ভোট কারচুপিতে অভিযুক্ত সেই ঢাবি শিক্ষকের ‘পদাবনতি’ কতটা যথার্থ?

• তদন্ত কমিটির কাছ থেকে ঠিক যেভাবে সুপারিশ এসেছে, এরপর কোথাও কেউ আর কোনো ধরনের বাড়তি-কমতি করেনি। তদন্ত কমিটির সুপারিশের আলোকে যেই সিদ্ধান্ত, সেগুলোই গৃহীত হয়েছে: অধ্যাপক আখতারুজ্জামান, উপাচার্য
• তাদেরকে শাস্তি হিসেবে আবাসিক শিক্ষক থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ আমরা করেছিলাম। সেটা তো সিন্ডিকেট শোনেনি: অধ্যাপক ড. খন্দকার বজলুল হক, তদন্ত কমিটি প্রধান
• পদাবনতি দেওয়ার প্রভিশনটা (বিধান) বিশ্ববিদ্যালয়ে আগেও চর্চা হয়েছে: অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী, প্রক্টর
• এটা তো নৈতিকতার স্খলন এবং নৈতিকতার স্খলন হলে তো চাকরিই থাকার কথা না: অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
• যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেনি, এখন শিক্ষার্থীরা তাকে বর্জন করে ব্যবস্থা নিতে পারে: নুরুল হক নুর, ডাকসুর সদ্য সাবেক ভিপি
দীর্ঘ ২৮ বছর পর গত বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন চলাকালে বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে বাক্সভর্তি সিলযুক্ত ব্যালট পেপার পাওয়ার ঘটনায় সাময়িক অব্যাহতিতে থাকা হলটির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ শবনম জাহানকে পদাবনতি করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পদাবনতি করে শবনম জাহানকে ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক থেকে সহকারী অধ্যাপক করা হয়েছে।
ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির মতো গুরুতর অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, তার শাস্তি পদাবনতি হওয়াটা কতটা যথার্থ? অভিযোগ তদন্তে সংশ্লিষ্ট কমিটি কতটুকু সত্যতা পেয়েছে? পদাবনতির মতো সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি কোথায় দাঁড়াল? কিংবা একজন শিক্ষকের নৈতিক স্খলনটা যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে তিনিই আবার শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেবেন, এটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য— এসব বিষয়ে ঢাবি উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান, ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী, এ ঘটনার তদন্ত কমিটির প্রধান আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগের অধ্যাপক ড. খন্দকার বজলুল হক, ঢাবির আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন ও ডাকসুর সদ্য সাবেক সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নুরের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।
ভোট জালিয়াতির মতো অনিয়মের ঘটনায় শাস্তি হিসেবে পদাবনতি হওয়াটা কতটা যথার্থ?— জানতে চাইলে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, 'আমাদেরকে পদ্ধতিগতভাবে এগোতে হয়। সেটি হলো— প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে একটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আমি গতকাল পেয়েছি এবং তা সিন্ডিকেটকে দিয়েছি। তদন্ত কমিটির কাছ থেকে ঠিক যেভাবে সুপারিশ এসেছে, এরপর কোথাও কেউ আর কোনো ধরনের বাড়তি-কমতি করেনি। তদন্ত কমিটির সুপারিশের আলোকে যেই সিদ্ধান্ত, সেগুলোই গৃহীত হয়েছে। আমাদের এখানে নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে যেভাবে করতে হয়, সেভাবেই করা হয়েছে।'
