রায়হান তোমাকে স্যালুট

গ্রেপ্তার করে কী কখনো সত্য আটকে রাখা যায়? আটকে কী রাখা যায় তারুণ্যকে? কোনোদিনও যায় না। রায়হান কবির সম্পর্কে যতে জানছি, মুগ্ধতা বাড়ছে। মনে হচ্ছে, একটা প্রতিবাদের নাম এখন রায়হান কবির। তার পরিবার ও স্থানীয়রা বলছেন, ছোটবেলা থেকেই যেকোনো অনিয়ম দেখলে প্রতিবাদ করতেন রায়হান কবির। সুন্দর ও বৈষম্যহীন যে পৃথিবীর কথা আমরা বলি, রায়হান কবির তো তারই প্রতিনিধি।
মো. রায়হান কবিরকে গ্রেপ্তার করেছে মালয়েশিয়ার পুলিশ। ছবি: সংগৃহীত

গ্রেপ্তার করে কী কখনো সত্য আটকে রাখা যায়? আটকে কী রাখা যায় তারুণ্যকে? কোনোদিনও যায় না। রায়হান কবির সম্পর্কে যতে জানছি, মুগ্ধতা বাড়ছে। মনে হচ্ছে, একটা প্রতিবাদের নাম এখন রায়হান কবির। তার পরিবার ও স্থানীয়রা বলছেন, ছোটবেলা থেকেই যেকোনো অনিয়ম দেখলে প্রতিবাদ করতেন রায়হান কবির। সুন্দর ও বৈষম্যহীন যে পৃথিবীর কথা আমরা বলি, রায়হান কবির তো তারই প্রতিনিধি।

রায়হানকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। জানি না। কোনোদিন দেখাও হয়নি। কিন্তু, আল জাজিরার প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর গত এক মাস ধরে ঘটনাটার ওপর নজর রাখছিলাম। মালয়েশিয়া থেকে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি আমাকে জানাচ্ছিলেন, রায়হান কবির কোনো মিথ্যা বলেননি। কিন্তু, আল জাজিরার প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই বাংলদেশিরা ভয়ে ছিলেন।

গতকাল শুক্রবার হঠাৎ করেই হোয়াটস অ্যাপে একটা অচেনা নম্বর থেকে মেসেজ আসে। রায়হান কবির পরিচয় দিয়ে ছোট্ট একটা মেসেজে বলেন, ‘আমার অপরাধটা কী? আমি তো কোনো মিথ্যা বলিনি। প্রবাসীদের ওপর যে বৈষম্য ও নিপীড়ন চলেছে, আমি শুধু সেই কথাগুলো বলেছি। আমি চাই প্রবাসে থাকা কোটি বাংলাদেশি ভালো থাকুক। আমি চাই পুরো বাংলাদেশ আমার পাশে থাকুক।’

গতকাল সন্ধ্যা থেকেই মালয়েশিয়া প্রবাসীরা জানাতে থাকেন, রায়হান কবিরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার মানে গ্রেপ্তারের আগে রায়হান বুঝতে পেরেছিলেন। রাতে কয়েকজন প্রবাসীর ফেসবুক পেজে রায়হান কবিরের একটা ভিডিও সাক্ষাৎকার দেখলাম, যেটা গ্রেপ্তারের আগেই করা। সেখানেও রায়হান বলেছেন, তিনি শুধু অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন।

রায়হানকে নিয়ে কিছুদিন ধরেই যেহেতু খবর রাখছিলাম, প্রথমে বোঝার চেষ্টা করি তিনি কোনো আইন ভেঙেছিলেন কি না। এত বাংলাদেশি থাকতে তিনিই বা কেন প্রতিবাদ করেছিলেন? কারণ এক যুগেরও বেশি সময় অভিবাসন নিয়ে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তো এমন কোনো প্রতিবাদ বা গ্রেপ্তারের কথা শুনিনি। খোঁজ নিলাম রায়হানের বাড়িতে। ছেলেটি কেমন? তাতে মুগ্ধতা আরও বাড়ল।

রায়হানের বাড়ি বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে। বাবা-মা আর দুই ভাইবোনের পরিবার। স্থানীয়রা বলছেন, বন্দরে নিজ এলাকাতেও সবার কাছে প্রতিবাদী তরুণ হিসেবে পরিচিত রায়হান। এলাকার সবার বিপদে-আপদে পাশে থাকতেন। নিজের বই, অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন শিক্ষার্থীদের। এলাকায় মাদক চোরাকারবারের বিরুদ্ধে দারুণ সোচ্চার ছিলেন।

