এখন সময় একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর যুবকরা মহামারির মাঝে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অভাবগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করছেন। ছবিটি বান্দরবন থেকে তোলা। ছবি: সবুজ খামের সৌজন্যে

মার্চের মাঝামাঝিতে দেশে যখন কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো তখন গারো সম্প্রদায়ের একজন কবি ও প্রকাশক মিঠুন রাকসাম একটি ফোন কল পেলেন পরিচিত একজনের কাছ থেকে। সঙ্গে পেলেন একটি হৃদয় বিদারক খবর।

ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন একজন গারো নারী। তিনি চাকরি করতেন একটি বিউটি পার্লারে। করোনার প্রভাবে চাকরি হারাতে হয়েছে তাকে। শুধু তিনিই নন, এই মহামারি তার স্বামীর চাকরিও ছিনিয়ে নিয়েছে।

মিঠুন বলেন, ‘দুই সন্তানের মা এই নারী আমাকে জানায় সপ্তাহখানেক ধরে তাদের ঘরে ভাত নেই। বেঁচে আছেন শুধুই রুটি খেয়ে। মিরপুরের যে এলাকায় তারা থাকেন সেই এলাকা লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে। আর সেই সঙ্গে তাদের আর্থিক অবস্থা ক্রমেই খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’

তাদের এই অসহায়ত্ব মিঠুনের মনে দাগ কেটে যায়। নিজের কাছে থাকা যৎসামান্য টাকা নিয়েই তিনি নেমে পরেন রাজধানীতে বাস করা এমন অসহায় গারো পরিবারের পাশে দাঁড়াতে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ৫০টি পরিবারে ত্রাণ পৌঁছে দেন আর সেই সঙ্গে আরও অনেককে যুক্ত করেন এই প্রচেষ্টার সঙ্গে।

তার মতো আরও বেশ কিছু যুবক তাদের সম্প্রদায় এবং মানবতার প্রতি কর্তব্য হিসেবে অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন অলিক ম্রি। তিনিও অন্যান্য গারো যুবকদের সঙ্গে এই সংকট মোকাবিলায় সাহায্য করতে শুরু করেন।

তারা টাঙ্গাইলের মধুপুরে ৩০০ পরিবারে এবং ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় ২০০ পরিবারে ত্রাণ বিতরণ করেন। এর জন্য তারা তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করেন।

নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে অলিক ম্রি বলেন, ‘গারো সম্প্রদায়ে মানুষ কখনও এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। তারা ত্রাণ নিতে অভ্যস্ত না। প্রথম দিকে তো তারা নিতেই চায়নি। অনেকে লজ্জায় তাদের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে আমাদের জানায়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবকদের নিরাপত্তা একটি উদ্বেগের বিষয় ছিল। আমরা এই কাজে দায়িত্বশীলদের জড়িত করার চেষ্টা করেছি। তাদের নিরাপত্তার জন্য মাস্ক এবং গ্লাভস দিয়েছি। সংক্রমিত হয়েছে এমন পরিবারে যারা ত্রাণ দিতে গিয়েছে তাদের যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’

রাজশাহীতে এমনই একজন স্বেচ্ছাসেবক তরুণ মুন্ডা। সদিচ্ছা থাকার পরও তিনি অলিকের মতো এতো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে পারেননি তহবিলের অভাবে।

তরুণ বলেন, ‘উত্তর অঞ্চলে আমরা মূলত মুন্ডা, সাঁওতাল এবং ওরাও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করি। আমরা এখন পর্যন্ত নওগাঁ, দিনাজপুর এবং নাটোরের ১৫০টি পরিবারের কাছে পৌঁছতে পেরেছি।’

সেখানকার অবস্থা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘সেখানে এমনও পরিবার আছে যাদের কাছে এখনও সরকারি সহযোগিতা পৌঁছেনি এবং অর্থের অভাবে আমরাও তাদের সাহায্য করতে পারিনি।’

চাকমা সম্প্রদায়ের প্রমী খিসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি ‘সবুজ খাম’ নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে কাজ শুরু করছেন। গত ২৩ এপ্রিল চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের যুবকদের উদ্যোগে এটি তৈরি করা হয়েছে।

তিনি জানান, তাদের এই সংগঠন থেকে রাঙ্গামাটি, বান্দরবন ও খাগড়াছড়িতে বেশ কয়েকটি গ্রাম পরিদর্শন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তারা ৬৪০টি পরিবারের মাঝে খাবার বিতরণ করেছে এবং দেড় শতাধিক নারীকে স্যানিটারি ন্যাপকিন ও সাবান দিয়েছে। তারা তাদের তহবিল তৈরি করেছে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে। যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করার জন্য যেতে পারেনি তার অনুদান দিয়ে সহযোগিতা করেছে।

তিনি গ্রামবাসীর পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমরা রাঙ্গামাটির একটি গ্রামে গিয়ে দেখি একটি জমিতে প্রচুর পচা পেঁপে পরে আছে। আশেপাশের সব বাজার বন্ধ থাকায় এবং চলাচল নিষিদ্ধ হওয়ায় তারা সেগুলো বিক্রি করতে পারেননি।’

বাংলাদেশে জাতিসংঘের স্বেচ্ছাসেবক সমন্বয়ক আক্তার উদ্দিন বলেন, ‘স্বেচ্ছাশ্রম দিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর যুব বয়সীরা বদ্ধ পরিকর। এই মহামারির মধ্যে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কয়েকশ যুবক তাদের সম্প্রদায়ের মানুষকে উদ্ভাবনী উপায়ে সহায়তা করেছে।’

‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই তরুণরা সংকটের শুরুতেই কাজ করেছে। এই মহামারি এসে আবার প্রমাণ হয়েছে যে যুবকদের স্বেচ্ছাশ্রম কতটা গুরুত্বপূর্ণ। স্বেচ্ছাশ্রমে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করার জন্য তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া দরকার,’ বলে তিনি যোগ করেন।

আজ বিশ্ব আদিবাসী দিবস। এ বছর এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ‘কোভিড-১৯ এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মানুষের স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরা’।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago