জেলখানায় আমাদের ঈদ: রায়হানের বাবা-মা

Rayhan_Narayanganj.jpg
মোবাইল ফোনে ছেলের ছবি দেশে দিন কাটছে রায়হানের বাবা-মায়ের। ছবি: স্টার

‘জন্মের পর এমন কোনো ঈদ নেই যেদিন ছেলেটা আমাদের কাছে ছিল না কিংবা আমাদের সঙ্গে কথা বলেনি। এই প্রথম আমাদের একটি ঈদ কাটলো যে ঈদে ছেলেকে না কাছে পেলাম, না কথা শুনলাম। জানি না আমাদের ছেলে কবে আমাদের কাছে ফিরে আসবে।’

আজ শনিবার রাতে রায়হানের মা রাশিদা বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে কথাগুলো বলছিলেন। ছেলের কথা মনে করে কাঁদছিলেন বাবা শাহ আলমও।

আল জাজিরায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের জের ধরে গত ২৪ জুলাই মালয়েশিয়ার পুলিশ রায়হানকে গ্রেপ্তার করে। এরপর নয় দিন পেরিয়ে গেছে। রায়হানের পরিবারের সদস্যরা বলেন, তাদের কাছে সময়টা অনন্তকাল মনে হচ্ছে।

রাশিদা বেগম আরও বলেন, ‘আমার যন্ত্রণা আমি কাউকে বোঝাতে পারবো না। সারাটা দিন আমি কেঁদেছি। ছেলেটা কারাগারে। সারাটা দিন অস্থির কেটেছে। পুরোনো স্মৃতিগুলো বারবার মনে পড়েছে। মায়ের এই যন্ত্রণা কাউকে বোঝাতে পারবো না। আমি তো ছেলেটাকে জন্ম দিয়েছি। ছেলেটা ঈদে কাছে থাকলে আমার কপালে চুমু দিতো। দেশে না থাকলে অন্তত ফোন দিতো। আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।’

কথা বলতে গিয়ে বারবার কাঁদছিলেন রাশিদা। তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলেটাকে আপনারা আমার কাছে ফিরিয়ে দেন। মালয়েশিয়া সরকারের কাছে আমার আকুতি, আমার ছেলেটাকে ফেরত দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও আমার একই আকুতি। আমি নিশ্চিত জানি, আমার ছেলে কোনো অপরাধ করেনি। ও অপরাধ করার ছেলে না। আপনারা আমার ছেলেকে এনে দেন। আমার ছেলে না ফিরলে আমার ঈদ হবে না। আর আমার ছেলে যেদিন ফিরবে সেদিনই আমার ঈদ।’

রায়হানের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায়। বাবা-মা আর দুই ভাইবোনের পরিবার। রায়হানের বাবা শাহ আলম নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এলাকার পঞ্চবটি বিসিক শিল্প নগরীতে একটি রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানায় কাজ করেন।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমার ছেলেটা জীবনে কোনোদিন কোনো অন্যায় করেনি। সব সময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতো। আমি অনেক সময় বলেছি, বাবা এভাবে প্রতিবাদ করো যদি কখনো বিপদে পড়ো! ছেলে আমাকে বলতো, বাবা মানুষের বিপদে যদি আমি পাশে না থাকি, যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ না করি তাহলে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আমার সেই ছেলেটা এখন কেমন আছে?’

রায়হানের প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, বন্দর এলাকায় সবার কাছে প্রতিবাদী তরুণ হিসেবে পরিচিত রায়হান। এলাকার সবার বিপদে-আপদে পাশে থাকতেন। নিজের বই, অর্থ দিয়ে শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতেন। এলাকায় মাদক চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ২০১৪ সালে রায়হান উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে মালয়েশিয়ায় পড়তে যান। সেখানে বিএ পাস করেন। ঈদুল ফিতরের আগে একটি কোম্পানিতে তার চাকরি হয়।

