প্রবাসে

হাঙ্গেরিতে কোভিড-১৯ এর তেমন প্রভাব পড়েনি

কোথায় যেন পড়েছিলাম, মানুষ যত বড় হয়, তত বড় হয় তার ঠিকানা! অমুক বাড়ির ছেলে থেকে হয় অমুক পাড়ার ছেলে, সেখান থেকে অমুক গ্রাম, অমুক জেলা, বিভাগ এমনি করে বাড়তে থাকে, হয় দেশ-মহাদেশ।
হাঙ্গেরির ডেব্রেসেন শহর। ছবি: আরিফ জামান

কোথায় যেন পড়েছিলাম, মানুষ যত বড় হয়, তত বড় হয় তার ঠিকানা! অমুক বাড়ির ছেলে থেকে হয় অমুক পাড়ার ছেলে, সেখান থেকে অমুক গ্রাম, অমুক জেলা, বিভাগ এমনি করে বাড়তে থাকে, হয় দেশ-মহাদেশ।

ঠিকানা বড় হওয়ার এমন এক যাত্রায় গত এক বছর ধরে আছি ইউরোপের ছোট্ট দেশ হাঙ্গেরিতে! সরকারি বৃত্তিতে আসায়, চলার জন্য তেমন কোন কষ্ট করতে হয় না। পড়ালেখা-রান্নাবান্না-দৈনন্দিন কাজকর্মে বেশ নির্ঝঞ্ঝাট জীবন যাকে বলে! মাঝেমধ্যে বেড়াতে যাওয়া হয় অন্য শহরগুলোতে, কিংবা কদাচিৎ আশেপাশের দেশগুলোতেও, অথবা নেহাত-ই শহরের বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে।

জীবন যাপন এখানে অনেক সহজ, কোথাও কোন ঝামেলা নেই, সবাই নিজের মতো করে বাঁচছে, কোথাও কারো যেন তাড়াহুড়ো নেই। মাঝেমধ্যে সবকিছু অনেক নিস্তরঙ্গ বলে মনে হয়। অবশ্য ঢাকার গতিময়তায় কয়েকবছর বাস করে এই বোধ হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। আর সত্যি বলতে গেলে অতিরিক্ত গতিময়তার সাথে ইউরোপের বিরাগ-এই জায়গাতেই অন্যান্য অনেক দেশের সাথে ইউরোপ কিছুটা আলাদা! আধুনিকতা মানে এখানে শুধুই আরো একটু ছুটে চলা নয়!    

কিন্তু এই নিস্তরঙ্গ ঝামেলাবিহীন জীবনেও হঠাৎ হঠাৎ অস্তিত্বের সংকট আসে, কখনো আধো ঘুমে-অন্ধকারে, কখনো বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে, কখনোবা একটা টাটকা কাঁচা লঙ্কার আক্ষেপে। 

ছোটবেলায় মা কখনোই মাগরিবের সময় ঘুমাতে দিতেন না। এখানে সেই বলার মানুষ নেই। মাঝেমধ্যে সারাদিনের ব্যস্ততায় ঘুমিয়ে পড়ি সন্ধ্যাবেলায়, গ্রীষ্মের সন্ধ্যা মানে রাত নয়টা! হঠাৎ একটা সুন্দর স্বপ্ন-বা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে জানালা দিয়ে আসা গোধূলীর আলো-অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কখনো কখনো একধরনের ঘোর চলে আসে। বাইরে থেকে ভেসে আসা কারো টুকরো কথাকে মনে হয়, দেশের বাড়িতে বাইরে থেকে এসে বাবার দরজা খোলার শব্দ, কিংবা রাস্তায় চলা মার্সিডিজের চাকার শব্দকে ভ্রম হয় দেশের চিরাচরিত কোলাহলের শব্দে। পানির ফোঁটার শব্দে মনে হয় মা রান্নাঘরে কাজ করছেন, কিংবা পাশের ঘরেই আছেন। কখনো কখনো চমকে উঠি, মনে হয় আমাদের টিনের চালে জলপাই পড়ার শব্দ হলো।

সজ্ঞান হলে বুঝতে পারি, এর সব-ই ভ্রম! সত্যি নয়! চোখের সামনের এই অবাস্তবতা নিজের-ই বিশ্বাস হয় না। তারপরেও এই অবাস্তবতাকে মেনে নিয়েই চলছিল জীবন। ব্যস্ততায় এসব ভাবার তেমন ফুরসৎ মিলতো না। এরপর এলো কোভিড-১৯! পরিচিত জগতটার অনেকখানিই বদলে যাওয়া শুরু হলো। অবশ্য ইউরোপের অন্য দেশগুলোর তুলনায় হাঙ্গেরিতে বলতে গেলে কোন প্রভাব-ই পড়েনি কোভিড এর। দুইমাস জরুরি অবস্থা চালু ছিল মাত্র। আগাম বর্ডার নিয়ন্ত্রণ এবং কার্যকর কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং ব্যবস্থার কারণে খুব দ্রুতই নিয়ন্ত্রণে এসে যায় সব, কোভিড কেস পার হয়নি পাঁচ হাজার। এখন প্রায় মাসখানেক হয়ে গেল জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার, জীবনযাত্রা পুরোপুরি স্বাভাবিক।

আমি যেই শহর, ডেব্রেসেনে, থাকি তা হাঙ্গেরির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। কিন্তু রাজধানী বুদাপেস্টের তুলনায় অনেকখানি নিরিবিলি। গ্রীষ্মের ফুরফুরে হাওয়ায় চারিদিকের সবুজ গাছপালা আর ফুলের রাজ্য থেকে বাতাসে ভেসে আসে একরকম মিষ্টি গন্ধ। আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই! গ্রীষ্মের দুপুরে বাংলাদেশের কবরস্থান জাতীয় স্যাঁতস্যাঁতে স্থান থেকে যেমন একটা মাদকতাময় ভেজা গন্ধ আসে ঠিক সেরকমটা মনে হয়।

গেল মাসে তো দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম যে বাংলাদেশে আছি নাকি এখানে! কখনো যেন ইলিয়াসের “রেইনকোট” গল্পের নিয়ম মেনে বৃষ্টি! “যেমন, মঙ্গলে ভোররাতে হলে শুরু, তিনদিন মেঘের গুরুগুরু। তারপর, বুধের সকালে নামলে জল, বিকেলে মেঘ কয় এবার চল”

অনলাইন ক্লাস করে, রান্নাবান্না করে, মাঝেমধ্যে অন্য বাংলাদেশিদের বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে, আর বৃষ্টি দেখে বেশ কেটে গেল দিন।

ঝামেলায় পড়ে গেলাম সামারের ছুটি শুরু হওয়ার পর থেকে। করোনার প্রভাবে পার্টটাইম জব বা ইন্টার্নশিপ বা অন্য সুযোগ হয়ে এসেছে সীমিত। তাই বলতে গেলে তেমন কোন কাজ নেই। এইসময়টাতেই দেশে যাওয়ার কথা ছিল, সবকিছু ঠিক ছিল, অথচ দেশে যেতে পারছি না।  

সন্ধ্যায় আধো-আলো অন্ধকারের এই সময়ে ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ তাই যখন মনে হয় যে এখন চাইলেও প্রিয় মায়ের কাছে যেতে পারবো না, নিকট সময়ে চায়ে চুমুক দেয়া হয়ে উঠবে না টিএসসিতে বসে, যাওয়া হচ্ছে না বেঙ্গল বই, বাতিঘরের আড্ডাতে, গায়ের চাদরটা আরেকটু টেনে নিয়ে এই বাস্তবতা মেনে নিতে গিয়ে তখন নিজেকে কাফকা কিংবা আলবেয়্যার কামুর উপন্যাসের একজন চরিত্র বলে মনে হয়, যে কিনা আটকে গেছে নিজের নিয়তিতে!

অবশ্য শুনলাম বন্ধ হয়ে গেছে আমার অন্যতম প্রিয় জায়গা দীপনপুর-কবিতাক্যাফে! প্রতিনিয়ত প্রিয় কত মানুষের দুঃসংবাদ ক্রমাগত এসে পৌঁছাচ্ছে। এরপরেও আশা রাখি, শিগগির ঠিক হয়ে যাবে প্রিয় পৃথিবী, প্রিয় বাংলাদেশ। একদিন ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু! একদিন দেশেও যাওয়া হবে হয়তো।

কিন্তু সবকিছু কী আর আগের মতো থাকবে? এই নিয়তি মেনে নেয়া যে বড় কষ্টের…!  

(লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ডেব্রেসেন, হাঙ্গেরি)

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

6h ago