প্লাজমা থেরাপি নিয়ে নৈরাজ্য, বলছেন বিশেষজ্ঞরা
‘যদিও করোনায় আক্রান্ত সংকটাপন্ন রোগীদের জন্য প্লাজমা থেরাপি আশার আলো দেখাচ্ছে, তবে, কোনো ধরনের গাইডলাইন ছাড়া এর বাছবিচারহীন ব্যবহার দেশে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে’— এমনটিই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত মাসে দেশের তিনটি সরকারি হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীদের ওপর প্লাজমা থেরাপির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ওই তিন হাসপাতাল হচ্ছে— ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল।
কিন্তু, কোনো ধরনের গাইডলাইন ছাড়াই দেশের অনেকগুলো হাসপাতাল ইতোমধ্যে করোনা রোগীদের প্লাজমা থেরাপি দিচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে ঢামেক হাসপাতালের রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এমএ খান বলেন, ‘প্লাজমা থেরাপি নিয়ে বাংলাদেশে সম্পূর্ণ অরাজকতা চলছে।’
প্লাজমা থেরাপি দেওয়ার জন্য করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন এমন ব্যক্তির রক্ত থেকে অ্যান্টিবডি নিয়ে তা গুরুতর অসুস্থ করোনা রোগীর রক্তে ট্রান্সফার করা হয়। যাতে এটি তার ইমিউন ব্যবস্থার উন্নতিতে সহায়তা করে।
‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একজন রোগীকে একেবারে মুমূর্ষু অবস্থায় প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হয়। কিন্তু, এমন সময়ে রোগীকে প্লাজমা থেরাপি দেওয়ার উপদেশ দেওয়া হয় না’, বলেন অধ্যাপক ডা. এমএ খান।
তিনি জানান, প্লাজমা থেরাপি সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নের জন্য গত ২০ জুন তিনি জাতীয় কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটিকে একটি চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু, এখনো তিনি কোনো উত্তর পাননি।
‘রোগীকে কখন প্লাজমা থেরাপি দিতে হবে, এ নিয়ে চিকিৎসকরা এখনো দ্বিধায় আছেন। এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট গাইডলাইন প্রণয়নে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি’, যোগ করেন ডা. এমএ খান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো ধরনের গাইডলাইন ছাড়া কোভিড-১৯ রোগীকে কনভালসেন্ট প্লাজমা থেরাপি দেওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ এবং এতে রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে।
তারা বলছেন, নির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকলে প্লাজমা ডোনেটের ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির সক্ষমতা ও তার রক্তে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না, এই বিষয়গুলোসহ অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এর জন্য মানসম্পন্ন কিছু টেস্টিং প্রটোকল দরকার। প্লাজমা থেরাপি বর্তমানে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর্যায়ে রয়েছে, করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নয়।
অধ্যাপক খান বলেন, ‘বাংলাদেশে সঠিকভাবে স্ক্রিনিং ও পরীক্ষা না করে যেভাবে প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হচ্ছে, এটি সম্পূর্ণ অনৈতিক।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাজমা থেরাপি নিরাপদ বলে বিবেচনা করা ও এটি প্রয়োগের আগে বেশ কিছু বিষয় নিশ্চিত হতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ: দেশের ১৪ শতাংশ মানুষ জানিয়েছে, তাদের রক্তে অন্য ভাইরাসের সংক্রমণ রয়েছে। সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করে, বাছবিচারহীনভাবে প্লাজমা থেরাপি দেওয়াটা রোগীর জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এর জন্য এইচআইভি এবং হেপাটাইটিস বি ও সি টেস্ট করাতে হবে। অন্যথায় ডোনার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
অবশ্য, এক্ষেত্রে রক্তে অ্যান্টিবডির পরিমাণও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যদি রক্তে অ্যান্টিবডির পরিমাণ ৮০ শতাংশ না হয়, তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটিই বৃথা হবে।
