চীনে মধুর শিক্ষাজীবন, শেষ হলো বিষাদে
চোখের জলে প্রিয় ক্যাম্পাস ছাড়ার কোন বেদনা ছিল না, ছিল না গাউন-টুপিতে সমাবর্তন উৎসবের আমেজ। দুই অথবা চার বছর ভিনদেশের শিক্ষা জীবনের শেষটা এমন সাদাকালো হবে তা কারও কল্পনাতেও ছিল না। অথচ তাদের ইচ্ছের তালিকাটা ছিল দীর্ঘ ও রঙ্গিন। বন্ধুদের সাথে হাস্যোজ্জল সেল্ফি, চকচকে খোদাই অক্ষরের সনদ হাতে ছলছলে চোখ, উল্লাসে শূন্যে ছুড়ে দেয়া গ্র্যাজুয়েশন ক্যাপ, স্ত্রী-পরিবারের মুখে গর্বের রেশ কিংবা ভিনদেশি ভালবাসার সাথে শেষ মধুর স্মৃতি। নানা জনের, নানা মনের মণিকোঠায় দীর্ঘদিনের এমন শত প্রত্যাশা জমেছিল স্বপ্ন হয়ে। আশা ছিল যেন ডিগ্রি লাভের শেষটা হয় সুন্দর ও স্মরণীয়। হয় যেন ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’।
তবে দুর্ভাগ্য, শেষমেশ মধুর হয়নি শেষটা। বিশাল আয়োজন, মাতামাতি আর উল্লাস সব রয়ে গেছে যেন অতৃপ্তি হয়ে। বলছিলাম চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বছর অনলাইনে ডিগ্রি পাওয়া বাংলাদেশি গ্রাজুয়েটদের কথা, যারা করোনা ভাইরাসের কারণে চীন ছেড়ে বর্তমানে দেশে অবস্থান করছেন।
বড় সেমিনার কক্ষের প্রজেক্টরে নয় বরং ঘরে বসে অনলাইন স্ক্রিনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট মুখের খোপে ১০/১২ মিনিটের থিসিস ডিফেন্স। কারও কারও আধ ঘণ্টার পাওয়ারপয়েন্ট পরিবেশনায় নিজের গবেষণা নিবন্ধ তুলে ধরা আর কারও ক্ষেত্রে হয়তো ঘড়ি ধরে অনলাইন পরীক্ষা।
কোভিড মহামারির কারণে এবার এমনই ছিল চীনা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা দেশের শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি লাভের পূর্ব- চিত্র। এই যেমন বিশ্বের অন্যতম নামকরা সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় ২০২০ সালের স্নাতকদের জন্য সব কার্যক্রম অনলাইনে পরিচালনা করেছিল। এমনকি অনলাইনে আয়োজন করেছিল গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানেরও। চীনের অন্যান্য অনেক নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের অনুসরণ করেছিল। একইভাবে বিদায় জানিয়েছিল তাদের নতুন গ্রাজুয়েটদের। এদের মধ্যে জিয়াংসি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করেছিল এক ধরনের ডিজিটাল গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠান।
বলাই বাহুল্য, ২০২০ সালে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে এমন ডিগ্রী পাওয়ার ঘটনা শিক্ষার্থীরা সারা জীবন মনে রাখবে। চায়না ইয়ুথ ডেইলির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছর সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা নতুন শিক্ষার্থীদের ৮৮ দশমিক ৬ শতাংশ ডিজিটালি তাদের স্নাতক হওয়া উদযাপন করেছে।
চীনের প্রথম সারির উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উহান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সারওয়ার। করোনা আক্রান্ত চীনের উহান থেকে এ বছরের ১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে আসায় অনলাইনেই ইতি টানতে হয়েছে দুই বছরের স্নাতকোত্তর কোর্সের। তিনি জানান, মাস্টার্স থিসিস চূড়ান্তভাবে উপস্থাপনের আগে এখান থেকে সুপারভাইজারের সাথে যোগাযোগের বিষয়টা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। এক্ষেত্রে অনলাইনে তাদের সাক্ষাৎ পাওয়াটা যেমন অনেক ক্ষেত্রে দুরূহ ছিল তেমনি থিসিসের দিকনির্দেশনা নিয়েও মাঝেমধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। ‘এরপরও আগের রাতের পূর্ব-প্রস্তুতিতে শেষ পর্যন্ত সুপারভাইজার আর সবার সহযোগিতায় ভালোয় ভালোয় থিসিস ডিফেন্স করে সফল হয়েছি। যদিও ঘরে বসে অনলাইনে সেটি উপস্থাপনের কারণে সামনাসামনি শিক্ষকদের কোন রেসপন্স না পাওয়ায় একটু বেশি দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করেছে,’ বলেন সারওয়ার।
দুই বছর ধরে বিশাল ক্যাম্পাসে সমাবর্তন উৎসবে অংশ নেয়ার অনেক পরিকল্পনা ছিল জানিয়ে সারওয়ার বলেন, ‘টুপি-গাউন পরে জাঁকজমক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার স্বপ্ন ছিল। বন্ধুদের সাথে শেষ কিছু স্মরণীয় সময় কাটানো, বিশেষ মুহূর্তের ফটোশুট কিংবা ক্যাম্পাসে শেষ স্মরণীয় কিছু ক্ষণ এসবের কিছুই হয়ে আর উঠলনা এই পরিস্থিতিতে। তাই এ নিয়ে বড় একটা আফসোস রয়েই গেল।”
একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে সদ্য স্নাতক হয়েছেন সিনান আরেফিন। হুট করে প্রিয় উহান শহর আর ক্যাম্পাস ছেড়ে আসার বিষয়টা তার জন্য বেশ হতাশার ছিল। বললেন, ‘চীনের সবচেয়ে সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বুকে সাকুরা বা চেরি ব্লজম উৎসবে সামিল হওয়া, প্রিয় ইস্ট লেকের অনন্য সূর্যাস্ত উপভোগ, রেগানমিয়ানের স্বাদ (চীনা বিশেষ ধরনের নুডলস) নয়তো সবুজ ঢাকা ক্যাম্পাসে হেঁটে বেড়ানোর প্রশান্তি সবই এখন স্মৃতি।
খুব আপন করে নেয়া এই ক্যাম্পাস থেকে অন্তত সমাবর্তনের মধ্য দিয়ে মধুর একটি বিদায় নেয়ার ইচ্ছে থাকলেও তা আর হয়ে উঠল না জানিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সিনান। ‘যেদিন আমাদের চূড়ান্ত থিসিস ডিফেন্স ছিল সেদিন ছিল রোজার সময়। চীনের সময়ে সকাল আটটায় সময়সূচী থাকলেও বাংলাদেশে তখন ভোর ছয়টা। তাই সেহেরির পরপরই বসে গেলাম অনলাইনে থিসিস উপস্থাপনে। বেশ ভালভাবে পাওয়ার পয়েন্টে আমার থিসিস উপস্থাপন করলাম। তবে বিকেলে যখন শিক্ষকেরা আমাদের ফলাফল প্রকাশ করলেন তখন আনন্দের সাথে কাজ করছিল মন খারাপ আর শূন্যতাও।’
প্রতিবছর উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে অন্তত ১০ হাজার শিক্ষার্থী অংশ নিলেও এবার সামাজিক দূরত্ব মেনে মোটে ৬০০ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল বলে জানান তিনি। ‘যেসব বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সেখানে অবস্থান করেছেন কেবল তারাই সমাবর্তনের আমেজ পেয়েছেন। তাই আমাদের জন্য এমন সমাবর্তন আর ক্যাম্পাসকে বিদায় না জানাতে পারার ব্যাপারটা বেশ বেদনার,’ যোগ করেন সিনান।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবারক হোসেন সম্প্রতি তার পিএইচডি অর্জন করেছেন চীনের সেন্ট্রাল চায়না নরমাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পিএইডিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে নির্দেশিত আটটি ধাপ অনুসরণ করতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘থিসিসের প্রাথমিক তথ্য জমা দেয়া থেকে শুরু করে ডিফেন্স সাবকমিটি ও বিভাগের শিক্ষকদের ভোট পর্যন্ত আটটি ধাপে পিএইচডি শেষ করতে হয়েছে। এসব ধাপ যারা উত্তীর্ণ হতে পেরেছে তাদেরই বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি দিয়েছে। আর এবারের বিশেষ পরিস্থিতিতে সব কিছু অনলাইনে হওয়ায় পিএইচডির মতো উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়াটা অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল।’
