সংস্কারের ৩ বছরেই সৌন্দর্য হারিয়েছে সোমপুর মহাবিহার
সংস্কার ও পর্যটন উন্নয়নে নেওয়া প্রকল্প শেষ হওয়ার তিন বছরেই সৌন্দর্য ও মহিমা হারিয়েছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট সোমপুর মহাবিহার। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে ২০১৪ সালের মার্চ থেকে ২০১৬’র ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে সাইটটিতে ‘দক্ষিণ এশিয়া পর্যটন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। প্রকল্পের আওতায় মূল মন্দির ও চারপাশের স্থাপত্য পরিষ্কার ও সংস্কার করা হয়। মূল মন্দিরে দর্শনার্থীদের ওঠা ও চারদিকে নিরাপদে চলাচলের জন্য মূল স্থাপত্যগুলোর গায়ে কাঠের আলাদা অবকাঠামো তৈরি করা হয়।
দর্শনার্থীদের অভিযোগ, প্রকল্প শেষে তিন বছরের মধ্যেই, অর্থাৎ ২০১৯ সালেই মহাবিহারের মূল মন্দিরের দেয়ালগুলোতে শ্যাওলা পড়ে কালো হয়ে যায়, পোড়ামাটির ফলকের রেপ্লিকাগুলোতে নোনা ধরে। মূল মন্দিরে দর্শনার্থীদের ওঠার জন্য নির্মিত কাঠের সিঁড়ি এবং সাইটের অন্যান্য স্থানে নির্মিত কাঠের অবকাঠামোগুলো ভেঙে পড়ে। এই অবস্থায় গত বছরের শেষ দিকেই মূল মন্দিরে দর্শনার্থীদের যাতায়াত সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সাইটে প্রবেশ করতেও ভাঙা সিঁড়িতে দর্শনার্থীদের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে।
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পর দর্শনার্থীদের থেকে আদায় করা প্রবেশ মূল্য ও গাড়ি পার্কিংসহ বিভিন্ন খাত থেকে রাজস্ব আড়াই গুণের বেশি বেড়েছিল। তবে সৌন্দর্য হারানোর কারণে ধীরে ধীরে আয় কমতে শুরু করেছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এখান থেকে রাজস্ব আয় ছিল প্রায় ২৭ লাখ টাকা। কিন্তু ২০১৬-১৭ সালে আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৭২ লাখ টাকায়। পরের বছর আরও বেড়ে আয় হয় ৭৭ দশমিক ২৫ লাখ টাকা। কিন্তু আয় বৃদ্ধি ধরে রাখা যায়নি। ২০১৮-১৯ সালের দিকে এসে আয় কমতে শুরু করে। সে বছর আয় হয় ৭৬ দশমিক ৬০ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ এ আয় কমে হয় ৫৮ লাখ টাকা।
নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুরে অবস্থিত সোমপুর মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ এক হাজার ৩০০ বছর আগে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক শিক্ষা বিকাশের সাক্ষী হয়ে আছে। তৎকালীন গৌড় বাংলার এই সোমপুর মহাবিহারেই বৌদ্ধ ধর্মের নতুন একটি শাখা— মহায়না বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উত্থান ঘটে। এর অনন্য স্থাপত্যকলা মহাজগৎ সম্পর্কে বৌদ্ধদের আধ্যাত্মিক ধারণা, যেটাকে তারা বলে ‘মণ্ডলা’, তারই জ্যামিতিক প্রতিফলন। স্থাপত্যের মধ্যখানে রয়েছে প্রায় ১০০ ফুট উঁচু একাধিক তলবিশিষ্ট প্রধান মন্দির। সাত হেক্টর জমির ওপর অবস্থিত মহাবিহারের প্রধান মন্দিরের চারিদিকে চতুর্ভুজ আকারে প্রাচীর সংলগ্ন ১৭৭টি কক্ষ রয়েছে। বাঙালি পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানসহ তৎকালীন এশিয়ার পণ্ডিতদের ও শিক্ষার্থীদের চারণভূমি ছিল এই স্থান। ইন্দোনেশিয়ার বড়বুদুর, মিয়ানমারের বাগান ও কম্বোডিয়ার আঙ্কর ওটে সোমপুর বিহারের আদলে তৈরি স্থাপত্য দেখে প্রত্নতত্ত্ববিদরা ধারণা করেন, সোমপুরই ছিল বিস্তীর্ণ এই এলাকার বিহারগুলোর কেন্দ্রবিন্দু।