'আমাদের এখানে অনিয়ম করে কেউ পার পায় না। যেদিন ঘটনাটা ঘটলো, এটা ছিল হল ইউনিয়নের নির্বাচন সংক্রান্ত, তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে কমিটি করা হয়েছিল। তখন সিন্ডিকেট একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারপর তদন্ত কমিটি, যেটি আইন অনুযায়ী করতে হয়, সেটি করা হলো এবং সেই কমিটির সুপারিশের আলোকেই এই ব্যবস্থাটা নেওয়া হলো। এখানে একটি বিষয় সংযোজিত হয়েছে। তা হলো— রিটার্নিং অফিসার হিসেবে যে দুই জন আবাসিক শিক্ষক ছিলেন, তাদেরকেও সতর্ক করা হয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে তাদের দায়িত্ব পালনে কোনো ব্যত্যয় না ঘটে', বলেন তিনি।
কিন্তু, অভিযোগ যতটা গুরুতর, সেই তুলনায় শাস্তি দেওয়া নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে যখন যতটুকু ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় কখনো শৈথিল্য করবে না। আমাদের নিয়ম-নীতির মধ্যে থেকে সেখান থেকে যার যতটুকু আসুক, সেখান থেকে কেউ পার পায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কতগুলো নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পদ্ধতি অনুসরণ করে যেকোনো ব্যবস্থা নিতে হয়। ঠিক সেটিই বিশ্ববিদ্যালয় করেছে। সেখানে কোনো তরফ থেকে কোনো ঘাটতি, কোনো শৈথিল্য, কোনো কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বরদাশত করে না। আমাদের প্রশাসন এগুলো খুব শক্তভাবে দেখে। যার যতটুকু অপরাধ, অন্যায় করলে সেগুলোর জন্য যে নিয়মতান্ত্রিক উপায় আমাদের এখানে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এটিই হলো আমাদের সবচেয়ে বড় বার্তা।'
একজনের শিক্ষকের করা এমন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে যে শাস্তি দেওয়া হলো, এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমন ভাবমূর্তি তৈরি হলো?— জানতে চাইলে ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, 'সেই বিষয়টা তো আপনারা বলতে পারবেন। এই ঘটনায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তটা কেমন হয়েছে, সেটা আপনারা বলতে পারবেন।'
জনমনে একটি প্রশ্ন থেকে যায় যে এরকম অপরাধের শাস্তি হিসেবে পদাবনতি দেওয়াটা যথার্থ কি না, এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আসলে এই মুহূর্তে এই ব্যাপারে মন্তব্য করা আমার পক্ষে সম্ভব না। কারণ, তদন্ত কমিটি যে তথ্য-উপাত্ত পেয়েছে, সেই আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট শাস্তি দিয়েছে। সুতরাং এই বিষয়ে আপনার বিস্তারিত জানার থাকলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট যারা আছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। আসলে তদন্তে না থেকে বাইরে থেকে মন্তব্য করলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট কাজ করেছে। আমি শুধু বলতে পারি পদাবনতি দেওয়ার প্রভিশনটা (বিধান) বিশ্ববিদ্যালয়ে আগেও চর্চা হয়েছে।'
এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির নেতৃত্বে থাকা ঢাবির আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগের অধ্যাপক ড. খন্দকার বজলুল হক বলেন, 'আমাদের কমিটির তো সুপারিশ ছিল। কিন্তু, এটার ফিগার বডি হচ্ছে সিন্ডিকেট। সুপারিশের ক্ষেত্রে তারা (সিন্ডিকেট) তা হুবহু নিতেও পারে বা আংশিক নিতে পারে অথবা পুরোটাই নাও নিতে পারে। আমি শুনেছি আমরা শবনম জাহানকে পদাবনতির সুপারিশ করেছিলাম, সিন্ডিকেট সেটাই গ্রহণ করেছে। তবে, সুপারিশে দেওয়া শাস্তিটা কম হয়েছে বলে তা বাড়ানো কিংবা বেশি হয়েছে বলে তা কমানোর অধিকার সিন্ডিকেটের ছিল। সেটা তারা করেন নাই। এখন বর্তমানে এটা নিয়ে রিঅ্যাক্ট করতে পারেন ভিসি। সিন্ডিকেটের পরে তিনিই এটি করতে পারেন।'
বলা হচ্ছে, তদন্ত কমিটির সুপারিশের আলোকেই এই ব্যবস্থাটা নেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে তদন্তে আপনারা কী পেলেন বা শাস্তিটা যথাযথ হলো কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এখানে প্রথম কথা হলো— শবনম একা এরকম একটা বিশেষ দল বা ছাত্রী, তাকে জেতানোর জন্য একটা পরিকল্পনা করেছে? দ্বিতীয়ত— সেটা কী তিনি নিজেই বাস্তবায়ন করেছেন? এটা কী সম্ভব? তিনি তো প্রাধ্যক্ষ। নির্বাচনে লিখিতভাবে কিন্তু তার কোনো নির্দিষ্ট দায়িত্বও ছিল না। দায়িত্ব ছিল দুই জন আবাসিক শিক্ষকের। তাদের একজনের দায়িত্ব ছিল হলের নির্বাচন দেখার জন্য, আরেকজনের ডাকসুরটা দেখার জন্য। প্রাধ্যক্ষ হিসেবে সার্বিক একটা দায়িত্ব তার ছিল। কিন্তু, নির্দিষ্ট কোনো দায়িত্ব ছিল না। তার অপরাধটা আমরা যেভাবে দেখেছি, এই কাজটা আসলে ছাত্রীরা করেছে। যাদের দল আছে, জিততে হয়, তারা এই কাজটা করেছে।'
'এখানে প্রশ্ন ছাত্রীরা চাবি পেল কোথায়? চাবি তো যে দুই জন দায়িত্বে ছিলেন, তাদের কাছে ছিল। আমাদের তদন্তে দেখা গেছে, চাবি যদিও তাদের কাছেই ছিল, কিন্তু, তিনি (শবনম) কিছু একটা বলে চাবিটা নিয়ে গেছেন। এখন ছাত্রীদের চাপ বা যেকোনো কারণেই হোক তিনি এটা করেছেন। কিন্তু, তিনি এটার পরিকল্পনা করেননি। তার পক্ষে একা এটা করা সম্ভব না। এখন চাবিটা যেহেতু তার কাছে ছিল, তার কাছ থেকে ছাত্রীরা নিয়েছে, এখন তিনি ভিসি বা যিনি নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন, তাকে জানাতে পারতেন। কিন্তু, তিনি (শবনম) সেটি করেননি। এক্ষেত্রে হয়তো তিনি চাপটা নিতে পারেননি, অথবা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সাহায্য করেছেন। একটা হলো পরিকল্পনা করা, আরেকটা হলো বাস্তবায়নে সাহায্য করা। এটা বোঝা গেছে যে বাস্তবায়নে তিনি সাহায্য করেছেন। তা না হলে ছাত্রীরা কী করছে, সেটি তিনি জানাতে পারতেন। সেটা করলে তো তার শাস্তিই পেতে হতো না। এই যে তিনি জানালেন না, এর জন্য আমাদের মনে হয়েছে চিরদিনের জন্য চাকরি থেকে সরানো, এটা বেশি। তিনি শিক্ষক এটা ঠিক। কিন্তু, কাজটা তো করেছে ছাত্রীরা। তারাও তো আগামীদিনে শিক্ষক হবে। তাদের তো আমরা কিছু করতে পারব না। তাদের বিচারের কোনো ব্যবস্থা তো নেই', বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'এক্ষেত্রে একেবারে তাকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়াটা মনে হয় বেশি হয়ে যেত। আদালতে গেলেও এটা টিকতো না বলে আমাদের মনে হয়েছে। কারণ, এত বড় একটা ঘটনা, তিনি একা তো করতে পারেন না। এই জন্য মাঝামাঝি একটা শাস্তি আমরা দিয়েছি। তবে, চূড়ান্ত কথা হলো সিন্ডিকেট চাইলে কিন্তু শাস্তিটা বাড়াতে পারতেন। তারা চাইলে আমাদের সুপারিশ নাও নিতে পারতেন। তবে, এখন আমাদের মনে হয়েছে, আমাদের ভাবনার সঙ্গে সিন্ডিকেটের ভাবনা মিলে গেছে। কিন্তু, আমরা (তদন্ত কমিটি) সুপারিশ করেছি বলে সিন্ডিকেট এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটা বললে তো হয় না। এক্ষেত্রে আমরা ছেড়ে দিলে (শাস্তি না দিলে) কি তারাও ছেড়ে দিতেন?'
