জিয়া, খালেদা দেশে হত্যার রাজনীতি শুরু করে: প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত স্মরণ সভায় বক্তৃতা করেন (রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০)। ছবি: পিআইডি

জিয়াউর রহমান এবং তার স্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দেশে খুনের রাজনীতি শুরু এবং খুনীদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জিয়া ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স দিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের যেমন রক্ষাকবচ দিয়েছিল তেমনি খালেদা জিয়াও অপারেশন ক্লিনহার্টের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ শত শত মানুষ হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দিয়ে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাঁর স্বামী যা করেছে (সাবেক সেনাশাসক জিয়া) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের ইনডেমনিটি, আর সে এসে (খালেদা জিয়া) নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে তাদের ইনডেমনিটি দিয়ে গেছে।’

‘অনেকে ভুলে গেছে যে, খালেদা জিয়া ২০০১ সালে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে অপারেশন ক্লিনহার্টের নামে বহু মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে,’ যোগ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আজ রবিবার বিকেলে জাতির পিতার ৪৫তম শাহাদৎ বার্ষিকী এবং জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত স্মরণ সভায় সভাপতির ভাষণে একথা বলেন।

করোনা পরিস্থিতির কারণে ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে অনুষ্ঠিত এই স্মরণসভায় দলের সভাপতি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের সাহায্যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে (২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনিউ) মূল অনুষ্ঠানের সঙ্গে যোগদান করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘অপারেশন ক্লিনহার্টের নামে আমাদের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী যেখানেই যাকে পেয়েছে নির্যাতন করে হত্যা করেছে।’

তিনি বলেন, ওই সময় আওয়ামী লীগের রিচার্স সেন্টার দখল, বই-পত্র, ৩শ’ ফাইল, কম্পিউটার হার্ডডিস্ক এবং নগদ টাকা লোপাটসহ রাজনৈতিক কর্মসূচি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে তিনি বলেন, ‘সেই হত্যার বিচার হবে না-এই ইনডেমনিটিও খালেদা জিয়া দিয়ে গেছে।’

‘শুধু তাই নয়, ‘যে পাশা (বঙ্গবন্ধুর খুনী) মৃত্যুবরণ করেছে তাকে প্রমোশন দিয়ে তার সমস্ত টাকা-পয়সা স্ত্রীকে দেয়া হয়েছে। যে খায়রুজ্জামানের (অপর খুনী) চাকরী চলে গিয়েছিল কিন্তু খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরীতে পুণর্বহাল করে এবং প্রমোশন দেয়’, যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, সামনেই খায়রুজ্জামানের খুনের মামলার বিচারের রায় হওয়ার কথা থাকলেও তাকে প্রমোশন দিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দেয় যে তাকেই সে (খালেদা জিয়া) সমর্থন করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। ‘এর অর্থটা কি দাঁড়ায়?’ প্রশ্ন তোলেন তিনি।

জিয়া এবং খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘এভাবেই তারা হত্যার রাজনীতি এদেশে শুরু করেছে।’

দলীয় কার্যালয় থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সভার প্রারম্ভিক বক্তৃতা করেন। আরো বক্তৃতা করেন, দলের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, কেন্দ্রীয় সদস্য আখম জাহাঙ্গীর হোসেন, মহানগর আওয়ামী লীগ দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফি এবং মহানগর উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান।

দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ ’৭৫ এর ১৫ আগষ্ট নিহতদের স্মরণে সকলে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করেন।

বিচার বহির্ভূত হত্যা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিংয়ের (বিচার বহির্ভূত হত্যা) কথা আজ সবাই বলে- সবাই ভুলে গেছে যে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর অপারেশন ক্লিন হার্টের নামে বহু মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।’

জিয়ার সময়ে সংঘটিত ১৯টি ক্যু’র কারণে অফিসার ও সৈনিক হত্যার প্রসংঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আমাদের সেনাবাহিনী এবং বিমান বাহিনী। বিমান বাহিনীর ৬৬৫ জনকে আর সেনা বাহিনীর দুই থেকে আড়াই হাজার জনকে হত্যা করা হয়েছিল।’

তিনি বলেন, ‘কেউ বলতে পারতো না কে বেঁচে থাকবে আর কে কখন মৃত্যুবরণ করবে। এরকম একটা ত্রাসের রাজত্ব তারা কায়েম করেছিল। ঠিক তার (জিয়া) স্ত্রী (খালেদা জিয়া) ক্ষমতায় এসেও একই ঘটনা ঘটিয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনীর যত মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ছিল তাঁদেরকে একে একে হত্যা করেছে। হাজার হাজার অফিসার এবং সৈনিককে নির্বিচারে হত্যা করেছে। কাউকে কোর্ট মার্শাল দিয়েছে, কাউকে গুলি করে হত্যা করেছে।’

‘এভাবে বহু অবলা মায়ের কোল খালি হয়েছে, কেউ একটা প্রতিবাদ করার সাহস পেত না, কারণ, কেউ প্রতিবাদ করলে সে আর জীবিত থাকতো না। সাদা গাড়িতে করে তুলে নিয়ে কোথায় ফেলে দিত, লাশও পাওয়া যেত না’, বলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি গুম খুনের শিকার খুলনা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ সারাদেশের কয়েকজন আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘এরকম বহু ঘটনা আছে এবং আমার মনে হয়, সেগুলো আবার স্মরণ করা উচিত, কারণ কিভাবে একটা দেশে খুনের রাজত্ব তারা শুরু করেছিল।’

শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর হত্যার অভিযোগে জিয়াকে পুনরায় অভিযুক্ত করে বলেন, ১৯৮০ সালে লন্ডনে হাউস অব কমন্স সদস্য স্যার টমাস ইউলিয়াম কিউসি এবং শ্যন ম্যাকব্রাইটকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের নিরপেক্ষ তদন্তে গঠিত কমিশনকে এদেশে আসার ভিসা না দিয়ে এবং খুনীদের ইনডেমনিটির মাধ্যমে দায়মুক্তি প্রদানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে চাকরী দেওয়ার মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে, সে এই হত্যাকান্ডে জড়িত ছিল। শুধু তাই নয়, বিবিসিতে দেয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী ফারুক এবং রশিদ ও জিয়ার জড়িত থাকার উল্লেখ করেছিল।

তিনি এ সময় পাকিস্তানের কর্নেল বেগের (পরবর্তীতে সেনা প্রধান) জিয়াউর রহমানকে লেখা একটি চিঠি, যা জাহাঙ্গীর কবির নানক অনুষ্ঠানে পড়ে শোনান তার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রশ্ন তোলেন,‘ চিঠিতে জিয়াকে নতুন কাজ দেয়ার যে কথা বলা হয়, তা ১৫ আগস্টের এই হত্যাকান্ডের অ্যাসাইনমেন্ট ছিল কি?’

শেখ হাসিনা আরো বলেন, বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধী আলবদর, রাজাকার, আল-শামসদের জেল থেকে ছেড়ে দিয়ে মন্ত্রী-উপদেষ্টা করে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিল এই জিয়াউর রহমান।’

স্মৃতিচারণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির মেয়ে হয়েও তাঁদের নাম-পরিচয় গোপন করে নির্বাসিত রিফ্যুজি জীবন কাটাতে হয়েছে। অন্যদিকে খুনিরা বিভিন্ন দূতাবাসে আরাম-আয়েশে জীবন কাটিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘খুনিদের বিচার না করার ইনডেমনিটি দিয়েছিল জিয়াউর রহমান আর সন্ত্রাসীদের ইনডেমনিটি দিয়েছিল তার স্ত্রী খালেদা জিয়া।’

বেঈমানরা কখনোই ক্ষমতায় থাকতে পারে না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মীর জাফরও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। সিরাজদ্দৌলাকে হত্যা করতে মীর জাফরকে ব্যবহার করা হয়েছে। সেই মীর জাফর দুইমাসের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ঠিক মোশতাকও পারেনি। মোশতাককে হটিয়ে জিয়াউর রহমানই রাষ্ট্রপতি হয়েছিল। যে নিজেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা দিয়েছিল।’

পরবর্তী সেনা শাসক এরশাদের বিরুদ্ধেও সন্ত্রাসের রাজনীতি অব্যাহত রাখার অভিযোগ এনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জেনারেল এরশাদ এসেও সেই ২৪ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের মিছিলে গুলি থেকে শুরু করে। সে এমন কোন ঘটনা নাই যে না ঘটিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেবল বোমা আর গুলির শব্দ। সারাদেশে একটা আতংক আর নির্বাচনের নামে প্রহসন। কোথাও ব্যালটও লাগতো না, ভোটও লাগতো না।’

তিনি সামরিক সরকারের সময়ে দেশের নির্বাচন সম্পর্কে বলতে গিয়ে আরো বলেন, ‘তারা বলতো ১০টা হোন্ডা ২০টা গুন্ডা নির্বাচন ঠান্ডা-এইতো পরিস্থিতি বাংলাদেশের ছিল।’

উচ্চ আদালত কর্তৃক সকল সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা এবং তাদের জারিকৃত সকল অর্ডিন্যান্স বাতিলের রায় ‘দেশকে অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করেছে,’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এরফলে দেশের মানুষের মধ্যে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরে এসেছে।’

প্রধানমন্ত্রী করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় সরকার প্রশাসন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দলের নেতা-কর্মীদের দায়িত্ববোধের প্রশংসা করে করেনায় নিহত দলীয় নেতা-কর্মীদের একটি তালিকা প্রকাশ করার বিষয়েও দলকে নির্দেশনা দেন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগসহ আমাদের সকলে এই করোনা ভাইরাসের সময় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত মানুষের কাছে গেছে, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং ত্রাণ বিতরণ করেছে।’

তিনি বলেন, ‘কাজ করতে গিয়ে নেতা-কর্মীদের অনেকেই করেনায় আক্রান্ত হয়েছে। সুস্থ হয়েছে, আবার কাজে ছুটে গেছে তাঁদের মাঝে। আর কত নেতা-কর্মী যে এসময় মৃত্যুবরণ করেছে- তাই আমি মনে করি, আমাদের পার্টির থেকে সেই তালিকাটা বের করা দরকার।’

‘দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাওয়া’ জাতির পিতার কাছে আওয়ামী লীগের প্রত্যেকটি নেতাকর্মীর অঙ্গীকার বলেও শেখ হাসিনা এ সময় দলের সবাইকে তাঁদের কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ করেন।

Comments

The Daily Star  | English
Former president Hamid airport CCTV footage

The story of Hamid’s exit

Further details regarding the exit of former president Mohammed Abdul Hamid suggest he breezed through the airport before quietly departing for Thailand.

10h ago