আমি ৪০+ বই কিনে ফেলেছি। চাচা বেশ কম দামেই বই বিক্রি করেন। করোনার কারণে তার বেচাকানা বেশি হচ্ছে না। তবে চাচার ছেলে অনলাইনে পেইজ খুলেছে। সেখানে তিনি বই বিক্রি করেন। আগ্রহী কেউ থাকলে পেইজ থেকে বই কিনতে পারেন।’

হাবিবুর রহমানের ফেসবুক পেইজটিতে অনেক ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছেন তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা। অনেকে আবার দ্রুত ডেলিভারির জন্য ধন্যবাদও জানাচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা তাদের হাবিব চাচার এই উদ্যোগের প্রসারতা বাড়াতে সহায়তা করছেন এবং তাদের পরিচিতরাও এখন হাবিবুর রহমানের ফেসবুক পেইজে ভিড় করছেন।

বই বিক্রির প্রতি কেন আকৃষ্ট হয়েছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে আমি নিজে বেশি পড়াশোনা করতে পারিনি এবং আমার সন্তানদেরও করাতে পারিনি। কিন্তু, এই ব্যবসা আমাকে অনেক তৃপ্তি দেয় এবং এর কারণে আমার গর্ববোধ হয়। কারণ, আমার ক্রেতারা হলেন শিক্ষার্থী এবং তারা বইগুলো পড়ে আলোকিত হচ্ছেন। তারা আমার সন্তানের মতো এবং আমার এই ব্যবসা তাদেরকেও সহায়তা করছে।’

অনলাইনে ভালো পরিমাণে বিক্রি হওয়া সত্ত্বেও নিজের ব্যবসা পুরোপুরি অনলাইনভিত্তিক করছেন না হাবিবুর রহমান। এখনো তিনি শাহবাগে ফুটপাতে বইয়ের দোকান বসান। ‘ক্যাম্পাসটি এমন একটি জায়গা, যেখানে থাকতে আমার ভালো লাগে। এখানে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত আমার কাছে আসেন। এটা তো শুধু ব্যবসা না। আমি এখানকার শিক্ষার্থীসহ সবাইকে ভালোবাসি’, বলেন হাবিবুর রহমান।

Comments

The Daily Star  | English
Tofazzal beaten to death at DU

Man beaten to death in DU hall

He was suspected to have stolen students' mobile phones

59m ago