তবে বলা হয়েছে, তদন্ত কমিটির সুপারিশের আলোকেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ড. খন্দকার বজলুল হক বলেন, 'কোনা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এটা বলতে পারে? মানুষ উচ্চ আদালতে কেন যায় তাহলে? উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের দেওয়া রায় যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পর্যালোচনার মাধ্যমে রায় দেন। নিম্ন আদালত যেহেতু এই রায় দিয়েছে, এমন কথা উচ্চ আদালত কখনো বলেন না। আমার কাছে যেটা মনে হচ্ছে, এক্ষেত্রে আমাদের আর তাদের (সিন্ডিকেট) ভাবনা মিলে গেছে বলেই তারা এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। আমাদের সুপারিশে আরেকটা বিষয়ও তো ছিল। সেটা হচ্ছে— দায়িত্বে থাকা অপর যে দুই আবাসিক শিক্ষক, তাদেরকে আমরা শাস্তি দিয়েছিলাম। সিন্ডিকেট কিন্তু সেই সুপারিশ না নিয়ে তাদেরকে "সতর্ক" করেছে। সিন্ডিকেট বলেছে, প্রাধ্যক্ষ তাদের কাছে চাবি চেয়েছে, হয়তো ধমকও দিয়েছে, যেহেতু তিনি তাদের বস, তাই তারা চাবি দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু, তারাও তো ভিসি বা নির্বাচনের দায়িত্বে যিনি ছিলেন তাকে জানাতে পারতেন। তারা তো সেটা করেননি। তাদেরকে শাস্তি হিসেবে আবাসিক শিক্ষক থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ আমরা করেছিলাম। সেটা তো সিন্ডিকেট শোনেনি।'
'তাই আমরা যে সুপারিশ করেছি, সেটা হুবহু নেওয়া হয়নি। আমরা যেটা সেন্সিবল মনে করেছি, তারা (সিন্ডিকেট) সেটা সেন্সিবল মনে করেছেন। আমরা অন্যদের বেলায় যেটা মনে করেছি, তারা মনে করেছেন এটা ঠিক না। তারা (সিন্ডিকেট) তো এক্সিকিউটিভ বডি। তারা যেটা করেছে সেটাই তো চূড়ান্ত', বলেন তিনি।
ভোট কারচুপির মতো অপরাধে অভিযুক্ত শিক্ষককে পদাবনতি করা হলো। সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি কেমন হলো?— জানতে চাইলে ঢাবির আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, 'আমরা তো এখন আমাদের চারদিকে দেখছি যারা খারাপ কাজ করছে, তাদের পুরস্কৃত করা হয়। তারা আরও বড় পদ পেয়ে যায়। তো সেখানে শাস্তি হওয়াটা তো ভালো।'
একজন শিক্ষক এমন অনৈতিক কাজ করলেন, এক্ষেত্রে শাস্তিটা কতটা যথার্থ হয়েছে?— জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আসলে সেটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা, সরকার বা গণতন্ত্র সুস্থভাবে চলার জন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো দরকার, সেগুলো হচ্ছে— দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় সরকার, বিচারব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়, সংবাদপত্র। এখন আমাদের এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যেক জায়গাতে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। যেমন দেখেন, আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সাহেদ-সাবরিনার কর্মকাণ্ড শুধু দেশে না, বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করল। এখন একটা রাষ্ট্র তো ব্যক্তির ওপর নয়, প্রতিষ্ঠানের ওপর চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম ২৫ বছরে যে উঁচুমান অর্জন করেছিল, তার পরে ৪০, ৫০ বা ৬০ এর দশকের দিকেও কিছু ছিল, তারপর থেকে ধীরে ধীরে যে মানটা নামছে, সেটাতো খুব দুর্ভাগ্যজনক। দেখতে হবে ১০০ বছরে ঢাবির কতগুলো পাবলিকেশন, কতগুলো মৌলিক গবেষণা হয়েছে। একটা বিশ্ববিদ্যালয় তো চারটেখানি কথা নয়। তার শিক্ষা, গবেষণা, পাবলিকেশন, তার শিক্ষকদের নীতি-নৈতিকতা, সততা, পাণ্ডিত্য— এসব নিয়েই তো একটা বিশ্ববিদ্যালয়।'
একজন শিক্ষক যেভাবে জালিয়াতি করলেন, এটা অনৈতিক, বেআইনি নাকি অপরাধ? কীভাবে দেখেন আপনি?— প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আপনি আইন-আদালত বা নৈতিকতা বাদ দেন। প্রথমে একজন শিক্ষক তো এই কাজটি করতে পারেন না। আমাদের সমাজে শত শত বছর ধরে শিক্ষকদের যে সততা, পাণ্ডিত্যের মডেল তৈরি হয়েছে, একজন শিক্ষকের নৈতিকতার জায়গাটা তো এতটা দুর্বল হতে পারে না। দেখুন শিক্ষকদের নৈতিকতার জায়গাটা কতটা উঁচুতে থাকলে পার্লামেন্ট হওয়ার আগেই ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু নিজে অর্ডারটা করে গেলেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য যে পরিমাণ স্বাধীনতা তিনি দিয়েছিলেন। এখন সেই মর্যাদার জায়গাটা তো আমরা রাখতে পারিনি।'
'আসলে সব জায়গাতেই তো নৈতিকতার অবক্ষয় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ও তার বাইরে নয়। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হয়। তাদের মডেল মনে করা হয়। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই জায়গাটা দুর্বল হচ্ছে, আমরা ধরে রাখতে পারছি না', বলেন তিনি।
ভোট জালিয়াতির শাস্তি কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?— জানতে চাইলে অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, 'এইটা আসলে এখন বলতে পারব না যে আমাদের অর্ডারে কীভাবে লেখা আছে। তবে, এটা তো নৈতিকতার স্খলন এবং নৈতিকতার স্খলন হলে তো চাকরিই থাকার কথা না। একজন শিক্ষক যদি ভোট জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন এবং সেটা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তো সেটা নৈতিক স্খলন। এটা প্রমাণিত হলে তো তার কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। অনেক সময় হয়তো মানবিক কারণে চাকরিচ্যুত করা হয় না। একদম যৌন বিষয়ক বা এই ধরনের গুরুতর অভিযোগ না হলে হয়তো চাকরিচ্যুত করা হয় না। তবে কঠিন শাস্তি হওয়াটা বাঞ্ছনীয়।'
সেক্ষেত্রে শবনম জাহানকে দেওয়া শাস্তিটা যথাযথ কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আসলে সহযোগী অধ্যাপক থেকে সহকারী অধ্যাপকে পদাবনতি দেওয়াটাও শাস্তি হিসেবে কম বড় নয়। এর মধ্য দিয়ে সামাজিকভাবে তার ভাবমূর্তিও তো অনেক নিচে নেমে গেল। এ ছাড়া, পরবর্তীতে তার পদোন্নতি বা অন্যান্য ক্ষেত্রে তো এটা একটা কলঙ্ক হিসেবে থেকে যাবে। তাই এটাকে একদম ছোট শাস্তি বলা যাবে না। তবে, তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, একজন শিক্ষকের কাছ থেকে এটা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয় যে তিনি ভোট জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত থাকবেন।'
শিক্ষার্থীদের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়বে কি না, প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আসলে পড়ানোয় হয়তো কোনো প্রভাব পড়বে না। কিন্তু, এখানে তো অ্যাকাডেমিক আরও অন্যান্য বিষয় রয়েছে। এখানে যেহেতু নৈতিকতার বিষয় রয়েছে, সেক্ষেত্রে যদি এমন হয়, শিক্ষার্থীদের তিনি প্রাপ্য নম্বর ঠিকমতো দিচ্ছেন না, কিংবা কাউকে বেশি কাউকে কম দিচ্ছেন বা অর্থের বিনিময়ে কাউকে সুবিধা দেওয়া, সেসব ক্ষেত্রে নৈতিকতার বিষয়টা আসবে। যেহেতু তার নৈতিকতার জায়গাটা দুর্বল, তাই এ ধরনের প্রশ্ন আসতেই পারে।'
পদাবনতির বিষয়ে ডাকসুর সদ্য সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, 'আমাদের দেশে এরকম বাজে দৃষ্টান্ত রয়েছে যে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে নামেমাত্র শাস্তি দেওয়া হয়। যেমন পুলিশদের ক্ষেত্রে যদি দেখেন অনেক সময় সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। আমি মনে করি এগুলোর মাধ্যমে তাদেরকে পরবর্তীতেও খারাপ কাজের দিকে ধাবিত করা হয়। পরবর্তীতে সেটা অন্যদেরকে শক্ত বার্তা দেয় না। এখন ঢাবিতে দীর্ঘ ২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচন হলো, এই নির্বাচনটা ঘিরে মানুষের অন্যরকমের একটা প্রত্যাশা ছিল। সেখানে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক সরাসরি ভোট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত, মানে তার সহায়তায় ভোটের ব্যালট-বাক্স আগের রাতে ভরাট করে রাখা হয়েছে। এর মতো ঘৃণিত কাজ তো আর হতে পারে না। আমার মতে, তাকে তো শিক্ষকতা থেকেই অব্যাহতি দেওয়া উচিত ছিল। এখন একটা শো-অফ করতে হবে যে কোনো একটা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেটাই করা হয়েছে। কিন্তু, এটা তো শাস্তি না। দেখা গেল এখন পদাবনতি করেছে, আবার দেখা যাবে এক বছর পরেই সিন্ডিকেট তাকে আবার পদোন্নতি দিয়ে অধ্যাপক করে দেবে।'
'আরেকটা ব্যাপার, ডাকসু নির্বাচন হয়েছে এক বছর পেরিয়ে গেছে। ডাকসুর মেয়াদ থাকাকালে কেন এই ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? শুরু থেকেই আমি বলেছি যে এই নির্বাচনে অসংখ্য জালিয়াতি হয়েছে। সেটাকে আড়াল করার জন্যই কিন্তু বিষয়টাকে তখন আলোচনায় আনা হয়নি বা তখন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ডাকসুর মেয়াদও শেষ হয়েছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছ। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় এটা তো প্রমাণিত হয়েছে যে ডাকসু নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপি হয়েছে। এখন ঢাবি প্রশাসনের তো উচিত ছিল সেই নির্বাচনটা আবার দেওয়া। যা তারা সেই সময় করেনি। ঠিক মেয়াদ শেষ হলো, আর এই ব্যবস্থা নেওয়া হলো। এটার মাধ্যমে বর্তমানে ঢাবি প্রশাসনের যে পক্ষপাতমূলক আচরণ, নানা ক্ষেত্রে অসদাচরণ, তা আরও ফুটে উঠেছে।'
এরকম কাজ করেও তিনি আবার শিক্ষক হিসেবে বহাল থাকবেন, এটা কীভাবে দেখছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি মনে করি তিনি যদি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হন, তাহলে শিক্ষার্থীদের সামনে মুখ দেখাতে পারবেন না। শিক্ষক মানে সমাজ গড়ার কারিগর। সেখানে তিনি ভোট কারচুপি করেছেন। এর চেয়ে ঘৃণিত কাজ তো আর হতে পারে না। তিনি কোনো একটা সংগঠনের পক্ষে কাজ করেছে। তার তো নৈতিকতার বিচ্যুতি ঘটেছে। আমি মনে করি, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি, এখন শিক্ষার্থীরা তাকে বর্জন করে ব্যবস্থা নিতে পারে। ঢাবি শিক্ষার্থীরা এই কাজ এর আগে করে দেখিয়েছেও। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সেই মেরুদণ্ড নেই যে এই ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেবে। তাই আমি মনে করি শিক্ষার্থীরাই এখন শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারবে তাকে বর্জন করে। সেটাই হবে সবচেয়ে উত্তম দৃষ্টান্ত।'
একজনের শিক্ষক যেভাবে জালিয়াতি করলেন, এটা অনৈতিক, বেআইনি নাকি অপরাধ? কীভাবে দেখেন আপনি?— প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এটা তো আসলে এতটা গুরুতর অপরাধ। আর অপরাধ তো করে অনৈতিকতার জায়গা থেকে। ২৮ বছর পর হওয়া নির্বাচনে যেখানে পুরো জাতির প্রত্যাশা ছিল, মানুষ তো এখন ভোট দিতে যায় না, সেখানে এটা নিয়ে একটা আলাদা প্রত্যাশা ছিল যে আবার ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি হবে, জাতীয় রাজনীতিতেও ডাকসুর নির্বাচনের প্রভাব রয়েছে এবং পড়বে। একজন শিক্ষক হয়ে তিনি যে ধরনের কাজ করলেন, সেটা তো আসলে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না।'
এর শাস্তি কী হতে পারে বলে মনে করেন?— জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে থাকার যোগ্যতা তো এখন আর তার নেই। এটাকে (পদাবনতি) আমি শাস্তি মনে করি না। এটা শো-অফ করা হয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা নিয়েছে। এক বছর আগে নির্বাচন হলো, আর এক বছর মেয়াদ পার হওয়ার পর এসে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হলো। তখন ব্যবস্থা নিলে তো ডাকসু নির্বাচনটা প্রশ্নবিদ্ধ হতো, তাই এখন নেওয়া হলো। কিন্তু, ঢাবি উপাচার্য এর দায় তো এড়াতে পারেন না। তাকে (শবনম) তো চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া উচিত ছিল।'
'এই করোনাকালে আমরা যে অনিয়ম দেখছি, যারা এগুলো করেছেন, তাদের যে দৌরাত্ম্য, রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তাদের অবাধ বিচরণ, এমন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে অব্যাহতি দিয়ে একটা শক্ত বার্তা দিতে পারত জাতিকে। যার প্রভাব অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা অন্যান্য দুর্নীতিবাজদের মধ্যেও পড়ত। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে প্রশাসনের এই ধরনের সিদ্ধান্তে খুবই মর্মাহত হয়েছি এবং এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করছি। আমি আহ্বান জানাই, যাতে পরবর্তী সিন্ডিকেট ডেকে ওই শিক্ষকতে যেন অপসারণ করা হয়', যোগ করেন নুর।
ভোট কারচুপির দায়ে অভিযুক্ত শিক্ষক শবনম জাহানকে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে ফোন করা হলে তিনি 'সরি, আমি কথা বলতে পারব না' বলে ফোন রেখে দেন।
Comments