বিশ্বায়নের সংকট

কোভিড-১৯ বিশ্বকে এক নতুন পাঠ শিখিয়েছে। আগে সাধারণত আন্দোলনকারী জনগণ লকডাউনের ডাক দিত, যেখানে বিশ্বজুড়ে সরকারগুলো এখন তাদের নাগরিকদের নিজ বাড়িতে আটকে রাখতে বাধ্য হচ্ছে। এমনকি বুদ্ধিজীবীরা এটিকে বিশ্বায়নের করাল থাবা বলেও উল্লেখ করছেন।
বিশ্বায়ন অনেক সুযোগের পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য বহু চ্যালেঞ্জও নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের উদার অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ, পর্যটন এবং রেমিট্যান্সের বৃদ্ধির পেছনে এটি অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ফলশ্রুতিতে যা চরম দরিদ্রতা হ্রাস করতে সহায়তা করেছে। এটি অর্থনীতিতে প্রযুক্তি ও আন্তঃনির্ভরশীলতা নিয়ে আসতেও সহায়তা করেছে।
বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা
টমাস ফ্রিডম্যান তার ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ফ্ল্যাট’ বইটিতে লিখেন যে ‘বিশ্বায়নের কারণে বিশ্ব সকলের কাছেই সমান ও অনুরূপভাবে উন্মুক্ত হয়ে উঠছিল।’ তিনি আরও দাবি করেন যে ‘সহযোগিতা এবং বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা করার ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোর নতুন করে পাওয়া ক্ষমতা বিশ্বকে আরও সমতল ও সমশ্রেণীভূক্ত করে তুলছে।’ উল্টোদিকে, এটি গ্রাহকের পরিমাণ ও বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতাও বৃদ্ধি করেছে।
বিশ্বায়নের অন্যতম অঙ্গ- বাণিজ্য উদারীকরণ, বাণিজ্যিক ঘাটতিকে অস্থিতিশীল পর্যায়ে বাড়িয়ে দিয়েছে। যা এখন মোট দেশজ উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশের কাছাকাছি চলেছে। উদারীকরণ, বেসরকারি খাতকে উন্নত করতে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির আধুনিকায়নে সহায়তা করলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অপরিবর্তিতই রয়েছে এবং স্থানীয় শিল্প ও মাঝারি উদ্যোগগুলোও প্রায় হারিয়েই গেছে। দরিদ্র দেশগুলো তাদের অস্তিত্বের কথাটি যেন ভুলেই গিয়েছে এবং তাদের বেঁচে থাকার জন্য খুব সামান্যই জায়গা রেখে বিশ্বব্যাপী যে খামখেয়ালীপনা চলছে তার শিকার হচ্ছে।
ছোট এবং মাঝারি আকারের ব্যবসাগুলো আমাদের প্রবৃদ্ধির ধারার কেন্দ্রস্থলে থাকা উচিত ছিল, তবে আমরা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মতি ধরে রাখার উপরই বেশি জোর দিয়েছি। আয়ের ব্যবধান আরও প্রশস্ত হয়েছে এবং বেকারত্বও বেড়েছে, যা মানুষকে বিদেশে চাকরি এবং সুযোগ খুঁজতে বাধ্য করছে। তবে, বিশ্বায়ন বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্সের উত্থানের পিছনেও অবদান রাখছে। যা এই রুগ্ন অর্থনীতির জন্য ত্রাণকর্তা হিসাবে কাজ করছে।
কোভিড-১৯ মহামারিটি আরও দুর্বলতা সামনে নিয়ে এসেছে। বিশ্বায়নের (একীভূত হওয়া/ ইন্টিগ্রেশন ও নিবিড় যোগাযোগ/কানেকটিভিটি) মূলকথার সঙ্গে তাল মেলানো এক অর্থে অসম্ভবপর হয়ে পড়েছে। কোভিড-১৯ এর ক্রোধকেও বৈষম্যমূলক বলে মনে হচ্ছে। এটি কমের চেয়ে বেশি যাদের আছে তাদের এবং সাম্যবাদী রাষ্ট্রের চেয়ে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোকে বেশী প্রভাবিত করছে। বর্তমানে বিশ্বায়নের উপাদানগুলো বৈপরীত্য (প্যারাডক্সিকাল) হয়ে উঠছে। বিশ্বায়ন, সংযোগ এবং একত্রীকরণের মত একবিংশ শতাব্দীর বহুল আলোচিত শব্দসমূহকে এই নতুন পরিস্থিতির উত্থান এবং অভিজ্ঞতার ফলে চোখ বন্ধ করে মেনে নেওয়া কষ্টকর হয়ে উঠছে। বিশ্বগ্রামের সদস্যরা তাদের অর্থনৈতিক ঘনিষ্ঠতার জন্য এক চরম মূল্য প্রদান করছে।