রায়হানের বাবা শাহ্ আলম নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পঞ্চবটি বিসিক শিল্প নগরীতে একটি রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানায় কাজ করেন। মা রাশিদা বেগম ছেলের চিন্তায় অসুস্থ। রায়হান কবির সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে মালয়েশিয়ায় পড়তে যান। বোন স্থানীয় একটি কলেজে বিএ পড়ছেন।

রায়হানের বাবা শাহ্ আলম বলছিলেন, ২০১৪ সালে রায়হান উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে মালয়েশিয়ায় পড়াশোনা করতে যান। সেখানে বিএ পাস করেন। ঈদুল ফিতরের আগে একটি কোম্পানিতে তার চাকরি হয়। সর্বশেষ দুই দিন আগে তার ছেলে রায়হানের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়েছিল।

শাহ্ আলম বলেন, ‘আমার ছেলে রায়হান ছোটবেলা থেকেই অন্যায়ের প্রতিবাদকারী। অভাবের কারণে আমি বাড়িতে একটা ছোট্ট মুদি দোকান দিয়ে সিগারেট বিক্রি করছিলাম। কিন্তু, তখন রায়হান বলেছিল, “বাবা সিগারেট বিক্রি করো না। এতে মানুষের ক্ষতি হয়”। এরপর সিগারেট বিক্রি বন্ধ করে দেই। ও (রায়হান) মালয়েশিয়ায় চাকরি করে পরিবারকে যেমন টাকা-পয়সা দিত, তেমনি এলাকার অনেক অসহায় মানুষের পাশেও থাকত। সবসময় ছেলেটা মানুষের ভালো চেয়েছে।’

রায়হান কবিরকে কেন গ্রেপ্তার করল মালয়েশিয়া? কারণ, গত ৩ জুলাই আল জাজিরার ইংরেজি অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে ‘লকডআপ ইন মালয়েশিয়ান লকডাউন-১০১ ইস্ট’ শীর্ষক একটি অনুসন্ধানী একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে মালয়েশিয়ায় থাকা প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি লকডাউন চলাকালে দেশটির সরকারের নিপীড়নমূলক আচরণের বিষয়টি উঠে আসে। সেখানে দেখানো হয়েছে, কর্মহীন ও খাবারের সংকটে থাকা অভিবাসী শ্রমিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে তাদের ঘর থেকে টেনে-হিঁচড়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অভিবাসী নারীদের তাদের ছোট ছোট শিশুদের থেকে আলাদা করে মারধর করা হচ্ছে।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে আরও অনেক দেশের নাগরিকদের পাশাপাশি রায়হান কবিরও সেখানে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। আর এতেই ক্ষুব্ধ হয় মালয়েশিয়া। রায়হান কবিরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। শুক্রবার সন্ধ্যায় তাকে গ্রেপ্তার করে মালয়েশিয়ান পুলিশ।

রায়হান তো কোনো মিথ্যা বলেনি। আমি সাংবাদিকতার জন্য অনেকবার মালয়েশিয়াতে গিয়েছি। এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ মালয়েশিয়া। রাস্তার দুই পাশে আকাশছোঁয়া সব অট্টালিকা, অসংখ্য ফ্লাইওভার, প্রশস্ত সব সড়ক দেখে মুগ্ধ হতে হয়। কিন্তু, সেখানে অভিবাসীদের প্রতি বিশেষত বাংলাদেশি অভিবাসীদের প্রতি মালয়েশিয়ার আচরণ বেশ হতাশাজনক। ১৬টি দেশের প্রায় ৩০ লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়ায় কাজ করেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে দুরবস্থায় থাকেন বাংলাদেশিরা।