সপ্তম শতকের শেষভাগে যখন মাৎস্যন্যায় বা মাছের আইন পরিস্থিতি বিরাজ করছিল যেখানে বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে নেয় অর্থাৎ আইনের শাসনের অভাবে শক্তিশালীরা দুর্বলদের দমন করে, সেই অরাজক সময়ের অবসান ঘটিয়েই পাল বংশের রাজত্ব শুরু হয়। পাল রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা গোপালের পুত্র ধর্মপাল (৭৭০-৮১০) সোমপুর মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিভিন্ন স্থান থেকে বিচ্ছিন্ন জ্ঞানী-পণ্ডিতদের নিয়ে এসে একত্রিত করেন। পাল আমলেই সোমপুর মহাবিহারের প্রসার ঘটে। পাঁচ শতাব্দী ধরে এই মহাবিহার জ্ঞানপিপাসুদের অন্যতম তীর্থস্থান বলে বিবেচিত হয়েছিল। পালদের রাজত্ব শেষ হলে মহাবিহারও হারিয়ে যায়। ১২তম শতাব্দীতে হিন্দু রাজত্বের সময় বৌদ্ধরা এই এলাকা ত্যাগ করে। ১৩তম শতাব্দীতে মুসলিম শাসনামলে মহাবিহারের স্থাপত্যগুলো পরিত্যক্ত হয়।
অনেক পরে ১৮০৭ থেকে ১৮১২ সালে তৎকালীন ভারত ভ্রমণের সময় স্কটিশ চিকিৎসক ডা. ফ্রান্সিস বুকানন হ্যানিলটন পাহাড়পুরে একটি সুউচ্চ ঢিবি আবিষ্কার করেন। পরে প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রমাণ করেন, সেটা বৌদ্ধদের সোমপুর মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ।
১৯১৯ সালে ভারত সরকার স্থানটি প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বের স্থান হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৩৪ সালে নাটোরের দীঘাপাতিয়ার জমিদার শরৎ কুমার রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ বাবু রাখাল চন্দ্র দাস স্থানটি খনন শুরু করেন এবং মহাবিহারের সন্ধান পাওয়া যায়।
১৯৮৫ সালে মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ ওয়ার্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেস্কো।
রাজশাহীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. রোকনুজ্জামান বলেন, ‘এখানে বেড়াতে এলে আমি পুরনো দিনের কথা ভাবি। যখন শিক্ষাব্যবস্থা ছিল বাস্তবিক। এখনকার মতো কংক্রিটের মধ্যে ছোট-ছোট ঘরে বসে কাল্পনিক শিক্ষাব্যবস্থা নয়।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে পাহাড়পুরে বেড়াতে গিয়েছিলেন রোকনুজ্জামান।
তিনি বলেন, ‘আমরা স্থানটির চারিদিকে ঘুরে বেড়িয়েছি এবং কল্পনা করেছি, এখানে এক বিষয় পড়ানো হতো, ওখানে অন্য বিষয়। আমাদের খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু, ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক এই স্থানটির প্রতি প্রয়োজনীয় যত্নের অভাব দেখে খুব মন খারাপ হচ্ছে।’
যোগাযোগ করা হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক স্বাধীন সেন জানিয়েছেন, ১৯৮৫ সালে সোমপুর মহাবিহার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার পরে ঐতিহাসিক এই স্থানটিকে কেন্দ্র করে এর সংস্কার ও পর্যটন উন্নয়নে প্রকল্প গ্রহণের ‘ঝামেলাপূর্ণ ইতিহাস’ তৈরি হয়েছে।
তিনি জানান, কিছু প্রকল্প তারা বাস্তবায়ন হতে দেখেছেন ১৯৮৫ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে। সর্বশেষ উন্নয়ন কাজ শেষ হয়েছে ২০১৬ সালে।
‘দেখুন, কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের সংস্কার বলতে আমরা বুঝি স্থানটি যেভাবে আছে সেভাবেই তার রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের চেহারা পরিবর্তনে আইনগত নিষেধও আছে। আইনের এই ব্যাখ্যা সামনে রেখে আমি মহাবিহারে কাঠের নতুন অবকাঠামো তৈরির জন্য কোনো যুক্তিকেই সমর্থন করতে পারি না। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে প্রচুর সংখ্যক দর্শনার্থী মূল মন্দিরে উঠে যাচ্ছে। এতে করে এক হাজার ৩০০ বছর পুরনো ঐতিহাসিক স্থাপত্যটির ক্ষতিই হচ্ছে’, বলছিলেন স্বাধীন সেন।
