‘লেইক অফ দা ওযার্কস’ এবং ‘হাহা টংকা’ স্টেট পার্ক ভ্রমণ
‘ওযার্ক’ নামের ক্রাইম থ্রিলার টেলিভিশন সিরিজটি অনেকের দেখা। এই সিরিজ যে এলাকার উপর নির্মিত, সেই এলাকার একটা অংশ ঘুরে এসেছিলাম ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর। ওযার্ক হলো আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের চারটি অঙ্গরাজ্য - আরকান্সা, মিজৌরি, ক্যান্সাস আর ওকলাহোমার উপর অবস্থিত পর্বতশ্রেণি এবং মালভূমি। আমরা যেহেতু মিজৌরিতে থাকি, তাই ঘুরে এসেছি মিজৌরিতে অবস্থিত ‘লেইক অফ দা ওযার্কস’ স্টেট পার্কে, যেটা মিজৌরির সবচেয়ে বড় স্টেট পার্ক।
প্রথম সেমিস্টার শেষে বিশাল একটা ছুটি পেয়েছি। কিন্তু এই ছুটি কীভাবে কাজে লাগাব, বুঝতে পারছিলাম না। চেনাজানা ভাইয়েরা কেউ বাংলাদেশে গেছেন বিয়ে সারতে, কেউ ফ্লোরিডা যাচ্ছেন মায়ামি বিচে ঘুরতে। আমি আর আমার হাজবেন্ড প্রিন্স টাকার অভাবে বাসায় বসে ঝিমুচ্ছি আর ভাবছি সাইকেল দিয়ে যদ্দূর পারা যায়, সেন্ট লুইস শহরটা ঘুরে দেখব। এখানকার অধিকাংশ দর্শনীয় স্থানেই বিনামূল্যে প্রবেশ করা যায়। যেমন, বিজ্ঞান জাদুঘর, ইতিহাস জাদুঘর, চিড়িয়াখানা। সব অঙ্গরাজ্যে কিন্তু এমন বিনামূল্যে প্রবেশের সুবিধা নেই। তাও আমাদের এগুলো দেখা হয়নি। লজ্জা, লজ্জা! ২২ ডিসেম্বর রাতে হঠাৎ আনজাম ভাই কল দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা আগামীকাল ‘লেইক অফ দা ওযার্কস’ স্টেট পার্কে যেতে চাই কিনা। অবশ্যই যেতে চাই। আমাদের হাতে অফুরন্ত অবসর। ঠিক হলো, ২৩ তারিখ সকাল সাতটায় আমরা রওনা দেব, যেতে লাগবে তিন থেকে চার ঘণ্টা। সারাদিন পার্কে কাটিয়ে বিকেল নাগাদ বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেব, রাস্তায় ডিনার সারব। শাওন চে ভাই তার গাড়িতে করে আমাদের নিয়ে যাবেন। আমাদের এখানে দু’দুটো শাওন ভাই আছেন। দুজনই রসায়নে পিএইচডি করছেন, দুজনই সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। যেন গুলিয়ে না ফেলি, সেজন্য একজনকে শুধু শাওন, আরেকজনকে শাওন চে ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শাওন চে নামটা উনার নিজের দেওয়া। এই Che কি কেমিস্ট্রি থেকে এসেছে, নাকি চে গুয়েভারা থেকে, সে এক রহস্য। উনিও ভাঙতে চান না।
মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিশে পরিকল্পনা হয়ে গেল। এ ধরনের পরিকল্পনাগুলোই টিকে যায়। যেগুলো অনেকদিন ধরে করা হয়, সেগুলো বেশিরভাগই শেষ মুহূর্তে বানচাল হয়ে যায়। তো, সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ আমাদের এপার্টমেন্টের সামনে শাওন ভাইয়ের গাড়ি উপস্থিত। শহর থেকে বের হওয়ার আগে উনি ম্যাকডোনাল্ডসে থামলেন। কফি খাওয়া প্রয়োজন। খানিকক্ষণ পরযখন শহর থেকে বের হয়ে প্রকৃতির কোলে পড়লাম, আমার অবস্থা হতভম্ব। পাহাড়ি এলাকা কেটে রাস্তা তৈরি হয়েছে। পুরো রাস্তাই উঁচুনিচু, আঁকাবাঁকা, তবে ভাঙাচুরা নেই। মসৃণ পিচঢালা রাস্তা ধরে গাড়ি সাঁই সাঁই করে ছুটতে লাগল। রাস্তার দুই ধারে সবুজ তৃণভূমি, কিন্তু শীতের কারণে ঘাসগুলো মরে যেতে শুরু করেছে। তার উপরেই চরে বেড়াচ্ছে গরুর পাল। গরুগুলোর চেহারা বাংলাদেশের গরুর চেয়ে আলাদা। একটাই রঙ দেখলাম এদের, কালো। আর অনেক বেশি মাংসল।
শুধু গরুই না, চারণভূমিতে আরও আছে ঘোড়ার দল। গরু, ঘোড়া যারা পালে, তাদের বাড়ির আশেপাশে দেখলাম বিশাল বিশাল গোলাঘর। গোলাঘরের সামনে দাঁড়ানো এক বা একাধিক পিক-আপ ভ্যান। প্রতিটা বাড়িতেই, সেডান না থাকুক, পিক-আপ আছে। ক্ষেত খামারে কাজ করতে হলে জিনিসপাতি বয়ে নিয়ে যেতে হয়। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার নেই। সেগুলো কেনার জন্য ঘন ঘন শহরে যাওয়ার সময়ও গ্রামবাসীদের নেই। তাই একমাসের যোগান একেবারে কিনে আনার জন্য দরকার পিক-আপ ভ্যান। ক্ষেত খামারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গোলাকার খড়ের গাদা (Hay Bale)। এগুলো শুকিয়ে গবাদি পশুর খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি যে, গ্রামের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। গ্রাম বলতে আমার চোখে ভাসে মাটির ঘর, গোবর ছড়ানো গোয়ালঘর, কলাগাছ দিয়ে ঘেরা স্নানঘর আর পুস্কুনি (পুকুরের আঞ্চলিক নাম)। অথচ এখানকার গ্রামের চেহারা পুরোপুরি ভিন্ন। শহরের মতো পাকা বাড়ি, একাধিক গাড়ি (কোনো বাড়ির সামনেই মাত্র একটা গাড়ি দেখিনি), আস্তাবল (গরু-ঘোড়ার জন্য হতে পারে), বিশাল ক্ষেত, গোলাঘর। মাঝে মাঝে কিছু টলটলে পরিষ্কার পানির জলাশয় চোখে পড়ে। গ্রাম পার হয়ে কিছুদূর এগোনোর পর বরফ পড়া শুরু হল। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে দেখেছি সারাদিন মেঘাচ্ছন্ন থাকবে। তাই বলে বরফ পড়বে, এটা দেখায়নি। হঠাৎ আনজাম ভাইয়ের মনে পড়ল, পূর্বাভাস দেখায় যিপ কোড অনুযায়ী। আমরা দেখেছি সেন্ট লুইস শহরের যিপ কোডের পূর্বাভাস। অথচ এটা সেন্ট লুইসের বাইরের এলাকা। এখানকার পূর্বাভাস স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন হবে। উনি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘১৭১ মাইল রাস্তা যেতে হবে। এর মধ্যে বরফ, বৃষ্টি, মেঘ, রোদ সবই পাব আশা করি।’ সত্যিই, একটু পর দেখি বরফ কেটে গিয়ে রোদ উঁকি মারছে। কী যে ভালো লাগল!
একটু পর দেখি হাতের ডানে সিক্স ফ্ল্যাগস থিম পার্কের সাইন দেখাচ্ছে। আনজাম ভাই জানালেন, এখানকার রাইডগুলো চরম। তবে সবগুলো রাইডই উচ্চতা সংক্রান্ত। আমি Acrophobia বা উচ্চতাভীতির রোগী বলে এসব রাইডে চড়ি না। ভীতু বলে অপমান করলেও না। এরপর আবার শুরু হল গ্রামাঞ্চল। একসময় হাতের বামে পড়ল মিরামেক গুহা। এটা মিজৌরির অন্যতম আকর্ষণ। ৭.৪ কিলোমিটার লম্বা গুহায় আপনাকে নিয়ে গাইড ঘুরে বেড়াবে, দেখাবে মিলিয়ন বছরের পুরানো চুনাপাথরের সৌন্দর্য। পুরানো জিনিস আমাকে সবসময় টানে। তাই এখানে আসার ইচ্ছে আছে। তাছাড়া স্ট্যালাক্টাইট (খনিজ পদার্থের তৈরি ছাদ থেকে পানি চুইয়ে তৈরি হওয়া খনিজ দণ্ড) আর স্ট্যালাগ্মাইট (খনিজ পদার্থের তৈরি ছাদ থেকে পানি চুইয়ে মেঝেতে পড়ে মেঝে থেকে তৈরি হওয়া খনিজ দণ্ড) দেখার ইচ্ছে বহু বছরের। গুহার ভেতর এসব জমে তৈরি করে অদ্ভুত সৌন্দর্য।
১৭১ মাইল মানে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে চট্টগ্রাম পার হয়ে আরো ১৯ মাইল। বুঝুন ঠ্যালা! কিন্তু ফাঁকা রাস্তায় আমরা রাজা। এমনও সময় গেছে যখন মাইলের পর মাইল শুধু আমাদের গাড়ি, আর কেউ নেই। হঠাৎ ঘটল দুর্ঘটনা। পাহাড়ি রাস্তার দোলায় অনেকক্ষণ ধরেই খারাপ লাগছিল। একসময় পেটের ভিতর প্রচণ্ড জোরে পাঁক দিয়ে উঠল। আমি কোনোমতে বললাম, ‘বমি আসছে।’ শাওন ভাই হাইওয়ের কোথায় গাড়ি পার্ক করবেন ঠিক করতে পারছেন না। আনজাম ভাই বললেন, ইমারজেন্সি সাইন দিয়ে রাস্তার ধারে পার্ক করে ফেলতে। কিন্তু শাওন ভাই উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না। আমার তর সইল না। জানালা খুলে বমি করে দিলাম। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে ঠোঁট আর গাল জমে বরফ হয়ে গেল, কিন্তু ভাল লাগছিল ভীষণ। অনেকক্ষণ পর মুক্ত বাতাসে দম নিলাম। একটু পর শাওন ভাই একটা ‘ডলার জেনারেল’ স্টোর পেলেন। সেখানে পার্ক করলেন যেন ওয়াশরুমে গিয়ে তরতাজা হতে পারি।
একাউন্টসে যে মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন, তার ডান হাত প্লাস্টার করা। বাম হাত দিয়েই সব কাজ সারছেন। জিজ্ঞেস করলাম, উনাদের এখানে ওয়াশরুমের ব্যবস্থা আছে কিনা। মহিলা একটা চাবি দিয়ে বললেন, দোকানের শেষ মাথায় ওয়াশরুম আছে। আমি আর শাওন ভাই হাতমুখ ধুয়ে এলাম। একটা Fritos Corn Chips কিনলাম যেন বমি ভাবটা দূর করতে পারি। এই চিপস দারুণ জনপ্রিয় হলো সবার কাছে। এত মজা করে সবাই খাবে জানলে আরও কয়েক প্যাকেট কেনা যেত। একটু পর আসলাম একটা মফস্বলে। এখানে কিছু দোকানপাট দেখা গেল, তারপরও খুব শান্ত, নীরব। এত নীরবতা কেমন যেন অদ্ভুত লাগে। আমরা যে এতদূর গেলাম আর এলাম, রাস্তায় একটাও মানুষ দেখিনি। শুধু গাড়ি আর গাড়ি।
মফস্বল পার হয়ে আরও কয়েক মাইল চালানোর পর এল কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যস্থল ‘লেইক অফ দা ওযার্কস স্টেট পার্ক’। এখানে কোনো প্রবেশ মূল্য নেই, নেই গাড়ি পার্কিং ফি। পার্কিং স্পট থেকে কয়েক কদম এগুলেই ওযার্ক হ্রদ। হ্রদে নৌকা নিয়ে ঘুরা যায়। যে জেটি থেকে নৌকা ছাড়ে, সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা কিছুক্ষণ হাওয়া খেলাম, বিস্ময় নিয়ে চারিদিক দেখলাম, ছবি তুললাম। জেটিতে দাঁড়িয়ে সবাই কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল। চারপাশে পাহাড়, মাঝে এই হ্রদ। এক আমলে এই অঞ্চলে আমেরিকান আদিবাসীদের বাস ছিল। তাদের প্রাণচাঞ্চল্যে মুখরিত হতো ওযার্ক হ্রদ। আনজাম ভাই উদাস হয়ে বললেন, ‘এই হ্রদে হয়ত কোনো নেটিভ আমেরিকান এসে ঘোড়াকে পানি খাওয়াত! অথচ সেটলাররা কী করেছে জায়গাটাকে। দখলে নিয়ে জেটি বানিয়েছে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করেছে।’ নষ্ট করার পরও যা আছে, সেটা দেখে দম বন্ধ হওয়ার দশা। হয়ত আধুনিক জনগণ পার্কের ভেতর ক্যাম্প সাইট বানিয়েছে, বসার বেঞ্চি দিয়েছে, ছোট ছোট কেবিন বসিয়েছে, কিন্তু প্রকৃতির বিশালত্ব আটকাতে পারেনি। পার্কের গাছপালা প্রচণ্ড শীতে নগ্ন হয়ে পড়েছে। চারদিকে শুধু ধূসর রঙ। ফল সিজনে এলে লাল, হলুদ, সবুজ আর কমলা রঙয়ে চারদিক ভরা থাকত। প্রকৃতি তার যৌবন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। অবশ্য বার্ধক্যেরও আলাদা সৌন্দর্য আছে। তাই শুকনো বনজঙ্গল দেখতেও ভাল লাগল।
দুপুর আড়াইটা বাজে। সূর্য মোটামুটি হেলে পড়ার দিকে। চিন্তা করলাম, এখানে পুরো সময় না কাটিয়ে আশেপাশের আরও কিছু দর্শনীয় স্থান দেখে যাই। আবার এখানে আসা হবে কিনা, কে জানে। স্বল্প সময়ের ভেতর যতখানি দেখে নেওয়া যায়। এরকম ঘুরে বেড়ানো আমার আর প্রিন্সের পছন্দ নয়। আমাদের পছন্দ সময় নিয়ে ঘোরা। কোথাও যাব, সময় লাগিয়ে ধীরে ধীরে উপভোগ করব, তাড়া থাকবে না ফেরার। কিন্তু এটা একদিনের ভ্রমণ, ধীরে ধীরে দেখা সম্ভব না। তাই বেশ কিছু স্পট দেখার পরিকল্পনা করা হলো। পার্ক থেকে কাছে পিঠে আছে ‘স্টার্ক ক্যাভার্’ নামের গুহা আর ‘হা হা টংকা’ নামের আরেকটা স্টেট পার্ক। এই পার্কের ভেতর আছে ‘ক্যাসেল রুইন্স’ নামের ঐতিহাসিক দালান। হা হা টংকা নামটা আমার ভীষণ পছন্দ হলো। শুনেই মনে হলো, আদিবাসীদের ভাষা থেকে উদ্ভূত নাম। গুগল ঘেঁটে দেখলাম, অনুমান ঠিক। এই এলাকায় আগে চেরোকি, ওসেজসহ অন্যান্য আমেরিকান আদিবাসী গোষ্ঠীর বাস ছিল। ওসেজদের ভাষায় ‘হা হা টংকা’ মানে হল ‘জলের হাসি’। এখানে বেশ কিছু ঝর্ণঅ আছে যেগুলোর কারণে জায়গাটার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘হা হা টংকা’। আমরা ওযার্কস স্টেট পার্ক থেকে বের হয়ে এগুলাম স্টার্ক ক্যাভার্নের দিকে। ভেবেছিলাম এটাও সরকারি সম্পত্তি, প্রবেশমূল্য নেই। কিন্তু যাওয়ার পথে জায়গায় জায়গায় বিলবোর্ড দেখে আনজাম ভাই সন্দেহ করলেন, এটা ব্যক্তি মালিকানাধীন। গিয়ে দেখলাম, সত্যি। গুহায় প্রবেশমূল্য চার বছর বয়স পর্যন্ত ফ্রি হলেও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ১৮ ডলার। আমাদের কোনোভাবে চার বছরের রেঞ্জে ঢুকানো যায় কিনা, ভাবতে ভাবতে ফিরে এলাম গাড়িতে। চললাম হা হা টংকার দিকে।
