ফ্রান্সে বাংলাদেশিদের স্বপ্নময় সংগ্রাম
নেপোলিয়োঁ বোনাপাখ, ভলতেখ, ভিক্তখ উগো, বা শাখ দো গোল এর ষড়ভুজাকৃতির দেশ ফ্রান্স। পৃথিবীর অনন্য শৈল্পিক মানচিত্রের দেশকে বলা হয়ে থাকে সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির চারণভূমি।
১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই বাস্তিল দূর্গের পতন হয়। এ পতন মূলত রাজতন্ত্রের পতন। এ বিপ্লব উপড়ে ফেলে শোষণতন্ত্রের শেকড়। বিশ্ব ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য রক্তাক্ত দলিল ফরাসি বিপ্লব। এর মূলনীতি ছিল— Liberté, égalité, fraternité, ou la mort! অর্থাৎ স্বাধীনতা, সমতা, ভ্রাতৃত্ব, অথবা মৃত্যু। এ মূলনীতির ভিত্তিতে গত দু শতাধিক বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে ফ্রান্স।
এই বিপ্লবের মূল কারণ ছিল তখনকার সময় ফ্রান্সের মোট সম্পদ ছিল মাত্র ৫ ভাগ মানুষের হাতে। অথচ এই পাঁচ ভাগ মানুষ কর দিতেন না। কর দিতে হতো অবশিষ্ট ৯৫ ভাগ মানুষকে। এই শোষণ থেকে মুক্তি পেতেই মূলত বাস্তিল দূর্গের পতনের মাধ্যমেই রাজতন্ত্রের অবসান হয়। তবে ১৯৫৮ সালে ফ্রান্সের তৎকালীন উপনিবেশ আলজেরিয়ায় ফরাসিবিরোধী আন্দোলন ফ্রান্সকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। এ সময় ফরাসি সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম ফরাসি নেতা শার্ল দ্য গোলকে একনায়কের ক্ষমতা দান করে। সেই থেকেই মূলত ফ্রান্স বিভিন্ন জাতি-বর্ণ-ধর্মের মানুষের আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে আফ্রিকা মহাদেশের লোকজন নিজেদের আবাসস্থল গড়ে তোলে ফ্রান্সে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই বিভিন্নভাবে ফ্রান্সে বাংলাদেশিদের আগমন ঘটে। উচ্চশিক্ষা, রাজনৈতিক আশ্রয়, বিভিন্ন বৃত্তির সূত্রে ফ্রান্সে এসেছেন বহুজন। বাংলাদেশিদের এখন প্রথম প্রজন্ম চলছে ফ্রান্সে। গত ৯০ দশকের শেষ দিক থেকে মূলত ফ্রান্সে বাংলাদেশি কমিউনিটির যাত্রা শুরু হয়।
কবি ও সাংবাদিক ফয়সল আইয়ূব। স্বপরিবারে প্যারিসে বসবাসের আগে প্রবাসে বাঙ্গালি কমিউনিটির উর্বরভূমি লন্ডনেও ছিলেন অনেকদিন। তিনি বলছিলেন, ৯০ দশকের আগে মূলত ফ্রান্সে বাংলাদেশি কমিউনিটি গড়ে ওঠেনি। এর আগে যারা ছিলেন তারা মূলত বাংলাদেশের কবি, সাহিত্যক বা শিল্পী বা প্রথম শ্রেণির লোকজন। তাদের অনেকেই আবার দেশে ফিরে গেছেন। বাংলা সাহিত্যের মহাকবি মাইকেল মধূসুদন দত্ত, লালসালুখ্যাত সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহরা প্যারিসে থাকলেও কমিউনিটি যে অর্থে বোঝায় সেটি গড়ে ওঠেনি। যে কারণে, ৯০ দশকের শুরুকেই মূলত ফ্রান্সে বাংলাদেশি কমিউনিটির ভিত্তি বলা হয়। বর্তমানে প্রায় লক্ষাধিক বাংলাদেশি ফ্রান্সে বিভিন্ন স্ট্যাটাস নিয়েই আছেন বলে জানান তিনি।
এই মানবতার চারণভূমিতে স্থানীয় প্রশাসন ও জনগোষ্ঠীর কাছে বাংলাদেশ নামটা এখন বিশেষ গুরত্ব বহন করে।
এখানে বাংলাদেশি জনগোষ্ঠী তাদের জীবনযাপন, পেশা, আইনের প্রতি আনুগত্য, নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি, অন্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন বিভিন্ন কারণে স্বতন্ত্র এক ভাবমূর্তি তৈরি করেছে।
আব্দুস শুক্কুর নামের এক অভিবাসী বাংলাদেশির সাথে কথা হয় ফ্রান্সের আইন ও মানুষের বিষয়ে। তিনি একটি ঘটনা বলেন। 'একদিন পুলিশ আমাকে স্কুটিসহ দাঁড় করায়। সাথে অন্যান্য দেশের তিন জনকেও দাঁড় করায়। গাড়ির কাগজ বা অন্য কিছু চেক করার জন্য। প্রথমেই আমাকে জিজ্ঞেস করে, কোন দেশ থেকে এসেছি। যখনই শুনলো বাংলাদেশি। ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।' তিনি গল্পটি বলেই বললেন, আসলে এদেশে বাংলাদেশিদের কাজের প্রতি একাগ্রতা এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণই অন্য সব জাতি গোষ্ঠী থেকে বাংলাদেশিদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে।
তবে জীবনমানে আফ্রিকান বা শ্রীলঙ্কান কমিউনিটির যে একটা স্বীয় অবস্থান তৈরি হয়েছে, সেটি এখনও বাংলাদেশিদের হয়নি। এর কারণ হিসেবে সংস্কৃতিকর্মী ফাহিমা নিপা মনে করেন, দীর্ঘস্থায়ীভাবে জনগোষ্ঠীর বসবাস গড়ে না ওঠা। বিশেষ করে ভাষা সমস্যার কারণে অনেকেই প্রাথমিক বাঁধায় পড়েন। একজন নতুন অভিবাসী ফরাসি ভাষা সম্পূর্ণ নতুন হিসেবে নিজের কাছে আবিস্কার করেন। ফলে একটা সময় চলে যায় ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে। যার ফলে, ফ্রান্সে বাংলাদেশি কমিউনিটি এখনো অন্য কমিউনিটির মতো শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে পারেনি, জানান নিপা। প্যারিসে যদিও কিছুটা অবস্থান আছে, অন্য সব এলাকায় সে তুলনায় আরও কম বাংলাদেশি থাকেন।
দেশে থেকে প্যারিসে এসে অনেকে সাংবাদিকতার কাজে আছেন। তাদেরই একটা অংশ নিজেদের মতো করে সাংবাদিক কমিউনিটি গড়ে তুলেছে। তেমনি একজন 'বাংলা টেলিগ্রামে'র সম্পাদক শাহ সুহেল।
তিনি বলছিলেন, 'এখানে (ফ্রান্সে) বসবাসরত বাংলাদেশিরা অধিকাংশই রাজধানী প্যারিসে বসবাস করেন। এছাড়া তুলুজ, তুলোন, রেস্ট, ভাখছাইসহ ফ্রান্সের অন্যান্য শহরেও বেশ কিছু সংখ্যক বাংলাদেশির বসবাস আছে। সময়ের সাথে এখানে বাংলা সংবাদপত্রের প্রসারও ঘটছে। কমিউনিটির সমস্যা ও সম্ভাবনা, দেশের বিভিন্ন সংবাদ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বা এখান থেকে দেশে সংবাদ প্রকাশের কাজে আছেন অনেকেই। খুব ভাল বিষয় হচ্ছে, সম্প্রতি ফ্রান্সে মিউনিসিপ্যাল ইলেকশনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত শারমীন হক। এটি স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল নিবার্চন হলেও আশার কথা, এভাবেই একদিন মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশিরা এগিয়ে আসবে।'
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিক, বাংলাদেশি রিফিউজি, ইমিগ্রান্ট, রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদনপ্রার্থী পরিচয়সহ অনেকেই অনিয়মিত অভিবাসী হিসেবে অবস্থান করছেন ফ্রান্সে। পেশাগত দিক থেকে জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই রেস্তোরাঁ ব্যবসা ও রেস্তোরাঁ সংশ্লিষ্ট পেশার সঙ্গে জড়িত। এছাড়া ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কর্মী, ট্যাক্সিচালক, ফোনকল, আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা নানা ক্ষেত্রেও অনেকেই সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
প্রবাসী মশিউর রহমান রাজু বলেন, 'জন্মভূমি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসবাস করলেও সবার বুকের মাঝে সব সময় বাংলাদেশকে ধারণ করি।'
স্ব স্ব পেশায় শত ব্যস্ততার মধ্যেও নিজস্ব শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির চর্চায় রয়েছে তাদের সরব উপস্থিতি। বাংলাদেশের মতো এখানেও বাঙালির চিরাচরিত অনুষ্ঠান- শহীদ দিবস, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস, পহেলা বৈশাখ, ঈদ, পূজা এবং অন্যান্য উৎসবগুলোর আনন্দ প্রবাসীরা মিলেমিশে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো যথেষ্ট উৎসাহ ও উদ্দীপনায় উদযাপন করে থাকে ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরের মতো জাতীয় দিবসগুলো। এছাড়া রবীন্দ্র-নজরুল ও অন্যান্য কবি সাহিত্যিকদের জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালন এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিউনিটি সংগঠনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন যেন এক দেশীয় আমেজের সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশের অনেক শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বসবাস করছেন এখন ফ্রান্সে। তাদের মধ্যে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও একুশে পদকপ্রাপ্ত মুকাভিনেতা পার্থ প্রতীম মজুদার, একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ, স্বনামধন্য আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেন অন্যতম।
আইফেল টাওয়ার বা ল্যুভর মিউজিয়ামে গিয়ে মোনালিসার রহস্যময় হাসি দেখে বাংলাদেশি বা বাঙালিরাও শিল্প ও সাহিত্যের টানে লিখে যান নিত্যদিন। ভালবাসার শহরে বসে রেমিট্যান্স পাঠানোর মাধ্যমে ভালবাসা বিলিয়ে দেন স্বজাতি ও দেশের মায়ায়।
(লেখক: কামরুল ইসলাম, প্যারিস, ফ্রান্স থেকে)
Comments