বাংলাদেশের মহামারি: করোনা না দুর্নীতি?
কোভিড-১৯ প্রতিরোধে চীনা কোম্পানির তৈরি করা টিকার ট্রায়ালের অনুমোদন পেয়েছে আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)। গতকাল রোববার বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ সেন্টার (বিএমআরসি) এই অনুমোদন দিয়েছে। এটি হবে চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোভাক রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের উদ্ভাবিত কোভিড-১৯ টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল।
বাংলাদেশে করোনার প্রতিষেধক টিকার ট্রায়াল কতটা আশার আলো দেখাচ্ছে, এর ইতিবাচক বা নেতিবাচক দিক এবং করোনাকালেও আলোচনায় দুর্নীতি— এসব বিষয়ে দুই জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।
বাংলাদেশে করোনার টিকার ট্রায়ালের বিষয়ে প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ‘বর্তমানে টিকাটির চূড়ান্ত ধাপের ট্রায়াল হবে। তার মানে এর আগে আরও দুইটি ধাপ পার হয়েছে। চূড়ান্ত ধাপের ট্রায়ালটি আমাদের দেশেও হবে। সরকারও সেই লক্ষ্যে ইতোমধ্যে আইসিডিডিআর,বিকে ট্রায়ালের জন্য অনুমতি দিয়েছে। সব মিলিয়ে আমার মনে হয় ট্রায়ালটি করে দেখা যেতে পারে। তবে, এক্ষেত্রে অবশ্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইন মেনে চলতে হবে। আর ট্রায়ালটি তো তাদের দেশেও (চীন) হচ্ছে, আরও কিছু দেশেও হয়তো হবে। এক্ষেত্রে আমার মনে হচ্ছে ট্রায়ালটি ভালোই হবে।’
‘এখন টিকাটিতে কতটুকু উপকার হবে কিংবা কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় কি না, ট্রায়াল না করে তো সেটা বোঝা যাবে না। তবে, এটি যদি মানবদেহে আসলেই কার্যকর হয়, তাহলে তো এটি উৎপাদনের পর বাংলাদেশেও সরবরাহ করা হবে। এতে আমাদের মানুষ উপকৃত হবে। আর যেহেতু এখন টিকাটির চূড়ান্ত ধাপের ট্রায়াল হবে, তাই আমার মনে হয় খুব বেশি একটা অসুবিধা হবে না। তবে, কয়েকদিন গেলে এটা নিয়ে আরও ভালোভাবে আমরা বুঝতে পারব। কয়েক হাজার লোকের ওপর তো ট্রায়াল করা হবে। তখন বোঝা যাবে এটি কতটুকু কার্যকর। এখন এই কাজটা তো করতেই হবে। সব মিলিয়ে এই ব্যাপারে আমি আশাবাদী’, বলেন তিনি।
করোনাকালেও আলোচনায় দুর্নীতি— এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি তো আমাদের এখানে নতুন নয়। এটা তো যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। দুর্নীতি তো আমাদের যেকোনো বিভাগের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। দুর্নীতি আগেও ছিল, এখনো আছে। এর মধ্যেই করোনা ঢুকেছে। দুর্নীতি তো পুরনো, করোনা নতুন। করোনা ছাড়াও ঘূর্ণিঝড়-বন্যাসহ যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় কিংবা দুর্ঘটনা, কয়েকদিন আগেই তো লঞ্চডুবি হলো, এর সব ক্ষেত্রেই তো অনিয়ম। এগুলো সবই তো পুরনো। শুধু করোনাটাই নতুন করে এসেছে। এখন যেগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তা নিয়ে বলব, মাত্র কয়েকটি ধরা পড়েছে। এরকম তো আরও ভুরি ভুরি রয়েছে।’
মহামারি সমেয় দুর্নীতি বেড়েছে কি না, জানতে চাইলে অধ্যাপক আবদুল্লাহ বলেন, ‘যাদের দুর্নীতি নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে, এটা কি এক দিনে হয়েছে? আগে থেকেই তো এগুলো চলে আসছে। ধাপে ধাপে এগুলো উন্মোচন হয়েছে এবং মানুষ জানতে পেরেছে। কিন্তু, (দুর্নীতি) হয়ে আসছে তো আগে থেকেই। আমার মনে হচ্ছে, দুর্নীতি তো আরও প্রচুর হারে রয়ে গেছে।’
এক্ষেত্রে আরও সোচ্চার হওয়ার প্রয়োজন কি না, প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন এক্ষেত্রে জনগণ সোচ্চার হয়ে কী লাভ? যাদের ক্ষমতা আছে, তাদেরকে সোচ্চার হতে হবে। যাদের দায়িত্ব, তাদেরকে কাজটি করতে হবে। সাধারণ মানুষ, অর্থাৎ আপনি-আমি তো চাইলেই কিছু করতে পারব না। আমরা ঘৃণা-উদ্বেগ-দুঃখ প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু, তাতে লাভ কী? এখন যাদের হাতে দায়িত্ব, তারা নিজেরাই তো দুর্নীতিগ্রস্ত। তারা যদি দুর্নীতি নির্মূল না করে, তারা নিজেরা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তো দুর্নীতি থেকে রেহাই হবে না।’
