আইনপ্রয়োগকারী সদস্যরা শুধু ‘কাগজে-কলমে’ দায়বদ্ধ
স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আশায় গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) আওতাধীন খুলশি থানায় আত্মসমর্পণ করেন আসামি বেলাল হোসাইন। আত্মসর্মপণের পর পুলিশ বেলালকে তাদের হেফাজতে নেয়।
এর কয়েক ঘণ্টা পর বেলাল ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় বলে দাবি করে পুলিশ। তারা জানায়, বেলালকে নিয়ে তারা জালালাবাদ এলাকায় অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গেলে এই ঘটনা ঘটে।
আইন অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের হেফাজতে যিনি থাকবেন, তার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বও তাদের। তবে, গ্রেপ্তার, আটক বা আত্বসমর্পণের পর এই ধরনের ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘গুলি বিনিময়’র ঘটনাগুলো নিত্যনৈমত্তিক হয়ে উঠছে।
পুলিশ রেগুলেশন আইনের ৩২৮ (ক) ধারা অনুযায়ী, ‘কোনো থানা বা পোস্টের হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের নিরাপত্তার দায় সংশ্লিষ্ট থানা বা পোস্টের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি)।’
পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন তথাকথিত এসব ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ব্যক্তিদের মৃত্যুর ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কাউকে দায়বদ্ধ করা হয়নি। বরং, এর বিপরীতে প্রতিটি ঘটনার পরই তারা দায়মুক্তি পাচ্ছেন বলে অভিযোগ মানবাধিকারকর্মীদের।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘কোনো ব্যক্তিকে হেফাজতে নেওয়ার পর তার নিরাপত্তার দায়িত্বও যারা হেফাজতে নেবেন, তাদের। পুলিশি হেফাজতে থাকা ব্যক্তিকে নিয়ে যদি অস্ত্র উদ্ধার বা যেকোনো অভিযানে যাওয়া হয়, সেসময়ও ওই ব্যক্তির নিরাপত্তার বিষয়টিকে আইন অনুযায়ী সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।’
‘কিন্তু, আমরা দেখছি হেফাজতে নেওয়ার পর অভিযানের নামে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে একের পর এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হচ্ছে। এর বিপরীতে জিম্মাদার পুলিশ কর্মকর্তারা ইমপিউনিটি (দায়মুক্তি) ভোগ করছেন। এটা আইনের সম্পূর্ণ ব্যত্যয়’, বলেন তিনি।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৪ সাল থেকে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘গুলি বিনিময়’র শিকার দুই হাজার ৮৫০ জনের মধ্যে এক হাজার জনকেই গ্রেপ্তার, আটক বা আত্মসমর্পণের পর হত্যা করা হয়েছে।
নিহতদের মধ্যে অনেকের পরিবার বছরের পর বছর ধরে অভিযোগ করে আসছে, ‘বন্দুকযুদ্ধ’র নামে তাদের প্রিয়জনদের হত্যা করেছে পুলিশ ও র্যাব। মাঝেমধ্যে কিছু পরিবারের অভিযোগ থাকে, তাদের স্বজনদের মারতে ‘ভাড়াটে হত্যাকারী’ হিসেবে কাজ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
অনেক পরিবার ও মানবাধিকারকর্মীদের অভিযোগ, আইনপ্রয়োগকারী সদস্যরা ওইসব ব্যক্তিদের হত্যা করে এবং সেই হত্যার দায় এড়াতে ঘটনাকে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বলে বর্ণনা করে। যদিও সবসময়ই আইনপ্রয়োগকারী সদস্যরা এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে থাকেন।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হেফাজতে থাকা ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ হওয়ার দায়-দায়িত্ব আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যরা এড়াতে পারেন না। এমনকি আসলেই যদি ‘বন্দুকযুদ্ধ’র ঘটনা ঘটে থাকে, তাও।
তবে, এখন পর্যন্ত হেফাজতে থাকা কোনো ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারার দায়ে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্যকে জবাবদিহির আওতায় আনতে দেখা যায়নি। ‘বন্দুকযুদ্ধ’র পর পুলিশ ও র্যাব মূলত দুইটি অভিন্ন বিবরণ দিয়ে থাকে।