ওযার্কস পার্ক থেকে বের হওয়ার পর রাস্তাগুলো খুব বেশি খাড়া হয়ে গেল। আগে তাও রাস্তার দু’ধারে তৃণভূমি বা সমতল ভূমি ছিল। কিন্তু এখনকার রাস্তার ধারে খাড়া করে পাহাড় কাটা। পড়লে মরণ ছাড়া গতি নেই। প্রিন্সের মনে হচ্ছে, নিড ফর স্পিডের বাস্তব ভার্সন খেলা হচ্ছে। আনজাম ভাই বললেন, ভার্চুয়াল খেলায় অন্তত লাইফ পাওয়ার সুবিধা ছিল। হাহা হিহি করতে করতে পৌঁছে গেলাম হা হা টংকায়। গাড়ি পার্ক করার জায়গা থেকে পায়ে হাঁটা পথ চলে গেছে বনের ভিতরে। তীর চিহ্ন দিয়ে দেখানো হচ্ছে, এই পথ ধরে এগুলে ক্যাসেল রুইন্স বা দালানের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যাবে। চার পর্যটক হাঁটা শুরু করলাম। গাড়ির ভেতরে ছিলাম বলে উঁচুনিচু রাস্তা অতটা টের পাইনি, হাঁটতে গিয়ে টের পেলাম। মিনিট দশেক হাঁটার পর হাতের বাম পাশে দেখলাম ছোট্ট একটা দালানের ধ্বংসস্তূপ। চরম হতাশ হলাম। এই জিনিস দেখার জন্য এত কষ্ট করেছি? হঠাৎ আনজাম ভাই চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হাতের ডানদিকে আসল দালান!’
বামদিকে দাঁড়িয়ে আছে আঠার’শ শতাব্দীর ডাকঘর, আর ডানদিকের পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়ানো উনিশ’শ শতাব্দীর এক দুর্গ। ডাকঘরের দিকে তাকিয়ে সুদূর অতীতে চলে গেলাম। আজ থেকে দুইশ বছর আগে এই গহীন জঙ্গলে কে কাকে চিঠি পাঠাত? একটা দুর্গের বাসিন্দাদের জন্যই কি ডাকঘর বানানো হয়েছিল? নাকি আরও সেটলার বাস করত এখানে? ডাকঘর থেকে দুর্গ পর্যন্ত উঠার পথে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ ডেক চোখে পড়ে। এসব ডেকে দাঁড়িয়ে হা হা টংকার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আমরা ডেকে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। অপার্থিব সৌন্দর্য। এত নীরব, শান্ত, বিশাল আর চোখ ধাঁধানো প্রকৃতি! শাওন ভাই বলতে লাগলেন, ‘মইরা যাইতে ইচ্ছা করতেছে। এই দৃশ্য দেখার পর মানুষ বাঁইচা থাকে কেমনে?’ সত্যি। এরকম দৃশ্য দেখলে বুকের ভিতর হাহাকার তৈরি হয়। যেন সবটুকু দিয়েও এই সৌন্দর্য আমি নিজের ভেতর ধারণ করতে পারছি না, উপভোগ করতে পারছি না, দেখে তৃপ্তি আসছে না। বিস্ময়কর এক অনুভূতি।
ডেকের ঠিক নিচেই খাড়া পাহাড় নেমে গেছে। পাহাড়ের গাছপালার ভেতর দশ বারোটা ঈগল বাসা বেঁধেছে। হ্রদের উপর উড়ে বেড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে তারা বাসায় এসে উঁকিমেরে যাচ্ছে। হয় ছানাপোনা আছে, নয় বিশ্রাম নিচ্ছে। সবসময় বিবিসির ডকুমেন্টারি অথবা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে এসব দৃশ্য দেখেছি। আজ স্বচক্ষে দেখে হারিয়ে গেলাম। পাহাড়ের নিচে যে হ্রদ, সেটার চারপাশে ট্রেইল আছে। হাতে সময় নেই বলে ট্রেইল ধরে হাঁটতে পারলাম না। এমনকি যেসব ঝর্ণার কারণে নাম হা হা টংকা হয়েছে, সেসব ঝর্ণা দেখারও সময় পেলাম না। দ্রুত ক্যাসেল রুইন্সের (Castle Ruins) দিকে এগোলাম। রুইন্স বলা হয় কারণ এটা একটা দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। ক্যানসাস সিটির ধনাঢ্য ব্যবসায়ী রবার্ট স্নাইডার ১৯০৩ সালে হাহা টংকা হ্রদ আর এর আশেপাশের জায়গা খরিদ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন এখানে একটা দুর্গ বানাতে, যেন গ্রীষ্মকালে অবকাশ যাপন করার জন্য আসতে পারেন। ১৯০৫ সালে এই দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ১৯০৬ সালে এক দুর্ঘটনায় পড়ে রবার্টের মৃত্যু হলে তার তিন ছেলে দুর্গের কাজ শেষ করেন। ১৯৪২ সালে এক ভয়ংকর অগ্নিদুর্ঘটনায় দুর্গটা ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর মিজৌরি অঙ্গরাজ্য এই দুর্গ কিনে নেয় এবং মেরামত করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। দুর্গের ধ্বংস হওয়ার আগের ছবি আর ধ্বংস হওয়ার পরের অবস্থা দেখে গা শিরশিরে অনুভূতি হল। একসময় এখানে স্নাইডার পরিবারের পদচারণা ছিল। ছিল মুখরিত পরিবেশ। অথচ সেই সময়ের ইতিহাস বুকে নিয়ে কয়েকটা দেওয়াল এখন দাঁড়িয়ে আছে একাকী। রুইন্স দেখে রওনা দিলাম গাড়ির দিকে। বনের ভিতর দিয়ে হাঁটার সময় রোমাঞ্চ হচ্ছিলো খুব। এই পথ ধরে হয়ত কোনো একসময় আমেরিকান কোনো আদিবাসী শিকারি হেঁটে বেড়িয়েছে, শিকার ধরেছে। প্রতি পদে এখানে অতীতের হাতছানি।
গাড়িতে উঠে প্রথম কথাই হল, খিদে পেয়েছে। কাছেপিঠের একটা চৈনিক রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। খাওয়া শেষ করে যখন সেন্ট লুইসের দিকে রওনা দিলাম, আকাশে উঠল এক বিশাল চাঁদ। আজকের সবকিছুই বিশালত্ব দিয়ে ঘেরা। পূর্ণিমা নাকি? ঝলসানো রুটির মত চাঁদটাকে হয়ত খেতে ইচ্ছে করত পেট খালি থাকলে! কিন্তু ভুঁড়িভোজ শেষে এখন শুধু সৌন্দর্য অবলোকনের পালা। শহর থেকে অনেক দূরে আছি বলে তেমন আলোক দূষণ নেই। গাড়ির হেডলাইটের আলো বাদ দিলে চারদিক বেশ অন্ধকার। তাই আকাশ ভর্তি নক্ষত্র দেখা গেল। চাঁদের কারণে যদিও নক্ষত্রগুলো ফুটে উঠতে পারছে না, কিন্তু যা দেখলাম সেটাই অনেক। আবারও অতীতে ফিরে গেলাম। হাজার বছর আগে নিশ্চয় আমাদের পূর্বসূরিরা রাতের আকাশের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকত! নিশ্চয় ভাবত, ওগুলো কী? অপার বিস্ময় নিয়ে দেখত এই সৌন্দর্য। হাজার বছর পর আমি জানি, ওগুলো কী। তাও পূর্বসূরির মতোই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকি, হাঁ করে দেখেও তৃপ্তি মেটে না…
(লেখক: স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র)
Comments