স্বাধীনতার সমান বয়সী হুমায়ূন আহমেদের কীর্তি
বাংলাদেশের জন্ম ও হুমায়ূন আহমেদের লেখক জীবনের শুরু প্রায় সমসাময়িক। দেখা যায়- রাষ্ট্রের অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে, ভাষা আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ইতিহাস ও ঐতিহ্য নির্মাণ হচ্ছে; একই সঙ্গে বইয়ের পাঠকরা দেশীয় লেখকের দেশি ভাষায় চারপাশকে জানছে এবং সামাজিক ও পারিবারিক অনুভূতি নিয়ে ভাবনার সুযোগ পাচ্ছে। ফলে পাঠক নন্দিত সেই লেখক আজ না থাকলেও, আছে তার অগণিত পাঠক ও সৃজন মায়ার সংসার। এর সবই বহমান থাকবে কাল থেকে কালান্তর- বাংলাদেশ ও রাষ্ট্রভাষা থাকবে যতদিন।
স্বাধীনতার পরপরই হুমায়ুন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হয়। বইটির ভূমিকায় আহমদ শরীফ লিখেছিলেন, ‘নামের মধ্যেই যেন একটি জীবন দৃষ্টি, একটি অভিনব রুচি, চেতনার একটি নতুন আকাশ উঁকি দিচ্ছিল। পড়তে শুরু করলাম ঐ নামের মোহেই। পড়ে অভিভূত হলাম। গল্পে সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছি একজন সুক্ষ্মদর্শী শিল্পীর, একজন কুশলী স্রষ্টার পাকা হাত। বাঙলা সাহিত্যক্ষেত্রে এক সুনিপুণ শিল্পীর, এক দক্ষ রূপকারের, এক প্রজ্ঞাবান দ্রষ্টার জন্মলগ্ন যেন অনুভব করলাম।’
এইভাবে তিনি আলোচনায় আসেন বইপাড়ায়। তার সমালোচনাও করছেন কেউ কেউ। সেগুলোতে পাত্তা দেননি এই কথাকার। তারপর একে একে বহু উপন্যাস লেখেন। বইয়ের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যায়। কেবলমাত্র গল্প বলার জাদুকরী শক্তিই তাকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। পরিচিতি পান ঢাকা ও কলকাতায় বাংলা সাহিত্যের সর্বাধিক উপন্যাসের লেখক হিসেবে। বাংলা মুল্লুকে উপন্যাস লিখে তার মতো এতো পাঠকপ্রিয় ও বিত্ত-বৈভবের মালিক আর কেউ হননি (সম্মানী হিসাব করে প্রকাশকরা অজানা এক তথ্য জানিয়েছিলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশিত এক একটা শব্দের বিক্রয় মূল্য পাঁচ হাজার পাঁচশ টাকা মাত্র’)।
জনশ্রুতি আছে, পাঠ-বিমুখতার দুর্দিনে পাঠক তৈরিতে অসামান্য ভূমিকা রাখেন তিনি। কলকাতার লেখকদের সরিয়ে বাংলাদেশের পাঠকদের বইয়ের সেলফ সমৃদ্ধ করেছেন। যদিও পাঠকদের সিংহভাগ (নগরকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা নতুন মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত) শিক্ষার্থী, যারা সম্ভবত শুধু তার উপন্যাস নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়তেন। কথার পিঠে কথা কথা বলার সময় টানটান উত্তেজনা, নাটকীয়তা, বৈচিত্র্যময় ও হাসি রসাত্মক চরিত্র সৃষ্টি এবং জীবন সম্পর্কে গভীর দৃষ্টি হুমায়ূন আহমেদকে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা দেয়। একই সঙ্গে গল্পে সহজাত ভঙ্গিমার কারণে সাধারণ মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছিল তার সৃষ্টি। তবে একটা বয়সের পরে তার উপন্যাসের তেমন অনুরাগী থাকে না বলে শোনা যায়। এসব কথায় ‘নাক-কান’ কোনোটাই তিনি দিতেন না! ব্যক্তিগত জীবনে হুমায়ূন আহমেদ নিজের সততা ও লেখার ক্ষমতা নিয়ে অহংকারী ছিলেন বলেই মোটামুটি আঁচ করতে পেরেছেন পাঠকমহল। এ অহংকার তার সঙ্গে মানানসইও ছিল!
খ
একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং উত্তরকালে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের অন্তর্ধানের পরে জনপ্রিয় ধারার উপন্যাসের খরা শুরু হয়। এর আগে ও পরে পুরোদমে চলে ভারতীয় ঔপন্যাসিকদের দাপট। ঠিক সময়ে বিস্ময়করভাবে আগমন ঘটে এই নক্ষত্রের। তার একাডেমিক পড়াশোনা বিজ্ঞানে। অথচ, সাহিত্য চর্চা করে রাজত্ব করেছেন বাংলায়। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় দারুণভাবে পদচারণা করে গেছেন। গল্প, উপন্যাস, সাইন্স ফিকশন, চলচ্চিত্র, নাটক, গান, আত্মজীবনীসহ সব বিভাগে। মনে পড়ে, একবার দৈনিক কালের কণ্ঠের বিশেষ সংখ্যায় তার লেখা কবিতাও পড়ছিলাম! সর্বোপরি এক অবিশ্বাস্য রকমের জীবনের আনন্দ সাহিত্য ঘটিয়েছিলেন তিনি। মানুষের যাপিত জীবনের বিচিত্র ব্যবহার, শ্রেণী চরিত্র, বিষণ্ণতার বেড়াজাল, সঙ্কট ও সম্ভাবনা তার লেখাকে করেছে বৈচিত্র্যময়। সেই সঙ্গে ইতিহাসের দাসত্ব না করে, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মরণীয় ঘটনার উপকরণ নিয়ে নির্মাণ করেছিলেন ‘বাদশা নামদার’ ও ‘দেয়াল’র মতো অসামান্য উপন্যাস।
তার লেখার মধ্যে আমার নিজের সবচেয়ে প্রিয় গল্প ‘সংসার’। বিশ্ব সাহিত্যে ইঁদুর নিয়ে দুটি শক্তিশালী গল্প লেখা হয়েছে। একটি সোমেন চন্দ লিখেছেন এবং অন্যটি লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদের এই গল্পে মুসলমান সমাজের প্রতি হাস্যরসের ভেতর দিয়ে যে বক্রোক্তি সেটার সঙ্গে শুধু আবুল মনসুর আহমদের গল্প তুল্য। সোমেন দ্বারা হুমায়ূন প্রভাবিত ছিলেন, আমরা জানি। কিন্তু সোমেন ইঁদুরকে দেখিয়েছেন বুর্জেয়াদের প্রতীক হিসেবে, আর হুমায়ূন ইঁদুরকে উল্টো সমাজের যারা প্রভু তাদের হাতের খেলনা হিসেবে দেখিয়েছেন।
একইভাবে ‘চোর’ গল্পটিও সাধারণ গল্প হয়ে থাকেনি। একটি চোর ধরা পড়েছে। গ্রাম্য শালিসের রায় হয়েছে তার চোখ তুলে নেওয়া হবে। তাও আবার খেজুরের কাঁটা দিয়ে। গ্রামের মানুষ জড়ো হয়েছে চোখ উপড়ে নেওয়ার দৃশ্যটি দেখবে বলে। চোর মতি ভাবে, এত এত মানুষের মধ্যে নিশ্চয় কেউ দয়া দেখিয়ে বাধা দেবে। কিন্তু দেখা যায় উল্টো চিত্র। শিক্ষিত, অশিক্ষিত, নারী-পুরুষ সবাই অপেক্ষা করছে চোখ তোলার দৃশ্যটি দেখবে বলে। (মোজাফ্ফর হোসেন)
গ
পাঠ বিশ্লেষণে দেখা যায়- হুমায়ুন আহমেদের প্রায় সব উপন্যাসে নায়ক-নায়িকা মনো জটিলতার শিকার। সে কারণে তাদের আচার-আচরণও অস্বাভাবিক। প্রায়শ চরিত্রকেই দেখা যায় নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত, আবেগহীন। যা শুধু বইতে মানায়, বাস্তবে না। সে তুলনায় রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে সেগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র বলে মনে হয় না। কখনো সেগুলো অনেক বেশি জীবন্ত, কখনো অনেক বেশি মানবিক। যা চলমান সমাজে অধরা! গল্পে-উপন্যাসে নানা মাত্রিক দ্বন্দ্ব ও বিন্যাস নিয়ে বিকশিত বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদ নিজেও অবশ্য সন্দিহান ছিলেন একসময়, তার উপন্যাসগুলো প্রকৃত অর্থেই উপন্যাস কিনা! সে আলোচনা হবে অন্য কোনো দিন।
হুমায়ূনের লেখা প্রসঙ্গে সমালোচকদের সব সময়েই স্পষ্ট কথা ছিল- সমাজ সচেতনতা, রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং লেখকের সামাজিক দায়বদ্ধতার দৃষ্টি নিয়ে।
হুমায়ূন আহমেদ তার ‘ফাউন্টেনপেন’ আত্মজীবনীমূলক রচনায় জবাব দিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, ‘বদরুদ্দিন ওমর একবার সমকাল পত্রিকার সেকেন্ড এডিটরিয়াল লিখেন। উনি বলেছেন, “আপনার লেখায় শিক্ষামূলক কিছু নেই।” এটা তো উনি ঠিকই বলেছেন। আমি পাঠ্যবই লিখি না। আমার বই শিক্ষামূলক হবে কেন? জীবনে একটাই পাঠ্যবই লিখেছিলাম ‘কোয়ান্টাম রসায়ন’। সম্ভবত উনার চোখ এড়িয়ে গেছে। এখন শিক্ষা বিষয়ে বলি। অতি বিচিত্র কারণে বাংলাদেশের মানুষ সবকিছুতেই শিক্ষা খোঁজে। গল্প-উপন্যাসে শিক্ষা, নাটক-সিনেমায় শিক্ষা। একসময় ঈদের প্রচারিত হাসির নাটকের শুরুতে আমি লিখে দিতাম, “এই নাটকে শিক্ষামূলক কিছু নেই।”’
প্রাসঙ্গিক কিছু পাঠকের সঙ্গে কথা বলি, কী ভাবনায় এবং কেন তারা হুমায়ুন পড়েন? অধিকাংশ পাঠকের মত প্রায় এমন, ১. মনো চিত্তের প্রশান্তির জন্য পড়ি, ২. পড়তে বসলে নেশা হয়ে যায়, আঠা যেমন আটকে রাখে তেমন, ৩. নিজেকে দেখি বর্ণনায়, তাই একবার পড়া শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যায় না, ৪. গল্পের বর্ণনাকারী বা চরিত্রটি আমি নিজে বলে মনে হয়, এতে অসাধারণ ভালো লাগার অনুভূতি কাজ করে, ৫. মনের আকাঙ্ক্ষা মোটামুটি মিটে যায় মজার গল্পে গল্পে।
অন্যদিকে এই বিষয়ে তার সমসাময়িক লেখক ও সমালোচকদেরও ছিল ভিন্ন দৃষ্টি। সমালোচনার জায়গাটিকে দুটি আঙ্গিকে দেখা যায়। এক পক্ষের সমালোচকরা হুমায়ূন আহমেদকে লেখালেখির জগতের কিংবদন্তী কিংবা দেবতা হিসেবে দেখেন। অপরপক্ষ তার লেখাকে সস্তা, অপাঠ্য এবং কোনো ক্ষেত্রে ‘অপন্যাস’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন। তবে ঠিকঠাক মতো তার সাহিত্যের বিশ্লেষণ এখন পর্যন্ত হয়নি বলে অনেকের দাবি। আশা করা যায়, আগামী দিনে তার সাহিত্যকর্মের যথাযথ নিরপেক্ষ মূল্যায়ন হবে। মূল্যায়ন হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগরণে হুমায়ূনের ভূমিকাও।
উল্লেখ্য, বাংলা সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীতে লেখাকে জীবিকা করার প্রথম উদাহরণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। একবিংশ শতাব্দীতে তার দোসর হয়ে আসেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি সফলও হয়েছেন রাজকীয় জীবন ও কীর্তিতে! অর্থাৎ সব অর্থেই তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র মেগাস্টার! তাই কখনো নন্দিত, কখনো নিন্দিত। কখনো তিরস্কৃত, কখনো পুরস্কৃত। আবার কখনো মামলা ও কারা নির্যাতনের ভয় দেখানো হলেও হুমায়ূন আহমেদ স্বাধীনতার সমান বয়সী খ্যাতি নিয়ে লেখকের জীবনটা পার করেছেন জীবনানন্দে।
ইমরান মাহফুজ, কবি ও গবেষক, [email protected]
Comments