প্লাজমা ডোনেশনের ক্ষেত্রে করোনা থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া এবং আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় নেগেটিভ আসার পর থেকে ১৪ দিন পার হতে হবে। এক্ষেত্রে অ্যালাইজা টেস্টও (যার মাধ্যমে প্লাজমা-নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি টেস্ট করা হয়) করতে হবে। যাতে ডোনারের রক্তে পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না, তা জানা যায়।
যদিও সরকার গত ২১ জুন দেশে প্লাজমা-নিউট্রালাইজিং টেস্টের অনুমোদন দিয়েছে, তবে, প্লাজমা-নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট এখনো দেশে ব্যাপকহারে পাওয়া যাচ্ছে না।
বিএসএমএমইউর ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শেখ সাইফুল ইসলাম শাহীন বলেন, ‘বর্তমানে কেবল ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য প্লাজমা থেরাপির অনুমোদন রয়েছে। রোগীদের চিকিৎসায় নয়।’
‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর প্লাজমা থেরাপি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পাশাপাশি প্লাজমা থেরাপির জন্য অ্যান্টিবডি টেস্টের সক্ষমতাও বর্তমানে আমাদের নেই’, বলেন তিনি।
বিএসএমএমইউতে চলমান এমনই এক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নেতৃত্বে রয়েছেন ডা. শাহীন। তিনি আরও বলেন, ‘ডোনারের রক্তে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না, এটি পরিমাপ করা অত্যাবশ্যক। যদি ডোনারের রক্তে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে না থাকে, তাহলে এটি রোগীর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ফলে হালকা থেকে মারাত্মক অ্যালারজিক রিঅ্যাকশন হতে পারে। যা রোগীর জীবনকে বিপন্ন করতে পারে।’
করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা রেনডমাইজড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছি। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফল পাওয়ার পরেই আমরা গাইডলাইন প্রণয়নের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব। বর্তমানে অনেক কিছু না জেনেই মানুষকে প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হচ্ছে। যা ঝুঁকিপূর্ণ।’
‘মহামারিকালে গুরুতর অসুস্থ বা সংকটাপন্ন রোগীদের ক্ষেত্রে গবেষণামূলক চিকিৎসা হিসেবে কনভালসেন্ট প্লাজমা ট্রান্সফিউশন করা হয়’, বলেন তিনি।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘দেশের সংকটময় মুহূর্তে হাসপাতালগুলো নৈতিকতার সঙ্গেই গুরুতর অসুস্থ রোগীদের প্লাজমা থেরাপি দিচ্ছে।’
প্লাজমা থেরাপির বৈশ্বিক চিত্র
বিশ্বের অনেক দেশই প্লাজমা থেরাপির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়েছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্লাজমা থেরাপির জন্য নির্দিষ্ট গাইডলাইন রয়েছে। যেমন: প্লাজমা থেরাপি দেওয়ার আগে সিবিসি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট), হেপাটাইটিস বি ও সি, এইচআইভি, ম্যালেরিয়া ও সিফিলিসসহ বেশ কিছু ল্যাবরেটরি টেস্ট করতে হয়।
তাদের গাইডলাইনে বলা আছে, কোভিড-১৯ সিরামে নির্দিষ্ট ইমিউনোগ্লোবিউলিন জি ৮০ শতাংশেরও বেশি থাকতে হবে।
১৮ থেকে ৬০ বছর বয়স এবং শারীরিক ওজন ৫০ কেজির নিচে নয়— ভারতে শুধু এমন ব্যক্তিরা প্লাজমা ডোনেট করতে পারবেন। তবে, যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা ক্যানসারের মতো কোমরবিডিটি রয়েছে, তারা ডোনেট করতে পারবেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) করোনা রোগীদের চিকিৎসায় এখনো প্লাজমা থেরাপির অনুমোদন দেয়নি।
তবে, স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহকারীদের জন্য এফডিএ’র প্রণয়ন করা গাইডলাইনে প্লাজমা থেরাপির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে, এক্ষেত্রে যারা গুরুতর অসুস্থ বা যাদের অবস্থা সংকটাপন্ন, তাদের এই ট্রায়ালের আওতায় না আনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
Comments