পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী: কোভিড-১৯ ও বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী
মার্চের শেষের দিকে যখন বৈশ্বিক সংকট তৈরি করা মহামারি করোনাভাইরাস বাংলাদেশে আঘাত হানে, তখন আমরা এ দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপর এর প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। কারণ, এমনিতেই এই গোষ্ঠী দীর্ঘদিন যাবৎ নিজেদের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিয়ে লড়াই করে আসছে।
বাংলাদেশে ৫০টিরও বেশি সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। তারা মূলত দেশের সমভূমি অঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রাম (সিএইচটি) হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বাস করছেন। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের এই মানুষগুলোর নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার এক থেকে দুই শতাংশ এসব সম্প্রদায়ের মানুষ।
সংখ্যালঘু হিসেবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এসব মানুষদের দীর্ঘদিন যাবৎ মূলধারার আর্থসামাজিক উন্নয়ন ব্যবস্থার সুবিধা থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ ও আইএলও’র সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গৃহস্থালি-ভিত্তিক আয়, খাদ্য গ্রহণ, অংশগ্রহণ ও নারীর ক্ষমতায়নের মতো বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সূচকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের মান জাতীয় গড়ের নিচে রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ: দেশে দারিদ্র্যের জাতীয় গড় হার যেখানে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ, সেখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এ হার আরও বেশি। সমতল ভূমিতে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের হার ৮০ শতাংশ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের হার ৬৫ শতাংশ। বিভিন্ন কারণে দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এসব মানুষ চিরকাল প্রান্তিকীকরণ ও দারিদ্র্যের রাজ্যে বাস করছেন।
সংঘাত, জমি দখল, জলবায়ু পরিবর্তন, বিভিন্ন উন্নয়নগত হস্তক্ষেপ ও প্রচলিত ব্যবস্থাগত বৈষম্যের কারণে জমি ও সম্পদের ক্রমবর্ধমান স্থানচ্যুতির ফলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের জীবন ও জীবিকা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার দেশব্যাপী শাটডাউন ঘোষণা করায় তৎক্ষণাৎ এর আর্থসামাজিক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের ওপর। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপর মহামারির প্রভাব নিয়ে আমাদের করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, তৈরি পোশাক শিল্পের হাজারো শ্রমিক ও পার্লারে কাজ করা শ্রমিকরা তাদের চাকরি হারিয়েছেন, কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগ বিঘ্নিত হয়েছে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার লঙ্ঘন বেড়েছে এবং সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো— ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়গুলোকে খাদ্য-নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ: দিনাজপুর ও নেত্রকোণার হাজং পরিবারগুলো আগে প্রতিদিন যে পরিমাণ খাবার খেতো, এখন তা কমাতে হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যেসব মানুষ অন্যত্র কাজ করতেন, তারা এখন নিজ গ্রামে ফিরে এসেছেন। বর্তমানে তাদের কোনো আয় নেই। বেঁচে থাকার জন্য তাদের কর্মসংস্থানের প্রয়োজন। কর্মসংস্থানের জন্য এখন তারা মরিয়া হয়ে আছেন।
লক্ষণীয় বিষয় হলো— এই সম্প্রদায়গুলোকে করোনার সংক্রমণের চেয়ে শাটডাউনের প্রভাব নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন বলে মনে হচ্ছে। দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মুশর শ্রমিক কালু রাম রিশি (৪২) বলেন, ‘লকডাউন চলাকালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মুশর সম্প্রদায়ের মানুষেরা ভাইরাসের সংক্রমণের চেয়ে অনাহার নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন।’
কোভিড-১৯ সংকটে নিম্ন আয়ের ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের জন্য সরকার সামাজিক সুরক্ষা ও অন্যান্য সহায়তা কর্মসূচিসহ নানা নীতিগত ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে, আমাদের গবেষণায় অংশ নেওয়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষই বলেছেন, তারা সরকারের এসব কর্মসূচির মাধ্যমে একেবারে সামান্য সহায়তা পেয়েছেন কিংবা পাননি।
করোনাকালে সংসদ টিভি ও ইউটিউবের মাধ্যমে সরকার যে ডিজিটাল শিক্ষাসেবার উদ্যোগ নিয়েছে, ‘ডিজিটাল ডিভাইস’র অভাবে প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কয়েক শ শিক্ষার্থী সেই সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে ভাষাগত বাধা যেমন চ্যালেঞ্জের শীর্ষে রয়েছে, তেমনি রয়েছে পর্যাপ্ত আইটি সরঞ্জাম, ইন্টারনেট সংযোগ ও মাঝেমধ্যে বিদ্যুতের অভাবও।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বিগত কয়েক দশক ধরে গড়ে সাত শতাংশ থাকলেও এ বছর (২০২০ সাল) তা দুই শতাংশ কমবে বলে অনুমান করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। দেশে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা ছাড়াই অনানুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন চলছে, কোভিড-১৯ সংকটে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা ইতোমধ্যে নানা সমস্যা পোহাচ্ছেন এবং আগামীতে আরও মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি তাদেরকে হতে হবে।
যেহেতু আমরা এই বছর ‘কোভিড-১৯ ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মানুষের স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরা’— এই মূল প্রতিপাদ্যে বিশ্ব আদিবাসী দিবস উদযাপন করছি, তাই আমরা ক্রোধের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছি যে, সামঞ্জস্যহীনভাবে এই সংকটের প্রভাব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের ওপর পড়তে থাকবে।
যেহেতু ঐতিহাসিক অবিচার ও প্রান্তিকীকরণের শিকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই সম্প্রদায়গুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার আগ্রহ দেখিয়ে আসছে, তাই আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে তাদের সুরক্ষার দায়িত্বও রাষ্ট্রের অন্তর্গত।
তাই, শুধু মহামারি মোকাবিলায় স্বল্পমেয়াদে নয়, বরং যে প্রচলিত ব্যবস্থা, কাঠামোগত আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাধা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের প্রান্তিকীকরণ অব্যাহত রাখে, সেগুলো ছাপিয়ে তাদের প্রয়োজন ও অগ্রাধিকারের বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ত্রিমিতা চাকমা, নারীবাদী গবেষক, মানবাধিকারকর্মী ও কাপেং ফাউন্ডেশনের সদস্য।
পল্লব চাকমা, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments