সাইকেল চালিয়ে আসাদ বাড়ি-বাড়ি পৌঁছে দেন বই

atif asad
সাইকেল চালিয়ে বাড়ি-বাড়ি বই পৌঁছে দেন আতিফ আসাদ। ছবি: সংগৃহীত

জীবনের কঠিন বাস্তবতা ও বেড়াজালে অধিকাংশ মানুষ আত্মসমর্পণ করলেও কেউ কেউ আছেন যারা পরিবর্তনের জন্য নিজের মতো করেই পথ তৈরি করে নেন।

১৯ বছর বয়সী আতিফ আসাদ এমনই একজন। বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার হাসরা মাজালিয়া গ্রামে। পড়াশোনার পাশাপাশি রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করেন তিনি।

প্রত্যন্ত ওই অঞ্চলে মানুষের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ২০টি বই নিয়ে তিনি একটি পাঠাগার চালু করেছিলেন।

কেবল নিজ গ্রামেই না, আশেপাশের গ্রামগুলোতেও মানুষকে বই পড়তে উৎসাহ দেন তিনি।

জামালপুর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আসাদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা কেমন অনুভব করে সেটা আমি বুঝি। আমি নিজেও স্কুলজীবনে একইরকম কষ্টের মধ্যে ছিলাম।’

আসাদের পাঠাগারে বর্তমানে দুই হাজারেরও বেশি বই আছে। পাঠাগারে থাকা ইতিহাস, সাহিত্য, উপন্যাস, কবিতা, রাজনীতি, ধর্ম ও মহান ব্যক্তিদের জীবনীগুলোর প্রায় শতাধিক পাঠক আছেন।

এই পাঠাগারের সদস্য হতে কোনো অর্থ খরচের প্রয়োজন হয় না। এমনকি, আসাদ নিজেই ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত সাইকেল চালিয়ে পাশের গ্রামগুলোতে বই দিয়ে আসেন।

পাঠকদের বই পড়া শেষ হলে সাইকেল চালিয়ে বই ফেরতও নিয়ে আসেন তিনি।

অবসরে বই পড়া আসাদের জীবনে বরাবরই এক ধরনের বিলাসিতার মতো ছিল। দিনমজুর বাবার নয় জনের সংসারে চার বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট আসাদ।

এই দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য এমনকি প্রাথমিক শিক্ষাও বিলাসিতা হিসেবে বিবেচিত হতো। সত্তর বছর বয়সী বাবার পক্ষে পরিবার চালানো এখন প্রায় অসম্ভব।

ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সংগ্রাম করছে আসাদ। ছোটখাটো কাজ করে খরচ জুগিয়েছেন তিনি। স্কুলে জীবনে অর্থের অভাবে কখনো কোনো প্রাইভেট টিউটরের কাছে যেতে পারেননি।

আসাদ বলেন, ‘আমি আশা ছাড়িনি। পরিবার ও পড়াশোনার খরচ জোগানোর জন্য ছোটখাটো কৃষিকাজ ও রাজমিস্ত্রীর সহকারী হিসেবে কাজ করেছি। আমি এখনও তা চালিয়ে যাচ্ছি।’

বড়ভাই মিলনের সহায়তায় গ্রামের তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া ২০টি বই নিয়ে পাঠাগারটি গড়ে তুলেছিলেন আসাদ। পাটকাঠি দিয়ে তৈরি ঘরের বারান্দার ছোট ঘরটিতেই জায়গা পেয়েছে পাঠাগারের বইগুলো।

আসাদ জানান, এমন একটি লাইব্রেরি চালু করা তার স্বপ্ন ছিল যেখানে সবাই, বিশেষত দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বই পড়ার সুযোগ পাবে।

শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে নিরক্ষতা নির্মূল করার স্বপ্ন দেখেন তিনি। পাঠাগারটি চালু হওয়ার প্রায় এক মাস পর, ২১ ফেব্রুয়ারি জমিজমা নিয়ে বিবাদের কারণে প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতে খুন হয় বড় ভাই মিলন।

এই মর্মান্তিক ঘটনার পর প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আসাদ থেমে থাকেননি।

প্রয়াত ভাইয়ের নামে পাঠাগারের নাম রাখা হয় ‘মিলন স্মৃতি পাঠাগার’।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে লাইব্রেরি গড়ে তোলার এমন উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে পেয়ে, ধীরে ধীরে এলাকার উচ্চবিত্তরা আসাদের বই কেনার তহবিলে অনুদান দিতে এগিয়ে আসেন।

বুকশেলফ কিনতেও সাহায্য করেন অনেকেই।

ভিয়েতনামের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এই পাঠাগারে পাঁচ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। পাশাপাশি, পাঠাগার চালানোর জন্য নিজের অল্প আয় থেকেও টাকা জমান আসাদ।

তিনি জানান, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষজন খুব কমই লাইব্রেরিতে আসেন। তাই নিজেই সাইকেল চালিয়ে পাঠকদের ঘরে ঘরে বই পৌঁছে দেন তিনি। বইয়ের তথ্যসহ একটি ফেসবুক পাতাও আছে।

বই চেয়ে তাকে ফোনে কিংবা ফেসবুক পাতায় যোগাযোগ করলে পাঠকের বাড়ি বই পৌঁছে দেন তিনি।

সরিষাবাড়ী মাহমুদা সালাম মহিলা কলেজের অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী সুরুমি আক্তার জানান, তার প্রয়োজন অনুযায়ী আতিফ প্রতি সপ্তাহে সাইকেল চালিয়ে বই নিয়ে আসেন। পাঠাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও সমরেশ মজুমদারের বেশ কয়েকটি উপন্যাস পড়েছেন তিনি।

সরিষাবাড়ীর পোগলদিঘা ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক বলেন, ‘মিলন স্মৃতি পাঠাগার বেশ সুনাম অর্জন করেছে। নিঃসন্দেহে এটি আসাদের একটি অভিনব উদ্যোগ–লাইব্রেরি থেকে বই পড়ার অভ্যাস শেখার ক্ষেত্রে বেশ বড় ভূমিকা রাখে।’

এ বছর জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো উপজেলা শহরে তিন দিনের বইমেলার আয়োজন করেছেন আসাদ। সেখানে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকরা বেড়াতে এসেছিলেন। এটি তার জীবনের একটি বড় অর্জন বলে জানান আসাদ।

তিনি বলেন, ‘আমি সবাইকে বলতে চাই, পড়ুন, পড়ুন এবং পড়ুন। এটা ছাড়া সমৃদ্ধ জাতি গঠনের কোনো বিকল্প নেই। আমি আশা করি, এমন একদিন আসবে যখন বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে পাঠাগারের ব্যবস্থা থাকবে।’

Comments

The Daily Star  | English

India, Pakistan agree ceasefire

Announces Trump after rivals launch multiple attacks on key military installations; Islamabad, New Delhi confirm truce 

44m ago