আজ এই সংকট দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে একটি হল পর্যটন। অনেক দেশের বিমানবন্দরগুলো নির্জন পড়ে আছে এবং বিমানগুলো রোদে পুড়ছে। রোগজীবাণু ছড়ানোর ক্ষেত্রে পর্যটকদের বড় ভূমিকা ছিল, তাই সামনের কয়েক বছর ধরেই এখন মানুষের চলাচল পর্যবেক্ষণ করা হবে। ভ্রমণের ক্ষেত্রে যে সব নিয়মনীতি প্রয়োগ করা হবে, তার জন্য মানুষ দীর্ঘ দূরত্বের যাত্রা বন্ধ করে দেবে এবং সম্ভবত নিকটস্থ স্থানে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভ্রমণকে বিকল্প হিসেবে বেছে নেবে।
সাম্প্রতিক প্রবণতা থেকে দেখা যায় যে, ভ্রমণের এই প্রকৃতি দেশীয় থেকে আঞ্চলিক পর্যায়ে মাঝামাঝিভাবে এবং ধীরে ধীরে দীর্ঘমেয়াদে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রভাব ফেলবে। এই পরিস্থিতিতে, বন্ধ থাকা অভ্যন্তরীণ ভ্রমণের চাহিদার বিষয়ে প্রচার চালিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। দেশ ভিত্তিক ভ্রমণের প্রচারগুলো আপাতত স্থগিত করা উচিত, কারণ চাহিদা সম্পূর্ণ পুনরুজ্জীবিত হতে দীর্ঘ সময় লাগবে। যেখানে ভ্রমণকারীরা খুবই ধীর এবং নড়বড়ে প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত নেবে।
যেহেতু বিশ্ব অর্থনীতি তার নিজস্ব গতিতে ফিরে আসার জন্য লড়াই করছে এবং স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে দীর্ঘস্থায়ী কর্মবিরতি চলছে। তাই অনেক শ্রম গ্রহণকারী দেশ আগের মত প্রচুর বিদেশি কর্মী রাখতে চাইবে না। যেহেতু বিদেশে শ্রমের চাহিদা হ্রাস পাবে, তাই শ্রম রপ্তানিকারক দেশের রেমিট্যান্সও কমে আসবে। ফিরে আসা শ্রমিকরা যেন তাদের বিদেশে অর্জিত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে নিজ নিজ এলাকায় নিজস্ব উদ্যোগে কর্মকাণ্ড শুরু করতে পারে, সে জন্য বৃহত্তর ভর্তুকির মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন পেশাগত প্রশিক্ষণ দিয়ে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেই উপায়গুলো নিয়ে বাংলাদেশের চিন্তা শুরু করা উচিত।
বিশ্বজুড়ে বিশ্বায়ন আজ আক্রমণের মুখে। উন্নত দেশগুলোতে বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া আরও স্পষ্ট, কেননা তাদেরই বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে। বিশ্বায়নের অন্যতম শর্তাবলী, যেমন: মুক্তবাণিজ্য, মুক্তবাজার এবং মানুষের মুক্ত চলাফেরায় পুনরায় বিধিনিষেধ আরোপের জন্য চাপ বাড়ছে। তবে কীভাবে, কখন এবং কে প্রথমে করবে এটি সর্বদাই বিশ্ব নেতৃত্বের জন্য একটি বড় প্রশ্ন। পছন্দ করুন বা না করুন এটি আধুনিক সময়ের একটি প্রয়োজনীয় অনিষ্টকর বস্তু।
বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যেকোনো প্রতিকূল পরিবর্তনের মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা যথেষ্টই সমর্থবান। তবে উন্মুক্ত সীমানা, মুদ্রা এবং বাণিজ্যে অতিরিক্ত ভারত নির্ভরতা থাকার কারণে এটি আঞ্চলিক অর্থনীতিতে ধাক্কা খাওয়ার জন্যও সমান ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে সংযোগ বা নির্ভরশীলতা যে মাত্রারই হোক না কেন, শক্তিশালী স্থিতিস্থাপকতা ব্যবস্থা তৈরি করার মাধ্যমে বাংলাদেশকে অবশ্যই এই ধরনের বাহ্যিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে শিখতে হবে।
মো. শরীফ হাসান, শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments