চীনে করোনার দিনগুলো
জানুয়ারির শেষে ১৫ থেকে ২৫ তারিখের দিনগুলি, চীনে তখন চারিদিকে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি চলছে। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি, অফিস-আদালত এরই মধ্যে ছুটি হয়ে গেছে। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির বিদেশি শিক্ষার্থীরা অনেকেই শীতকালীন ছুটি আর চীনা নববর্ষ উদযাপনের জন্য প্রায় দুই মাস ছুটি পেয়ে বাড়ির পথে। কেউ চলে গেছে, কেউ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেউবা ঘুরতে বেরিয়ে পড়েছে অন্য প্রভিন্সের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখতে।
২১ জানুয়ারি, এদিক ওদিক থেকে খবর বের আসতে লাগলো কিছু একটা ঘটছে চীনের কোনো একটা প্রভিন্সে। চায়নাতে ৩৪টা প্রভিন্স। তখনও পর্যন্ত আমরা কিছুই জানতে পারছিলাম না কী ঘটছে! ২৩ জানুয়ারি হঠাৎ করেই কেমন জানি চারিদিকে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। চীনের উহান প্রভিন্স পুরোপুরি শাটডাউন করে ফেলা হয়েছে এমন খবর প্রচার হতে লাগলো। প্লেন, বাস, সাবওয়ে, দোকানঘাট প্রায় সবই বন্ধ করে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হলো।
আমার প্রভিন্সের অবস্থান উহান থেকে প্রায় ১৪০০ কিলোমিটার দূরে। তাই এখানে সব স্বাভাবিক থাকলেও জন সমাগম চারপাশে একদম কমে যেতে লাগলো। চীন আসার আগে তাদের এই নববর্ষের যে গল্প শুনেছি তার পুরো উল্টো চিত্র দেখতে পেলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম মানুষের উপস্থিতি কম হয়তো উৎসব নিয়ে সবাই যার যার বাড়িতে ব্যস্ত। কিন্তু যেহেতু দুদিন আগেও দোকানপাটগুলোতে উৎসবের আমেজ দেখেছিলাম তাই এক দুদিনের ব্যবধানে এতটা নিস্তব্ধতা দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম।
২৫ জানুয়ারি চীন নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। এটাকে তারা বলে লুনার ইয়ার। এর দিনপঞ্জি অনুযায়ী মূলত চায়নার ক্যালেন্ডার তৈরি হয়।
২৪ জানুয়ারির রাত থেকে উৎসবের আমেজ বলতে কেবল আতশবাজী। যেহেতু এখানকার জনগণ এরইমধ্যে সরকার থেকে ঘরে থাকার নির্দেশনা পেয়েছে, তাই শুধু বাড়ির আঙিনায় খোলা আকাশে বাজির ঝলকানিতেই আনন্দ খুঁজে নিয়েছে।
২৫-২৬ জানুয়ারি থেকে পুরোই বদলে গেল আমার দেখা গত চার মাসের চীন জীবন। আমার ইউনিভার্সিটি থেকে নানা দিকনির্দেশনা আসতে লাগলো। ক্যাম্পাস থেকে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বের না হওয়ার নির্দেশ। রুম থেকে বের না হওয়া, বের হলেও মাস্ক পরা, অন্যদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলা এবং হাতধোয়া। মাঝেমাঝে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অফিস থেকে বিদেশি শিক্ষার্থীদের রুমে এসে খোঁজ খবর নেয়া শুরু হলো। শুরু হলো করোনাভাইরাসের সাথে যুদ্ধের জীবন। চারিদিক থেকে বিশেষ করে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে খবরের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো চীন এবং করোনাভাইরাস। যেহেতু উহান থেকে আমার প্রভিন্সের দূরত্ব অনেক তাই বলা যায় নিরাপদ অবস্থানে ছিলাম। আমার বসবাসের প্রায় তিন কোটির এই গানসু প্রভিন্সে মাত্র ১৩২ জন আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেল আর দুজনের মৃত্যু। তাও ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সংখ্যাটা এমনই ছিল। আর তাতেই পুরো প্রভিন্স সেই জানুয়ারি ২৫-২৬ থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লকডাউন মেনে চলেছে। এপ্রিলের শুরুর দিক থেকে এক-দুইটা রেস্টুরেন্ট চালু করেছে।
করোনার চরম প্রকোপের দিনগুলিতে ১৫ দিনে একদিন পুরোপুরি সতর্কতা অবলম্বন করে শুধু খাবার কিনতে বের হয়েছি। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটা দুটো বড় শপিংমল ও বাজারগুলো খোলা ছিল এবং পুরো রাস্তাঘাট ছিল জনমানবহীন নিস্তব্ধ এক ভুতুড়ে নগরী। জীবনে শুরু হলো এক নতুন রুটিন। প্রতিদিন শরীরের তাপমাত্রা মাপা। পারতপক্ষে ঘর থেকে বের না হওয়া। মাস্ক ছাড়া রুমের বাইরে না যাওয়া। আর গেলেও দূর থেকেই কারো সাথে সাক্ষাৎ করা।
এপ্রিলের শেষ দিক থেকে জীবনটা আবার কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে শীত বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্মের আমেজে প্রকৃতি তার রূপ ধারণ করলো। যখন সারাবিশ্বে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর সাথে যুদ্ধ করছে। তখন চীন ততটাই নিরাপদ দেশ হিসেবে নিজেকে তালিকাভূক্ত করলো।
লকডাউন এবং এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে যা যা করা দরকার ছিল তার সবটুকুই এখানকার সরকার থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ কে দৃঢ়তার সাথে পালন করতে দেখেছি। মহামারির শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত প্রতিদিন শরীরের তাপমাত্রা মাপার রুটিন, মাস্ক ব্যবহার এবং হাত জীবনুমুক্ত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করে চলেছে। তবে করোনা ভাইরাসকে প্রতিহত করতে চাইনিজদের কিছু প্রাত্যহিক অভ্যাস ভীষণ কাজে দিয়েছে, যেমন- নিয়মিত গরম পানি পান, প্রচুর বিভিন্ন ভেষজ পাতা এবং ফুলের চা পান, শারীরিক ব্যায়াম।
এপ্রিলের শেষ দিক থেকে মোটামুটি স্বাভাবিক জীবনে ফেরে চীনবাসীর জীবন। শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি ক্লাসরুমে গিয়ে ক্লাস শুরু করে। নিয়ম মেনে ঘর থেকে বের হওয়া, রেস্তোরাঁতে খেতে যাওয়ায় আর কোন বাধা থাকল না। করোনার সব বাধা পেরিয়ে আবার মুখর হলো ভীষণ পরিশ্রমী এ জাতির কর্মময় জীবন।
মুখে মাস্ক এবং এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে যাওয়ার কিছু সীমাবদ্ধতা ছাড়া চীনের জীবন চলছে স্বাভাবিক নিয়মে, যেমন ছিল করোনা আসার আগের দিনগুলোতে। সরকারের বেধে দেয়া নিয়ম, নিজেদের সচেতনতা, আর প্রশাসনের নজরদারির কারণে করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হওয়া এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে চীন।
(লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, লানঝও ইউনিভার্সিটি, গানসু, চীন)
Comments