আমি নিজে গিয়ে দেখেছি, সকাল থেকে সন্ধ্যা, কখনো কখনো রাত পর্যন্ত বাংলাদেশিরা কাজ করেন। এরপর কারখানার পেছনে বস্তির মতো অন্ধকার কতগুলো খুপরি ঘরে রাত কাটান তারা। থাকার ঘরগুলো দেখলে মনে হবে, কোনো উদ্বাস্তু শিবির কিংবা বন্দিশালার প্রকোষ্ঠ। আর যারা অনিয়মিত বা যাদের কাগজপত্র নেই, তাদের তো আতঙ্কের শেষ নেই।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বন্দিশিবিরগুলোর চিত্র কিছুটা দেখানো হয়েছে। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বন্দিশিবির ও কারাগারে সবসময় এক থেকে দেড় হাজার বাংলাদেশি থাকে। এদের বেশিরভাগই অবৈধভাবে অবস্থানের কারণে গ্রেপ্তার হন। গত এক দশকে হাজারো বাংলাদেশি এই বন্দিশিবিরে ছিলেন। সাজা খেটে দেশে ফেরা বাংলাদেশিরা প্রায়ই অভিযোগ করেন, ক্যাম্পগুলোতে বাংলাদেশিদের ওপর নির্যাতন করা হয়। ক্যাম্পে অনেক বাংলাদেশি মারা যান। এই তো কয়েক মাস আগে ক্যাম্প থেকে ফেরা সোহেল নামে একজন আমাকে বলছিলেন, কী করে উলঙ্গ করে সেখানে তাকে অত্যাচার করা হয়েছিল।

এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে বলা অপরাধ? রায়হান কবিরের ঘটনায় মালয়েশিয়ার বাংলাদেশি হাইকমিশন বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। বরং তারা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, একজন রায়হান কবিরের চেয়ে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার তাদের কাছে বড়। কেউ কেউ বলেছেন, তার মালয়েশিয়ার আইন মানা উচিত ছিল। কিন্তু, রায়হান কোন আইনটা ভঙ্গ করলেন, সেটা তারা বলেননি? তাহলে কি সত্য কথা বলা অপরাধ? অন্যায়ের প্রতিবাদ করা কি তবে অপরাধ?

মালয়েশিয়াতে থাকা আওয়ামী লীগের নেতারা আমাকে জানিয়েছেন, রায়হান সেখানে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। আমি তাদের প্রশ্ন করেছিলাম, আপনারা তাহলে রায়হানের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না কেন? তারা উত্তর দেননি। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, বাংলাদেশের বহু দালাল চক্র গড়ে উঠেছে, যারা সেখানে বাংলাদেশ থেকে লোক আনার ব্যবসা করেন। রায়হান তাদের বিরুদ্ধেও বলেছেন। ফলে তারা রায়হানের পাশে নেই। কিন্তু, সাধারণ প্রবাসীরা কী ভাবছেন?

প্রবাসীরা আমাকে বলেছেন, তারা ভয় পেয়েছেন। আর মালয়েশিয়া সরকার চাইছে সেটাই। তারা চাইছে সবাই ভয় পাক। এক রায়হানকে সাজা দিয়ে দেশটিতে থাকা লাখো বাংলাদেশিকে এই বার্তাই মালয়েশিয়া দিতে চায় যে, কোনো কথা বলবে না। কিন্তু, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যে বাংলাদেশের জন্ম, সেই বাংলাদেশের একজন নাগরিক অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না, সেটাই কি আমরা চাইছি?

আমি মনে করি শুধু সাধারণ প্রবাসী নয়, মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস, ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সব প্রবাসী এবং পুরো বাংলাদেশের রায়হানের পাশে থাকা উচিত। কারণ, রায়হান লড়েছেন এই বাংলাদেশের জন্য। আমাদের সবার লড়াই তো সেই বাংলাদেশের জন্যই। রায়হান একটা সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছেন। শুধু স্বপ্ন দেখেই থেমে থাকেননি। সেই পৃথিবীর জন্য লড়াই করেছেন। আমি জানি না কারাগারে মালয়েশিয়ার পুলিশের অত্যাচার কতটা সহ্য করতে পারবে রায়হান। হয়তো কাঁদবে। হয়তো চিৎকার করবে। সেই চিৎকার হয়তো বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের বহু বোধহীন মানুষের কাছে পৌঁছাবে না। কিন্তু, আমরা তোমাকে শুনতে পাচ্ছি রায়হান। আর সে কারণেই তোমার পাশে আছি আমি। কারণ, আমার চোখে তুমিই আসল বাংলাদেশ। রায়হান তোমাকে স্যালুট।

শরিফুল হাসান, ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

7h ago