মোবারক হোসেন জানান, টেনসেন্ট মিটিং নামের একটি বিশেষ চীনা অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইনে থিসিস উপস্থাপন করেছেন।
‘১৩ জন শিক্ষার্থী ও ডিফেন্স কমিটির সামনে এই অ্যাপের মাধ্যমে খুব সহজেই আমি আমার পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে পুরো থিসিসের সারাংশ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমাকে মোট সময় দেয়া হয়েছিল ১৫ মিনিটের মতো,’ বলেন মোবারক। ‘চলমান পরিস্থিতিতে অনলাইনে যেহেতু আমাদের থিসিস তুলে ধরতে হয়েছে সেহেতু আমি ভেবেছিলাম এ নিয়ে শিক্ষকদের মূল্যায়ন ও নম্বর দেয়ার বিষয়টিতে খুব একটা কড়াকড়ি থাকবে না। অথচ তারা অন্যান্য সময়ের মতোই খুব কঠোরতা মেনে শিক্ষার্থীদের থিসিসের অনুমোদন দিয়েছেন।’
খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে সমাবর্তনের মধ্য দিয়ে ডিগ্রি উদযাপনের ইচ্ছে থাকলেও তা আর হয়ে উঠল না বলে আফসোস রয়ে গেছে তরুণ এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের। উপরন্তু জানলেন, পিএইচডির সনদ সমাবর্তনের মাধ্যমে পাননি বরং উহানে থাকা আরেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী তার পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে সেটি গ্রহণ করে দেশে পাঠিয়েছেন।
চীন থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী আরেক বাংলাদেশি জেসমিন আক্তার। গেল ২৮ জুন চায়না ইউনিভার্সিটি অব জিওসায়েন্সেসের এ্যাপ্লাইড সাইকোলজি থেকে অনলাইনে উচ্চতর এই ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। তার মতে, গ্রাজুয়েশন সেরিমনিতে অংশ না নিয়ে গ্রাজুয়েট হওয়াটা আসলে এক ধরনের দুর্ভাগ্য। তবে করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এখন এমনতর ডিগ্রি পাওয়ার বিষয়টি না চাইলেও মেনে নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘করোনার প্রকোপ থেকে বাঁচতে চীন থেকে দেশে ফিরে আসি ফেব্রুয়ারিতে। এরপর থেকে উইচ্যাট বা ডিংটকের মতো চাইনিজ অ্যাপ ব্যবহার করে শিক্ষকদের সাথে থিসিসের ব্যাপারে যোগাযোগ রাখি। অনলাইনে তাদের সাথে নিয়মিত কথা হলেও আসলে এভাবে থিসিস চূড়ান্ত করা নিয়ে নানা সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়।’
দেশে বসে নিজের ঘর থেকে চূড়ান্ত থিসিস তুলে ধরার সময় ইন্টারনেটের গতি আর লোডশেডিংয়ের কারণে বেশ দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে জেসমিনের।
‘আমার থিসিস উপস্থাপনের আগে থেকেই বেশ কয়েকবার লোডশেডিং হওয়ার কারণে খুব টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম। পরে ঠিক সময়ে বিদ্যুৎ আসলেও মাঝে মধ্যে ইন্টারনেটের গতির কারণে অনলাইন মিটিং থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হয়েছিল। কখনও কখনও ভিডিও বন্ধ করে অডিওতে চালাতে হয়েছে ডিফেন্স মিটিং,’ অনেকটা হতাশার সুরেই বললেন তিনি।
তবে এত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শেষমেশ তার থিসিস, কমিটিতে গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে জানালেন সদ্য এই ডক্টরেট ডিগ্রিধারী। সমাবর্তন নিয়ে অনেক আবেগ আর উৎসাহ দীর্ঘদিন ধরে জমিয়ে রাখলেও তা না পাওয়ার আফসোসের সুর শোনা গেল এই বাংলাদেশির কথাতেও।
(লেখক: চীনের উহানের সেন্ট্রাল চায়না বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী (বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন)
Comments