‘এই যে যারা করোনা সার্টিফিকেট নিয়ে জালিয়াতি করল, পরীক্ষা না করে পজিটিভ বা নেগেটিভ রিপোর্ট দিলো, তাদের পৃষ্ঠপোষকরা তো রয়ে গেছে। এখন তাদের বিরুদ্ধেও যদি ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে তো কোনো লাভ হবে না। তাই যারা ক্ষমতায় আছে, তাদেরকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। এখন সর্ষের ভেতরে ভূত থাকলে কীভাবে হবে? একের পর এক ঘটনা ঘটে, আলোচনা হয়, মানুষ কয়দিন পর ভুলে যায়। এই যে মিডিয়ায় এত লেখালেখি হচ্ছে, কাজের কাজ কি আসলে হচ্ছে? কয়দিন হয়তো “আইওয়াশ” হয়, তারপর আবার যেই সেই। দুর্নীতির মূল তো অনেক গভীরে। সেটাকে যদি উৎখাত করা না যায়, তাহলে তো এটি নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। তাই দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে, বহির্বিশ্বে সুনাম রক্ষার স্বার্থে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা দুর্নীতি করছে, আইনের আওতায় এনে যেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। যাতে অন্যান্যরাও আর দুর্নীতি করতে সাহস না পায়। তা ছাড়া, কোনো বিকল্প নেই। এটি নির্মূল হয়তো হবে না। তবে, যতটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়’, যোগ করেন ডা. এবিএম আবদুল্লাহ।
বাংলাদেশে করোনার টিকার ট্রায়ালের বিষয়ে ডব্লিউএইচও’র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘আমাদের এখানে স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর টিকাটির ট্রায়াল করা হবে। এখন এখানে আমাদের সুবিধা হলো— টিকাটি যখন বাজারে আসবে, তখন আমরা প্রায়োরিটি পাব। কারণ, আমরা এটার ট্রায়াল পার্টনার। এটাকে সলিডারিটি ট্রায়াল বলে। ফলে চীন যদি টিকাটি উৎপাদন করে, সেক্ষেত্রেও আমরা প্রায়োরিটি পাব। আরেকটা হতে পারে রয়্যালটি নিয়ে আমরা আমাদের দেশেই এটি উৎপাদন করতে পারি। এসব কারণে জনগণ উপকৃত হবে। টিকাটি তাদের জন্য সহজলভ্য হবে এবং মূল্যও নাগালের মধ্যেই থাকবে। সরকারের ব্যয়ও কমবে।’
টিকাটির কার্যকারিতা নিয়ে আপনি কতটুকু আশাবাদী?, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন তো টিকাটির ট্রায়ালের চূড়ান্ত ধাপ। এটাতে শুধু আমরা দেখবো যে যাকে টিকাটি দেওয়া হচ্ছে, তার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে কি না। ক্ষতিকারক কিছু আছে কি না। এর আগে প্রমাণিত হয়েছে এটি ক্ষতিকারক না। কিন্তু, এখন চূড়ান্ত ধাপ। এটাতেও যদি ক্ষতিকারক না বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে এই টিকাটি বাজারে আসবে।’
ট্রায়াল চলাকালে কী কী বিষয় বা নির্দেশনা বিবেচনায় রাখা দরকার?, জানতে চাইলে ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, ট্রায়াল চলাকালে যাতে কোনো ধরনের ছলচাতুরী না হয়, তা খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, এটা জীবন-মরণের ব্যাপার। যার ওপর টিকাটির প্রয়োগ করা হবে, তাকে প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে এবং তাকে মনিটরিং করতে হবে। এসব বিষয়গুলো যাতে ঠিকভাবে হয়, এটা দেখার বিষয় আইসিডিডিআর,বির। এই প্রতিষ্ঠানের ওপর জনগণেরও আস্থা রয়েছে। আইসিডিডিআর,বিকে এই দায়িত্ব দেওয়াটা একটা সঠিক সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
‘যেহেতু এটি টিকাটির চূড়ান্ত ধাপের ট্রায়াল, সব মিলিয়ে এর সফলতায় আমি সম্পূর্ণ আশাবাদী। আমার মনে হয়, যদি আমরা সঠিকভাবে সফলতার সঙ্গে ট্রায়ালটি সম্পন্ন করতে পারি, তাহলে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের সুনামও বয়ে আসবে’, বলেন তিনি।
মহামারিকালেও প্রকট আকারে সামনে এসেছে দুর্নীতি। সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ও দুর্নীতি। এখন বাংলাদেশে মূল সমস্যা করোনা নাকি দুর্নীতি?— এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি আলোচিত বিষয় হতে পারে। কিন্তু, করোনাই আমাদের জন্য এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। করোনার জন্যই তো এই সময়কার দুর্নীতিগুলো হচ্ছে। করোনা না থাকলে তো এই সময়কার দুর্নীতিগুলো হতো না। তবে, আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যে দুর্নীতিগ্রস্ত, এটা বাংলাদেশের মানুষ আগে থেকেই জানে। এখন বহির্বিশ্বও জানছে। এখন সারাবিশ্ব জানছে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত। তবে, আমি মনে করি, দুর্নীতির চেয়ে করোনার দিকেই এখন আমাদেরকে বেশি নজর দিতে হবে। করোনার সংক্রমণটা দেশব্যাপী ছড়িয়েছে। এটাকে নিয়ন্ত্রণে আনাটা এখন সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব।’
‘তবে, যেহেতু আমাদের পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাটা দুর্নীতিগ্রস্ত, তাই প্রথমত পুরো ব্যবস্থাপনাটা সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে। দ্বিতীয়ত, এখানে যেই মনিটরিং, ইভালুয়েশন ও সুপারভিশন ব্যবস্থাটা আছে, এই ব্যবস্থাটাকে জোরদার করতে হবে। আর তৃতীয়ত, প্রতিটি জায়গায় এখন দুর্নীতি বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবেন। তবে, আমি মনে করি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যসচিব যদি দুর্নীতিমুক্ত থাকেন, তাহলে অধিকাংশ দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে’, যোগ করেন অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক।
Comments