গত ৩ জুলাই আল জাজিরার ইংরেজি অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে ‘লকডআপ ইন মালয়েশিয়ান লকডাউন-১০১ ইস্ট’ শীর্ষক এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে মালয়েশিয়ায় প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি লকডাউন চলাকালে দেশটির সরকারের নিপীড়নমূলক আচরণের বিষয়টি উঠে আসে। ওই প্রতিবেদনে আরও অনেক দেশের নাগরিকদের পাশাপাশি রায়হান কবিরও সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তাতে ক্ষুব্ধ হয় মালয়েশিয়া। রায়হান কবিরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। ২৪ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যায় তাকে গ্রেপ্তার করে মালয়েশিয়ান পুলিশ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থা এবং সংগঠন গ্রেপ্তারের ঘটনায় নিন্দা জানায়। একইসঙ্গে দ্রুততম সময়ে রায়হানের মুক্তির দাবি জানায়।

রায়হানের সঙ্গে সর্বশেষ কবে কথা হয়েছে জানতে চাইলে শাহ আলম বলেন, ‘গ্রেপ্তারের আগের দিন বৃহস্পতিবার। ছেলেটা আমাকে বলে, বাবা আমি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমি ওদের জন্য কষ্ট সহ্য করছি। তোমরা আমার জন্য একটু কষ্ট করো।’

রায়হানের ছোটবোন মেহেরুন মাহের নারায়নগঞ্জ কলেজে মার্কেটিং বিষয়ে স্নাতক শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘ভাইয়া সব সময় আমাকে বলতো, মানুষের পাশে দাঁড়াবি। ১৯ জুলাই ভাইয়া তার এক বন্ধুকে একটা মেসেজ লিখেছিল। তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন। সেটা পড়ে আমি আরও কেঁদেছি।’

গ্রেপ্তারের আশঙ্কা নিয়েই ১৯ জুলাই রায়হান লিখেছিলেন, ‘আজও শ্রমিকের নামে দাস বানিয়ে রাখে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। গুগুলে সার্চ করুন, সবচেয়ে সস্তা শ্রম দেওয়ার তালিকায় আমরা প্রথম। তাও তারা আমাদের আঘাত করে। সিস্টেমের কারণে অবৈধ হয়ে গেলেও আমাদের সাজা দেয়। পশুর মতো হাতে শেকল পড়িয়ে বিশ্বের সব দেশের মানুষদের সামনে টেনে হিঁচড়ে এয়ারপোর্ট ক্রস করায় কেন? সাজার নামে আমার ধর্মপ্রাণ ভাইকে উলঙ্গ করায় কেন? তাও এগুলার বিরুদ্ধে গলা উঁচু করা যাবে না। আঘাত সয়ে চোখের পানি ঝরাতে হবে।’

রায়হান আরও লিখেছে, ‘আমি তো ভালো আছি, আমার পরিবার নিয়ে হাসি-খুশি সময় কাটাচ্ছিলাম। আমার হাতে মালয়েশিয়ার ডিগ্রি আছে। কোনো একটা করপোরেট চাকরি করে বেশ আরাম আয়েশেই জীবনটা পার করে দিতে পারতাম। কিন্তু যখন দেখেছি আমার চোখের সামনে আমার দেশের ভাইদের অমানসিক নির্যাতন চালায় তখন আমি ভালো থাকতে পারি নাই। ফলে আমি আজ ফেরারি আসামি। নাই বললাম কেমন যাচ্ছে এখনকার প্রতিটা সময়, কী পরিমাণ যুদ্ধ করছি প্রতিটা সেকেন্ডের সাথে। তুলে রাখলাম সেই গল্প। আমার অপরাধ আমি একজন বাঙালি।’

শরিফুল হাসান, ফ্রিল্যান্স রিপোর্টার

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Fund crunch hits Rohingyas hard

A humanitarian crisis in Cox’s Bazar Rohingya camps is brewing in the face of funding shortage for the refugees and more arrivals from the conflict-ridden Rakhine state of Myanmar.

10h ago