‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আত্ম-অধিকার অস্বীকারের মানে, নিজেদের অধিকার অস্বীকার’
বেড়াতে যেতে চাইলে আমরা প্রথমেই ভাবি পাহাড়ে বা সমুদ্রে যাওয়ার কথা। তিন পার্বত্য জেলা- রাঙামাটি, বান্দরবান কিংবা খাগড়াছড়িকে আমরা এখন পুরোটাই টুরিস্ট স্পট বানিয়ে ফেলেছি। পাহাড়ে বেড়ানো, পাহাড়ি রান্না খাওয়া, পাহাড়িদের বাড়িতে থাকা, তাদের সাংস্কৃতিক উৎসব উপভোগ করি। রাশ মেলা, বিজু, নবান্ন, ওয়ান্নাগালা কোনো উৎসবই বাদ দেই না, সবই আমাদের আনন্দের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাহাড়ে বেড়ানোটা মানুষের কাছে এতটাই আকর্ষণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, দু’দিনের ছুটি পেলেই মানুষ দলে দলে পাহাড়ে ছুটে যায়। এই সময়গুলোতে সেখানে থাকার মতো জায়গার অভাব দেখা যায়। যদিও হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট দিয়ে এই তিন পার্বত্য জেলা ভরে গেছে, এরপরও টুরিস্টদের প্রবল চাপ থাকে। জায়গা দিতে হিমশিম খেতে হয়। রীতিমতো খাবার-দাবারের চড়া দাম হয় এবং হোটেলসহ খাওয়া খরচ বেড়ে যায়।
অবশ্য এক্ষেত্রে লাভ হয় দুই পক্ষেরই। আমরা বাইরে থেকে গিয়ে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করি। আর ওদের লাভ ব্যবসা-বাণিজ্য হয়, আয় বাড়ে, নিজেদের অনেক জিনিস বিক্রি করতে পারে। পাহাড়ি পণ্যের ব্যাপক বাজার সৃষ্টি হয়েছে। তবে মুশকিল হচ্ছে অন্য জায়গায়, এই হোটেল-মোটেল করার সময় অনেক ক্ষেত্রেই পরিবেশ আইন মানা হচ্ছে না। পাহাড়িদের নাম ভাঙিয়ে বাঙালিরা ভবন বা রিসোর্ট তৈরি করছে, এমন অভিযোগও আছে।
তবে সবচেয়ে মর্মান্তিক যে সত্যটি বেরিয়ে আসে, সেটি হলো- এই পাহাড়িদের প্রতি আমাদের চলমান উপেক্ষা। ‘কাজের বেলায় কাজি, কাজ ফুরালে পাজি’ এই কথাটির একদম সঠিক চিত্র পাহাড়িদের প্রতি আমাদের এই উপেক্ষা। আমরা পাহাড়ে বেড়াতে যাই, আনন্দ করি কিন্তু ফিরে এসে ভুলে যাই সেখানকার মানুষগুলোর দুঃখ-দুর্দশার কথা, তাদের না পাওয়ার কথা, তাদের প্রতি অবহেলা ও অসম্মানের কথা। আমরা কি কখনো জানতে চাই প্রতিদিন পাহাড়ে কত মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে? কতজন হানাহানিতে মারা যাচ্ছে, পাহাড় কেটে সাবাড় করছে কারা, বনভূমি উজাড় করছে কারা, করোনার এই নিদানকালে তাদের খাবার আছে কি না, কত পাহাড়ি নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বা যৌন হয়রানির শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে? না আমরা খোঁজ রাখি না, রাখতে চাইও না।
এই উপেক্ষার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পেয়েছি এই করোনাকালে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ করোনাকালে সরকারের প্রণোদনা সহায়তা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়েছে। আর তিন পার্বত্য জেলাসহ সমতল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাত্র ২৫ শতাংশ পরিবার এই সহায়তা পেয়েছে। তিন পার্বত্য জেলা ও সমতলে সাঁওতালসহ অন্য জাতিগোষ্ঠীর মাত্র ৪ হাজার ১০০টি উপকারভোগী পরিবার সরকারি সুবিধা পেয়েছে, যা শতকরা ২৫ শতাংশ। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় বাড়ছে বেকারত্ব ও অভাব। সমতল নৃগোষ্ঠীদের একটি বড় অংশ না খেয়ে বা একবেলা খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। রাজা দেবাশীষ রায় বলেছেন, ‘নৃগোষ্ঠীদের জন্য যে ত্রাণ তা খুবই অপ্রতুল। অনেকেই এখন একবার দিনে খাবার খাচ্ছেন। কাগজে-কলমে যে সাহায্য সহযোগিতার কথা বলা হচ্ছে, তা আসলে পাচ্ছে না।’ বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগী সংগঠনগুলো তাদের প্রকল্প এলাকা থেকে এই তথ্য দিয়েছে। অন্যদিকে ২১ হাজার ৮২৬ জন দলিত ও হরিজন, ২৯ হাজার ৬৩১ জন প্রতিবন্ধী, ৪৯ হাজার ২৩৯ জন জেলে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়কালে সরকারি কোনো সহায়তাই পাননি।
করোনাকালে প্রণোদনা সহায়তার অংশ হিসেবে সরকার ভিজিএফ এবং ভিজিডি কর্মসূচির আওতায় খোলাবাজারে কম দামে চাল বিক্রি এবং সামাজিক সেফটি নেট কর্মসূচির উদ্যোগ নিয়েছিল। এ ছাড়া, সরকার করোনাকালে ৫০ লাখ দুস্থ মানুষের মাঝে বিতরণের জন্য ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। কিন্তু জুলাইয়ের ৭ তারিখ পর্যন্ত মাত্র ১৬ লাখ মানুষ এই টাকা পেয়েছেন। বাকি ৩৪ লাখ মানুষ এখনো সেই সহায়তা পাননি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাষ্য অনুযায়ী সরকারের ত্রাণ তাদের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছেনি। কারণ স্থানীয় সরকারের দ্বারা করা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপকারভোগী তালিকায় অনেক গড়মিল রয়েছে।
সমতলে তাদের অনটন, বৈষম্য, নিপীড়ন আরও বহুগুণ বেশি। সমতলের সাঁওতালরা সবচেয়ে পুরনো ও বড় নৃগোষ্ঠী কমিউনিটি হলেও এদের অবস্থা খুবই হতদরিদ্র। প্রকৃতির সন্তান বলে পরিচিত সাঁওতালরা থাকেন দিনাজপুর, রংপুর, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ে। তেভাগা আন্দোলন, সাঁওতাল বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহ, স্বদেশী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধে সাঁওতালদের বলিষ্ঠ ভূমিকা থাকলেও, আজ সেই মানুষগুলো দরিদ্র-নিপীড়িত। তাদের কোনোরকম সাহায্য সহযোগিতা দেওয়ার কথা আলাদা করে ভাবাও হয় না। এরা চরমভাবে সামাজিক বৈষম্যের শিকার। স্কুলে, হাসপাতালে, হোটেলে এদের অচ্ছুৎ বলে মনে করা হয়। স্বাভাবিক অবস্থাতেই তাদের নিজেদের জায়গা-জমি, বসত-ভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হয় এবং তা দখল করা হয়। আর এই করোনাকালে তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই।
বাংলাদেশে অনেকগুলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাস। এই মানুষগুলো একটি পৃথক জাতিসত্তা নিয়ে, ভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ে, একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে, নিজেদের পূর্বসূরিদের জমিতে, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সময় থেকে বা এরও আগের থেকে বসবাস করে আসছে। তাদের নিয়মকানুন, শিক্ষা, খাদ্য, জীবনযাপন, সংস্কৃতি, ভাষা, পড়াশোনা, সংস্কৃতি, আইন, জমি বন্দোবস্ত সব আলাদা। সরকার নিয়ন্ত্রিত বাঙালি অভিবাসন প্রক্রিয়া এমনিতেই তাদের খুব ক্ষতি করেছে। অনেককে করেছে গৃহচ্যুত। বেড়েছে হানাহানি ও সন্ত্রাস।