প্রত্নতত্ত্ববিদরা জানিয়েছেন, স্থানটিতে জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার সমস্যা ছিল অনেককাল ধরে। প্রকল্পগুলোর কারণে জলাবদ্ধতার সমস্যা প্রায় সমাধান হয়েছে। তবে, পোড়ামাটির ফলকগুলোতে লবণাক্ততার সমস্যা রয়েই গেছে। লবণাক্ততার সমস্যা এড়াতে অদ্ভুত এক কাজ করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। স্থানটি খননকালেই ২৬৫টি পোড়ামাটির ফলক রাজশাহীতে বরেন্দ্র জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাকি প্রায় তিন হাজার পোড়ামাটির ফলক মন্দিরের গায়েই লাগানো ছিল। চুরি ও নোনা এড়াতে প্রকল্পগুলোর আওতায় সবগুলো পোড়ামাটির ফলক খুলে ফেলা হয়। পরিবর্তে ফলকগুলোর রেপ্লিকা তৈরি করে মন্দিরের গায়ে বসানো হয়। আসল পোড়ামাটির ফলকগুলোর মধ্যে মাত্র ১৭টি মহাবিহার সংলগ্ন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পরিচালিত পাহাড়পুর জাদুঘরে প্রদর্শন করা হয়। বাকিগুলো গুদামজাত করে রাখা হয়েছে।
স্বাধীন সেন বলেন, ‘এই ফলকগুলোতে পাল বংশের ঐতিহ্য ও রীতিনীতির সন্ধান পাওয়া যায়। তাদের ধর্মনিরপেক্ষ আচরণেরও প্রমাণ মেলে। কারণ সেখানে হিন্দু দেব-দেবী, মুসলিমদের প্রতীকসহ বৌদ্ধদের নানান শিল্পকলা, সংস্কৃতি, অভ্যাসের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এসব কারণে এই ফলকগুলো ঐতিহাসিকভাবে মূল্যবান।’
যোগাযোগ করা হলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রাজশাহী আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সোমপুর মহাবিহারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে কোনো আইনের লঙ্ঘন হয়নি। প্রত্যেক কাজের পেছনেই স্থানীয় প্রত্নতত্ত্ববিদদের পাশাপাশি বৈদেশিক দক্ষতারও সন্নিবেশ ঘটান হয়েছিল।’
‘দর্শনার্থীদের মূল মন্দিরের চূড়ায় ওঠার প্রবণতা ঠেকানো খুব কঠিন। যখন কাঠের সিঁড়ি ছিল না, তখনো ঝুঁকি নিয়ে দর্শনার্থীদের চূড়ায় উঠতে দেখা গেছে। কাঠের সিঁড়িগুলো ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করছিল। তা ছাড়া, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পর দর্শনার্থীদের কাছে মহাবিহারে প্রবেশমূল্য আদায় করে রাজস্ব আয়ও বেড়েছিল’, বলেন নাহিদ সুলতানা।
তিনি বলেন, ‘কাঠের অবকাঠামোগুলো মেরামতের জন্য সদর দপ্তরে জানানো হয়েছে। এখনো কোনো উত্তর আসেনি।’
‘মহাবিহারের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কাজগুলো অধিদপ্তরের সদর দপ্তর থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মনিটরিং ছাড়া প্রকল্পগুলোতে আর কোনো দায়িত্ব স্থানীয় কর্মকর্তাদের থাকে না’, যোগ করেন নাহিদ সুলতানা।
আয় কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে করে তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারির কারণে গত ২৭ মার্চ থেকে সাইটটি বন্ধ রয়েছে। মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত কোনো রাজস্ব আয় হয়নি। নতুন করে নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত সাইটটি জনসাধারণের জন্য বন্ধ থাকবে। সাইটটি থেকে রাজস্ব আয়ের সিংহভাগই আসে নভেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে।’
Comments