সাইকেল নয় নৌকা চালাতে শেখে চরের শিশুরা
নূর আমিন ও সাদেকুল ইসলাম। দুই জন চাচাত ভাই, সমবয়সী। সাত বছর বয়স তাদের। কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলার মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্রের চর মোহনগঞ্জে অন্য সব শিশুর মতো তারাও দুরন্তপনায় বেড়ে উঠছে। বাড়ির পাশে ব্রহ্মপুত্রের একটি শাখায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছে ডিঙি নৌকা চালানোর।
কয়েক ঘণ্টা তারা দুই জনে ডিঙি নৌকায় এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়। নৌকা চালানো চরের শিশুদের কাছে একটি বাধ্যতামূলক কাজ। তাদের এ কাজ শেখতে হয়, জানতে হয় জীবনের প্রয়োজনে।
শুধু নূর আমিন কিংবা সাদেকুল এ কাজটি করছে না। কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলাসহ সব ছোট-বড় নদীর চরাঞ্চলে শিশুদের শেখতে হয় নৌকা চালানো।
চার বছর বয়স থেকে তারা সাঁতার শেখতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। পাঁচ বছর বয়সে হাতে নৌকার বৈঠা তুলে নেয়। ’নৌকা চালান শেখান লাগবো না। হেউডা তো শেখতে হবোই। আমগো বাড়ির আশে-পাশে পানি উঠে, আমগো বাড়ি ডুইবা যায়। আমগো নৌকা চালান শেখতেই হবো,’ এমন করে দ্য ডেইলি স্টারকে বললো ব্রহ্মপুত্র পাড়ের শিশু নূর আমিন। ‘বাপ শিখ্যাইয়া দিছে। এহোন আমরা নৌকা চালাইতে পারি,’ যোগ করে সে।
শিশু সাদেকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলে, ’আমরা সাঁতার জানি, নৌকা চালান জানি। আমরা সাইকেল চালাতে জানি না। আমগো তো সাইকেল নাইকা। চরের মধ্যে বালু। কোহনে সাইকেল চালামু।’
সাদেকুলের বাবা কৃষক মফের উদ্দিন (৪৬) ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘চরের শিশুরা নৌকা চালাতে পারে। তারা সাইকেল চালাতে পারে না। সাঁতার শেখা, নৌকা চালানো চরাঞ্চলের ঐতিহ্য। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে এটা শেখতে হয়, জানতে হয়। বর্ষাকালে নৌকাই হয়ে ওঠে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বস্তু।’
একই চরের কৃষক আতিয়ার রহমান (৬৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘চরে শুধু বালু আর বালু। সাইকেল চালার মতো অবস্থাও নেই। আমাদের শিশুরা সাইকেল চালানোর প্রশিক্ষণ পায় না। তাদেরকে নৌকা চালাতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। চরের প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে নৌকা রয়েছে। নৌকাই হলো চরাঞ্চলের প্রধান বাহন।’
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায় তিস্তার চর ডাউয়াবাড়ির কৃষক সামাদ মিয়া (৬২) ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘চরের হাতেগোনা কয়েকজন শিশু সাইকেল চালাতে জানে। কিন্তু সব শিশুই সাঁতার আর নৌকা চালাতে পটু। তারা শিশুকাল থেকেই নদীর পানি, নদীর গতি, নদীর স্রোত দেখে অভ্যস্ত। এসবের সঙ্গে কিভাবে লড়াই করে বাঁচতে হয় তারা তা শেখে নেয়।’
লালমনিরহাটে তিস্তা নদীর চরে ‘চর জীবন’ নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি সোহেল রানা ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘চরের জীবন বৈচিত্র্যময়। শিশুরা নৌকা চালিয়ে নদীপাড়ি দেয়। তারা তেমন খাবার পায় না। কিন্তু, তাদের স্বাস্থ্য সুঠাম— এটা প্রকৃতির আর্শীবাদ।’
‘সাইকেল চরের শিশুর কাছে অনেকটা খেলনা বস্তুর মতো। নৌকার প্রতি তাদের আকর্ষণ থাকে সব সময়ই,’ যোগ করেন তিনি।
Comments