একটি বিবরণ যেটি পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন ব্যক্তি নিহত হলে দেওয়া হয়, সেটির সঙ্গে বেলালের মৃত্যুর পর পুলিশের দেওয়া বিবরণের মিল রয়েছে।
এক্ষেত্রে পুলিশ বা র্যাবের দেওয়া বিবরণটি হলো, তারা আটক ব্যক্তিকে নিয়ে মাদক বা অস্ত্র উদ্ধার কিংবা অন্য আসামিদের গ্রেপ্তার করতে অভিযানে যায়। সেসময় হঠাৎ করেই ‘অপরাধী’রা বের হয়ে অকস্মাৎ আইনপ্রয়োগকারী সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি শুরু করে। আত্মরাক্ষার্থে আইনপ্রয়োগকারী সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালায়। গোলাগুলিতে কেবলমাত্র তাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া আসামিই গুলিবিদ্ধ হয় এবং নিহত হয়।
২০১৪ সালে গার্মেন্টস শ্রমিক মেসবাহ উদ্দিন তারেককে (২৪) তুলে নিয়ে যায় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দারা। এর একদিন পর ১৪ সেপ্টেম্বর তাকে হত্যা করে একই রকমের বর্ণনা দেওয়া হয়।
যদিও ভুক্তভোগী পরিবারগুলো সাধারণত পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে না, তবে, মেসবাহর বাবা ঢাকা কোর্টে মামলা করেছিলেন। মামলায় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাত কর্মকর্তাসহ ১০ জনকে আসামি করা হয়। কিন্তু, দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর যাবৎ আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পর তিনি অভিযুক্তদের সঙ্গে আপসে এসে মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।
যে কারণে, অকালে একটি তরুণ প্রাণ ঝরার পরেও পুলিশ সদস্যরা কোনো ‘শাস্তি’র মুখোমুখি হননি। তা ছাড়া, পুলিশি হেফাজতে থাকা ব্যক্তিকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তাদের নিজ বিভাগ থেকেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
গত ৩১ জুলাই পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান নিহত হয়। এই ঘটনার পর দায়ের করা হত্যা মামলায় তৎক্ষণাৎ টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ পুলিশের সাত সদস্যকে কারাগারে পাঠানো হয়। এটি একটি বিরল ঘটনা।
সিনহার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বর্ণনাটি ব্যবহার করা হয়েছে যে, আইনপ্রয়োগকারীর সদস্যরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালালে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ সংগঠিত হয় এবং তিনি (সিনহা) নিহত হন। পুলিশের দাবি, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা পুলিশের দিকে গুলি তাক করলে পুলিশ পাল্টা ‘গুলি করলে’ তার (সিনহা) মৃত্যু হয়।
এই ধরনের বিবরণে আইনপ্রয়োগকারী সদস্যরা ‘বন্দুকযুদ্ধ’র আগে ভুক্তভোগীকে তুলে নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন। তবে, অনেক ভুক্তভোগীর পরিবারের অভিযোগ, তথাকথিক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যার আগেই তাদের প্রিয়জনদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
গত ৫ আগস্ট পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ বলেন, এই ধরনের ঘটনাকে তিনি ‘ক্রসফায়ার’ বলতে রাজি নন। যদিও প্রত্যেকটি ঘটনার পর পুলিশের পক্ষ থেকে দেওয়া বর্ণনাতেই এগুলোকে ‘ক্রসফায়ার’ বলা হয়েছে।
সিনহা নিহতের ঘটনায় কক্সবাজারে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ ব্রিফিংয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, ‘ক্রসফায়ার শব্দের সঙ্গে আমরা একমত নই। এটি এনজিওরা বলে। এটি আমাদের এখানে যারা এনজিওগিরি করেন, তারা বিভিন্ন কারণে বিদেশ থেকে পয়সা আনেন। ঝকঝকে গাড়িতে চড়েন, ঝকঝকে অফিসে বসেন। (বিদেশ থেকে আনা পয়সা) জাস্টিফাই করতে হলে অনেক রকম কথা বলতে হয়। তার মধ্যে ক্রসফায়ার হলো একটি।’
এখন পর্যন্ত পুলিশ ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, যখন অপরাধীরা তাদের আক্রমণ করে, তখনই ‘বন্দুকযুদ্ধ’র ঘটনা ঘটে।
Comments