মধুপুরের গারোদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তাদের নিজেদের জায়গায় যে জাতীয় উদ্যান করা হয়েছে, এতে তারা খুশি কি না? না, তারা একদম খুশি নয়। বরং ক্ষোভ কাজ করছে ভেতরে ভেতরে। তাদেরও বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে, সেখানে জাতীয় উদ্যান বানিয়ে, এর চারপাশে যে কংক্রিটের দেয়াল দেওয়া হয়েছে, তাতে করে এই জমির আদি মালিকরাই আর এখন আর সেখানে ঢুকতে পারে না। এই জমির অধিকারের জন্য পেটোয়া বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন গারো নেতা পীরেন স্নাল।
সিলেটের দিকে গেলে পাবেন খাসিয়াদের। যেখানে খাসিয়াদের জায়গা নিয়ে নেওয়া হয়েছিল ইকোপার্ক করার জন্য। এখানে খাসিয়াদের হুমকি দেওয়া হয়েছিল যে জমি না পেলে তাদের মেরে ফেলা হবে। ইকোপার্কে পর্যটকরা বেড়াতে আসবেন, শুধু এজন্য এই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দারা তাদের জায়গা দিতে রাজি ছিল না। কিন্তু তারা ঠেকাতে পারল কই!
চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তনচইংগা প্রত্যেকের ভেতরে আলাদা আলাদা দুঃখবোধ রয়েছে। আরও ছোট ছোট গোত্রের মানুষদের জিজ্ঞাসা করলে পাবেন আরেক ধরণের দুঃখ। তারা বলেন তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই জেলা ও আঞ্চলিক পরিষদে। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষদের অধিকার রক্ষার দাবি পূরণ করেনি বলেই অনেকে মনে করেন। নারী পুরুষের চাওয়া ও দুঃখবোধের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। পাহাড়ি নারীর কষ্ট পুরুষের কষ্টের চেয়ে অনেক বেশি।
শুধু কি তাদের জমিজমা নিয়ে নেওয়া বা আপৎকালে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে তাদের পাশে না থাকা? এর চাইতেও বড় কথা এই মানুষগুলোর আলাদা পরিচয়কে অস্বীকার করা। আমাদের স্বাধীনতার পর থেকেই তাদের পরিচয় নিয়ে একটা সংকট ও টানাহেঁচড়া চলছে।
স্বাধীনতার পর পাহাড়ি নেতারা যখন তাদের সাংবিধানিক অধিকারের জন্য দাবি জানিয়েছিলেন, তৎকালীন সরকার তা সঙ্গে সঙ্গেই প্রত্যাখ্যান করেছিল। বলা হয়েছিল বাঙালি হিসেবে থাকাটাই সম্মানের হবে, উপজাতি বা আধা-জাতীয় হিসেবে থাকার চেয়ে। কোনো বাঙালি নেতাই তখন কথা বলেননি। এখনো অবস্থা তাই রয়ে গেছে। আমাদের খুব ছোট একটা অংশ এ নিয়ে কথা বললেও, অধিকাংশ মানুষ তাই মনে করে। কিন্তু আমরা একবারও ভাবি না, এর মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের অধিকারকেই অস্বীকার করি।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের অধিকার ও আত্মপ্রত্যয়ের বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোটিয়ার ড. রোডোলফ স্ট্যাভেনহ্যাগেন একসময় বলেছিলেন, ‘আত্মপ্রত্যয় এবং গণতন্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক থিউরি ও প্র্যাকটিসের মতোই জোরালো করতে হবে। আমাদের চারপাশে যে সহিংসতা দেখতে পাই, এগুলো কিন্তু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের আত্মপ্রত্যয়ের কারণে ঘটেনি, এগুলো ঘটেছে, তাদের আত্ম-অধিকারের দাবিকে অস্বীকার করা ও সবধরনের অপ্রাপ্তি থেকে। এই কথাটি আমাদের জন্য অবশ্য প্রণিধানযোগ্য।’
শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments