যে কারণে গবেষণা হয় না বিশ্ববিদ্যালয়ে

সুসজ্জিত পরীক্ষাগার নেই। তবে আছে, তহবিলের অভাব। ফলে নিজেদের বিশেষায়িত জ্ঞানের প্রত্যক্ষ ব্যবহার করতে পারছে না দেশের শত শত জৈবিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক গ্র্যাজুয়েটরা।

সুসজ্জিত পরীক্ষাগার নেই। তবে আছে, তহবিলের অভাব। ফলে নিজেদের বিশেষায়িত জ্ঞানের প্রত্যক্ষ ব্যবহার করতে পারছে না দেশের শত শত জৈবিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক গ্র্যাজুয়েটরা।

বিদ্যমান সরকারি নীতিমালাও ভাইরাস এবং অন্যান্য রোগজীবাণু, রোগ প্রতিরোধ, ভ্যাকসিন উন্নয়ন এবং বায়োটেকনোলজির উপর বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জোর দেয় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এর মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী বলেন, একটি গবেষণা প্রকল্পের জন্য তিনি দেশের সুসজ্জিত পরীক্ষাগার ঢাবির বিএলএস-২ পরীক্ষাগারে ডেঙ্গু ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করতে চেয়েছিলেন।

তিনি বলেন, ‘তবে আমার এক অধ্যাপক বলেন, “তুমি কি আমাদের সবাইকে মারতে চাও? আমাদের পরীক্ষাগার এই ভাইরাস নিয়ে কাজ করার জন্য উপযুক্ত না।” যার কারণে, আমাকে সেই প্রকল্পটি বাদ দিতে হয়েছিল।’

ঢাবির মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মনজুরুল করিম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএলএস-২ পরীক্ষাগারগুলো ইবোলা, ডেঙ্গু বা কোভিড-১৯ এর মতো অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাস নিয়ে গবেষণার জন্য উপযুক্ত নয়। এজন্য আমাদের বিএলএস-৩ বা ৪ পরীক্ষাগার প্রয়োজন।’

তিনি জোর দিয়ে বলেন, তাদের পাঠ্যক্রমটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে করে স্নাতক শিক্ষার্থীরা একটি ভাইরাস শনাক্ত করতে পারে এবং এর ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারে।

‘ভাইরাস নিয়ে আমাদের বিস্তৃত পাঠ্যক্রমের মধ্যে ভাইরাস কাঠামো ও প্রতিরূপ প্রক্রিয়া, ভাইরাসের সংক্রামক আচরণ, হোস্ট-ভাইরাস মিথস্ক্রিয়া, জেনেটিক মোর্ফোলজি, মিউটেশন আচরণ জৈব তথ্য এবং জিনোমিক্স অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’

যদিও ঢাবির মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ ভ্যাকসিন ডিজাইনের জন্য ইন-সিলিকো বিশ্লেষণ করতে পারে, তবে কার্যত এটি করার জন্য তাদের কাছে ল্যাব সেটআপ নেই।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মতে, কমপক্ষে ১৯টি সরকারি ও চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে বায়োটেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, মাইক্রোবায়োলজি, জৈব রসায়ন এবং আণবিক জীববিজ্ঞানসহ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর কোর্স করাচ্ছে।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব প্রযুক্তি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক একেএম মহিউদ্দিন বলেন, ‘বেশিরভাগ ঠিকাদার, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো তৈরি করেন, তারা জানেন না যে কীভাবে ভবনগুলো তৈরি করলে আমরা পরীক্ষাগারগুলোতে রোগজীবাণু সুরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করতে পারি।’

বর্ষাকালে প্রায়শই তাদের গবেষণাগারটি স্যাঁতসেঁতে থাকে এবং ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার তৈরি হওয়ার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এমন পরীক্ষাগার থেকে সঠিক ফলাফল আশা করা যায় না। সে কারণেই আমাদের বেশিরভাগ মনোনিবেশ করতে হয় তাত্ত্বিক পড়াশোনায়।’

২০১৮ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি (এনআইবি) মানবদেহে ডায়রিয়ার সৃষ্টিকারী সংক্রামক রোটাভাইরাসের জন্য একটি ভ্যাকসিন তৈরি করে ইন-সিলিকো বিশ্লেষণের মাধ্যমে। কম্পিউটার সিমিউলেশনের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক গবেষণার একটি মাধ্যম ইন-সিলিকো।

তবে গবেষকরা ডিজাইনটি পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করতে পারেনি। কারণ দেশে কার্যকরী বায়োসেফটি মানের বিএসএল-৩ পরীক্ষাগার নেই।

এনআইবির মাইক্রোবায়াল বায়োটেকনোলজি বিভাগের জ্যৈষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পলাশ কুমার সরকার জানিয়েছেন, বেশিরভাগ গবেষণাগুলোই কৃষিভিত্তিক।

এগুলো গুরুত্বপূর্ণ হলেও, সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারির মতো প্রাদুর্ভাব মানব রোগজীবাণু, বিশেষত ভাইরাস এবং ভ্যাকসিন বিকাশের বিষয়ে মৌলিক গবেষণায় আরও বেশি বিনিয়োগের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।

অর্থ সংকট

ঢাবির বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল আজিম আখন্দ বলেন, ‘আমাদের পরীক্ষাগারটির জন্য প্রয়োজনীয় রিএজেন্ট এবং যন্ত্রপাতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এগুলো আমদানি করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের সীমিত বাজেট থেকে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এ খাতে বরাদ্দ করতে হয়।’

তিনি জানান, স্নাতকোত্তর গবেষকদের জন্য তাদের তহবিলের ৮০ শতাংশেরও বেশি ব্যয় করতে হয় ল্যাবরেটরি সাজাতে। ফলে গবেষণার অন্যান্য অংশের জন্য বাকি থাকে সামান্য অর্থ। এতে করে গবেষণার সামগ্রিক গুণমান প্রভাবিত হয়।

বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য বাজেট বরাদ্দ খুবই কম।

২০১৯-২০২০ অর্থবছরের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য বাজেটের বরাদ্দ মাত্র ৬৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। যা মোট জাতীয় উন্নয়ন বাজেট পাঁচ হাজার কোটি টাকার মাত্র এক দশমিক ২৬ শতাংশ।

আইসিডিডিআর,বি এর সংক্রামক রোগ বিভাগের এমেরিটাস বিজ্ঞানী ডা. ফিরদৌসী কাদরী উল্লেখ করেছেন যে ল্যাব সরঞ্জামাদি রক্ষণাবেক্ষণ, সেগুলোর যথাযথ প্রত্যয়ন ও স্বীকৃতির ব্যবস্থা করে রাখাও ব্যয়বহুল।

বাংলাদেশের সংক্রামক রোগ গবেষণায় শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশে বর্তমানে কমপক্ষে তিনটি সুসজ্জিত ভাইরোলজি পরীক্ষাগার রয়েছে।

এছাড়াও বায়োসেফটি ক্যাবিনেট এবং সরঞ্জাম সংরক্ষণ ও প্রত্যয়ন করার জন্য দেশে প্রশিক্ষিত জনবল রয়েছে খুব কম। পরীক্ষাগারগুলোর জন্য প্রশিক্ষিত জনবল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এগিয়ে যেতে করণীয়

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিত্সক এবং শিল্পের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সম্পর্ক গঠনের মাধ্যমে গবেষণা উন্নত করা যেতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনজুরুল বলেন, ‘ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলোর মতো শিল্পগুলোকে এমন ইনস্টিটিউটে ল্যাবরেটরিগুলোকে সহযোগিতা করা উচিত যেখানে গবেষকরা রোগজীবাণু, ওষুধ, ভ্যাকসিন ইত্যাদি নিয়ে কাজ করবেন। এতে শিল্পেরই উপকার হবে।’

‘অন্যদিকে, ক্লিনিকাল ট্রায়ালের জন্য এবং অধ্যয়নের নমুনা সংগ্রহ করতে চিকিত্সক ও গবেষকদের মধ্যে সহযোগিতা থাকতে হবে। এটি সরকারি হাসপাতাল এবং মেডিকেল ইনস্টিটিউটগুলোতে মাইক্রোবায়োলজিস্ট, বায়োটেকনোলজিস্ট, ফার্মাসিস্ট এবং আণবিক জীববিজ্ঞানীদের নিয়োগ দিয়ে করা যেতে পারে।’

বর্তমানে সরকারি হাসপাতালে মাইক্রোবায়োলজিস্ট, ফার্মাসিস্ট বা বায়োটেকনোলজিস্টের কোনো পদ নেই। চিকিত্সা ইনস্টিটিউটগুলোতে মাইক্রোবায়োলজিস্ট পদ রয়েছে। সেগুলো কেবলমাত্র চিকিত্সক দিয়েই পরিপূর্ণ, মাইক্রোবায়োলজিতে স্নাতকদের দিয়ে নয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের হাসপাতাল শাখার অতিরিক্ত সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, বর্তমান নিয়োগ নীতিমালার কারণে অন্য কোনো বিভাগের স্নাতকরা এই পদে আবেদন করতে পারে না।

তিনি বলেন, ‘আমরা বিসিএসে (স্বাস্থ্য) উত্তীর্ণ ক্যাডারদের দিয়ে এই পদগুলো পূরণ করি। কেবলমাত্র নিবন্ধিত চিকিত্সকরা বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আবেদন করতে পারেন।’

ওষুধ শিল্প মালিকরা মতামত দিয়েছেন যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিল্পমুখী গবেষণায় আগ্রহ দেখালে শিল্প-বিশ্ববিদ্যালয় পারস্পরিক সহযোগিতা ঘটতে পারে।

ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মুক্তাদির বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের পাঠ্যক্রমে সংস্কার আনা উচিত এবং পণ্যমুখী গবেষণায় আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। আমরা এখন উচ্চ প্রযুক্তির ওষুধ তৈরি করতে শুরু করেছি এবং ভ্যাকসিন তৈরির লক্ষ্যেও কাজ করছি।’

‘আমাদের স্নাতকরা নিকট ভবিষ্যতে এই ক্ষেত্রগুলোতে তাদের ব্যবহারিক জ্ঞান প্রয়োগের যথেষ্ট সুযোগ পাবে। যা এক দশক আগেও বাংলাদেশে ছিল না।’

দেশের ওষুধ শিল্প এখনও বিদেশি গবেষণার উপর নির্ভরশীল এবং ওষুধের বেশিরভাগ প্রধান রাসায়নিক উপাদানগুলো (এপিআই) আমদানি করতে হয় ভারত ও চীন থেকে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিকাল ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক এস এম শফিউজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশে এপিআই তৈরির জন্য একটি শিল্প উদ্যান প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, যা অনেক বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও গবেষকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে।’

‘যদি আমরা এই শিল্প পার্ককে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাদের গবেষণাগারগুলোর সঙ্গে একটি সহযোগী সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি তাহলে আমরা সাশ্রয়ী মূল্যে অনেক ব্যয়বহুল উচ্চ প্রযুক্তির ওষুধ এবং ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারব।’

Comments

The Daily Star  | English

Floods cause Tk 14,421 crore damage in eastern Bangladesh: CPD study

The study highlighted that the damage represents 1.81 percent of the national budget for fiscal year (FY) 2024-25

1h ago