ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি
এডিস মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি শুধু মাত্র জুন-জুলাই মাসের বা ডেঙ্গু মৌসুমের কাজ নয়। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো বছরব্যাপী ডেঙ্গু ও মশক নিধন কর্মসূচি শুরু করেছে। প্রস্তুতিমূলক কাজ আগেই শুরু করায় চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ এখনো শুরু হয়নি। তবে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। মশক নিধন কার্যক্রমে তদারকি জোরদার করতে হবে। তাছাড়া এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি, তাই জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমরা কতটা প্রস্তুত’ শীর্ষক ভার্চুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা এসব কথা বলেন। বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো ও সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক ইনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ)। সহযোগিতায় ছিল ইউকেএইড এবং স্টার্ট ফান্ড বাংলাদেশ।
বৈঠকের প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘শুধু ডেঙ্গুর মৌসুমে কাজ করলে হবে না, বছরব্যাপী পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে মশক নিধন ও সচেতনতামূলক কাজ করতে হবে। আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়হীনতা দূর করতে একাধিক সভা করা হয়েছে। তবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।’
মশক নিধনের কীটনাশক নিয়ে বড় সিন্ডিকেট সক্রিয় ছিল জানিয়ে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘সিন্ডিকেট ভেঙে কীটনাশক আনা হচ্ছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে সাধারণ জনগণ এসব কীটনাশক কিনতে পারবেন। সরিষার দানার মতো এসব কীটনাশক থাকলে তিন মাস পর্যন্ত মশার লাভা জন্মাতে পারবে না। উত্তর সিটির ৪০টি জায়গায় বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার আফসানা আলমগীর খান বলেন, ‘গত বছরের মতো এডিস মশাবহিত রোগ যেন এবারও না ছড়ায় সেজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৫২ হাজার ৬০০ ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে। ২০১৯ সালের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে শুধু রাষ্ট্রের বা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করেন স্টার্ট ফান্ড বাংলাদেশের এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ার রাবেয়া সুলতানা। তিনি মুসলিম এইড ইউকে, বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর। রাবেয়া সুলতানা বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি যেন শুধু ঢাকাকেন্দ্রীক না হয়। গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর ৪৯ শতাংশই ছিল ঢাকার বাইরে।’
সূচনা বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘গত বছর সারা দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপ ছিল। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যক্রম শুরু করেছে। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে এবার যেন ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা না দেয়, সেটাই সবার প্রত্যাশা।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান বলেন, ‘রোগী কম তাই ডেঙ্গু হবে না, সেটি বলার সুযোগ নেই। ডিএনসিসির চিরুনি অভিযানে দেখা গেছে, যেসব স্থাপনায় মশার লার্ভা পাওয়া গেছে তার ৪০ শতাংশই নির্মাণাধীন ভবন। এসব ভবন সংশ্লিষ্টদের আরও সচেতনতা প্রয়োজন। কারিগরি কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পর্যাপ্ত কীটনাশক মজুত করা হয়েছে।’
সিপের উপনির্বাহী পরিচালক তহমিনা জেসমিন বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ে সিপ গত ৩০ এপ্রিল থেকে পূর্ব প্রস্তুতিমূলক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেছে। তিন মাসব্যাপী এই প্রকল্পের মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি করায় জোর দেওয়া হচ্ছে। করোনার এই সময়ে ডেঙ্গু নিয়ে যেন আতঙ্ক তৈরি না হয় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ‘ইমারত নির্মাণ বিধিমালাতে নির্মাণাধীন ভবন ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বলা আছে। কীভাবে ব্যবস্থাপনা করলে ডেঙ্গু মশা উৎপন্ন হবে না সেটি সেখানে যুক্ত করা প্রয়োজন। ডেঙ্গু রোগী এবং ডেঙ্গু মশার প্রজনন তথ্য সংগ্রহ ও স্থানগুলো চিহ্নিত করে রিয়াল টাইম ম্যাপিং করা সম্ভব। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে এবং ম্যাপ দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘ডেঙ্গুতে গত বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়। চিকিৎসা ব্যয়, মৃত্যুজনিত দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে বাসাবাড়িতে মশা নিয়ন্ত্রণ, সিটি করপোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠানের ব্যয়গুলো যুক্ত করা হয়নি। কীট নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা থাকা জরুরি।’
অভিনেত্রী, প্রযোজক ও পরিচালক আফসানা মিমি বলেন, ‘সব সমস্যা সরকারের, সব সমস্যা সিটি করপোরেশনের- জনগণের মধ্যে এমন ধারণা রয়েছে। সাধারণ নাগরিকদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। নিজের চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব নিজেরও। ডাবের খোসা, প্লাস্টিকের খালি বোতল, চিপসের প্যাকেটগুলো যত্রতত্র সাধারণ মানুষই ফেলছেন। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সবাইকে সচেতন হতে হবে।’
অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শওকত আলী (অব.) বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় বাংলাদেশের চিকিৎসক, নার্সরা যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছেন। রোগীর শারীরিক অবস্থা জটিল না হলে ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমেই বেশির ভাগ ডেঙ্গু রোগী সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন।’
ডিএনসিসির ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘এডিস মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করতে চিরুনি অভিযান চালিয়ে সুফল পাওয়া যাচ্ছে। এমন অভিযান আগামী আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসেও চলমান রাখা গেলে ভালো হয়। প্রতিটি ওয়ার্ডের নাগরিকদের সঙ্গে নিয়ে কার্যক্রম চালানো গেলে ডেঙ্গু নির্মূল সম্ভব।’
চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী আতিক আহসান বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর অবস্থান দ্রুত চিহ্নিত করা জরুরি। রোগীর অবস্থান চিহ্নিত করা গেলে তার অবস্থানের আশপাশের ৪০০ বর্গগজ এলাকায় নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চালানো গেলে সুফল পাওয়া সম্ভব। মেডিকেল শিক্ষার্থী ও নগর স্বেচ্ছাসেবী আলভী ইয়াছার বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও সিপের প্রকল্পের মাধ্যমে মশক নিধন ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমে তিনি অংশ নিয়েছেন। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।
Comments