৬ মাস পর কৃষক নরেন্দ্র জানলেন তার জমি বিক্রি হয়েছে!
জমিতে আমন ধানের চারা লাগাতে গিয়ে ৮০ বছর বয়সী কৃষক নরেন্দ্র নাথ রায় জানতে পারলেন তার ৬৪ শতাংশ জমি বিক্রি হয়ে গেছে। তাৎক্ষণিক এ খবর ছড়িয়ে পড়লে গ্রামবাসীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অসুস্থ হয়ে পড়েন কৃষক নরেন্দ্র নাথ। ঘটনাটি ঘটেছে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়নের গোপালরায় গ্রামে।
জালিয়াতির মাধ্যমে একই গ্রামের মৃত নূর ইসলামের ছেলে রুহুল আমিন (৪৮) জমির দলিল করে নিয়ে জোরপূর্বক জমিটি দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ করেন নরেন্দ্র নাথ। তিনি বলেন, ‘রুহুল আমিনের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত আছেন দলিল লেখক আব্দুল্লাহ আল মামুন ও সাব-রেজিস্ট্রার পরিতোষ অধিকারী।’
কৃষক নরেন্দ্র নাথ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমি ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারি না। আমি রুহুলের কাছে কোনো জমি বিক্রি করিনি। উপজেলা সাব রেজিস্ট্রি অফিসেও যাইনি। দলিলের শনাক্তকারী তিন জনের কাউকেই চিনি না। আমি যদি জমি বিক্রি করতাম, তাহলে আমার সন্তান, আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসী অবশ্যই সেটি জানত। তা ছাড়া, আমার জমি বিক্রির কোনো প্রয়োজনও নেই।’
জানা গেছে, চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি স্থানীয় কালীগঞ্জ উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিলটি সম্পাদন করা হয়। যার বহি. নম্বর ১ এবং দলিল নম্বর ২০৪। দলিলটি সম্পাদন করেন দলিল লেখক আব্দুল্লাহ আল মামুন। আর দলিলটি পাস করে দেন সাব-রেজিস্ট্রার পরিতোষ অধিকারী।
কৃষক নরেন্দ্র নাথের ছেলে স্বপন রায় বলেন, ‘দলিলের বিষয়ে আমরা কিছুই শুনিনি। গত ৩ জুলাই জমিতে আমন ধানের চারা লাগাতে গেলে রুহুল আমি ও তার লোকজন আমাদের বাধা দেয়। তারা জানায়, রুহুল এ জমি কিনেছেন এবং তিনিই এখন এই জমির মালিক। সে সময় তারা জমিতে লাগানো ধানের চারা তুলে ফেলে দেয়। পরদিন (৪ জুলাই) আমরা কালীগঞ্জ থানায় এ ব্যাপারে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করি।’
নরেন্দ্র নাথের স্ত্রী শেফালী রানী বলেন, ‘জালিয়াতির মাধ্যমে জমির দলিলের ঘটনা শুনে আমার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার শরীরের অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। আমরা কৃষক পরিবার। ৬৪ শতাংশের আবাদি জমি যদি প্রতারক রুহুল তার দখলে নিয়ে নেয়, তাহলে আমরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ব।’
স্থানীয় কৃষক বাদশা মিয়া বলেন, ‘রুহুল আমিন একজন প্রতারক। এর আগে তিনি অন্যের জমি প্রতারণার মাধ্যমে দলিল করে নেওয়ার অপচেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি একটি চায়ের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। সামান্য আয়ে তিনি ঠিকমতো সংসারও চালাতে পারেন না। সেখানে ৬৪ শতাংশ জমি কেনার কোনো সামর্থ্যই তার নেই। রুহুল সম্পূর্ণ প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে জালিয়াতি করে কৃষক নরেন্দ্র নাথের জমি দলিল করে নিয়েছেন।’
শামসুল ইসলাম নামে আরেক গ্রামবাসী বলেন, ‘রুহুল যদি জমি কিনে থাকেন, তাহলে গ্রামবাসী কেন জানল না? তা ছাড়া, কেনই বা জমির দলিলের বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছিল? জমি কেনার মতো সামর্থ্য রুহুলের নেই। তিনি প্রতারণা করেছেন।’
স্থানীয় কাকিনা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আতাউজ্জামান রনজু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘রুহুলের বিরুদ্ধে গ্রামে প্রতারণার অনেক অভিযোগ রয়েছে। কৃষক নরেন্দ্র নাথ রুহুলের কাছে জমি বিক্রি করেছে, এমনটি গ্রামের কেউই জানেন না।’
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত রুহুল আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমি নরেন্দ্র নাথের কাছ থেকে জমি কিনেছি এবং কাগজই তার প্রমাণ।’
দলিল লেখক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘যথাযথ নিয়মে আমি দলিল সম্পাদন করেছি। জালিয়াতির মাধ্যমে দলিল সম্পাদন করার কোনো সুযোগ নেই।’
বিষয়টি নিয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার পরিতোষ অধিকারীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তো অনেকদিন আগের ব্যাপার, তাই ঠিক মনে পড়ছে না। আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’
কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজ্জাদ হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এ ঘটনায় থানায় জিডি করা হয়েছে। কৃষক নরেন্দ্র নাথ তার জমি রুহুল আমিনের কাছে বিক্রি করেছেন— এমনটি গ্রামবাসীদের কেউই বলতে পারছেন না বা শোনেননি। ঘটনাস্থলে যেন আইনশৃঙ্খলা লঙ্ঘন না হয়, সেজন্য উভয় পক্ষকেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।’
‘এ ব্যাপারে সমাধান দেবেন আদালত। ভুক্তভোগীরা আদালতের আশ্রয় নিয়ে ন্যায়বিচার চাইতে পারে’, যোগ করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে ন্যায়বিচার পেতে আদালতের শরণাপন্ন হবেন বলেও জানিয়েছেন কৃষক নরেন্দ্র নাথ।
Comments