আরবি লাইপজিগ: পাদপ্রদীপের আলোয় জার্মানির সবচেয়ে ‘ঘৃণিত’ ক্লাব

rb leipzig
ছবি: টুইটার

মাত্র এক যুগ আগেও আরবি লাইপজিগ নামের কোনো ফুটবল ক্লাবের কথা কেউ শোনেনি। তাদের অস্তিত্বই যে ছিল না! জার্মানির সবচেয়ে ‘ঘৃণিত’ ক্লাবের তকমা গায়ে মেখে তারাই কিনা জায়গা করে নিয়েছে এবারের উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে! ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে লিসবনে দলটি মুখোমুখি হবে প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ের (পিএসজি)।

জার্মানি আংশিক-সার্বভৌম ১৬টি প্রদেশের সমন্বয়ে গঠিত। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো স্যাক্সনি। প্রদেশটির সবচেয়ে জনবহুল শহর লাইপজিগ থেকে ১১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত মার্ক্রানস্ট্যাডট। ২০০৯ সালে আরবি লাইপজিগের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেখানে, যার বর্তমান জনসংখ্যা মাত্র ১৫ হাজার।

ওই ছোট্ট শহরের ক্লাব এসএসভি মার্ক্রানস্ট্যাডট খেলত জার্মানির পেশাদার ক্লাব ফুটবলের পঞ্চম স্তরে। তাই দেশটির ফুটবল অঙ্গনে তাদের পরিচিতি ছিল না বললেই চলে। কিন্তু অস্ট্রিয়ার শক্তিবর্ধক পানীয় প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রেড বুল দলটির লাইসেন্স কিনে নেওয়ার পর দলটির খোলনলচে পাল্টে ফেলা হয়। বাকিটা ইতিহাস। ইউরোপের সর্বোচ্চ ক্লাব আসরের শিরোপা জয়ের মঞ্চ থেকে মাত্র এক ধাপ দূরে তারা।

এসএসভি মার্ক্রানস্ট্যাডটের নতুন নাম দেওয়া হয় আরবি লাইপজিগ। পরিবর্তন এসেছে দলটির লোগোতেও। নির্মিত হয়েছে ৪২ হাজার ৯৫৯ আসন বিশিষ্ট নতুন স্টেডিয়াম রেড বুল অ্যারেনা।  ২০১৬ সালে তারা জায়গা করে নেয় বুন্ডেসলিগায়। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠার মাত্র সাত বছরের মাথায় জার্মানির ক্লাব ফুটবলের পঞ্চম স্তর থেকে শীর্ষ স্তরে উঠে আসে ক্লাবটি।

বুন্ডেসলিগায় প্রথমবারেই বাজিমাত করে লাইপজিগ। ২০১৬-১৭ মৌসুমে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে পেছনে ফেলে তারা হয় দ্বিতীয়। ফলে পরবর্তী মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অভিষেক হয় তাদের। সেবার অবশ্য গ্রুপ পর্বেই থামতে হয়েছিল দলটিকে।

ঘরোয়া লিগে সেরা চারে থাকতে না পারায় ২০১৮-১৯ মৌসুমে লাইপজিগ সুযোগ পায়নি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। তবে এক বছর বিরতির পর ইউরোপের সেরা ক্লাব আসরে ফিরেই চমক উপহার দিয়েছে দলটি। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে নকআউটে ওঠে তারা। এরপর সেমিতে পা রাখার পথে তরুণ কোচ উলিয়ান নাগেলসমানের দল বিদায় করেছে টটেনহ্যাম হটস্পার ও অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদের মতো ঐতিহ্যবাহী ও শক্তিশালী ক্লাবকে।

julian nagelsmann
ছবি: টুইটার

পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে খুবই অল্প সময় নিয়েছে লাইপজিগ। ২০০৯ সালে এনার্জি কটবাসের অবনমনের পর সাবেক পূর্ব জার্মানির কোনো ক্লাবের প্রতিনিধিত্ব ছিল না বুন্ডেসলিগায়। সাত বছর পর লাইপজিগ পূরণ করে সেই শূন্যস্থান। আর ১৯৯০ সালে দুই জার্মানির একত্রীকরণের পর তারাই প্রথম ক্লাব, যারা বুন্ডেসলিগায় অভিষেক মৌসুমে ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় জায়গা করে নেয়। 

দ্রুত উত্থান ঘটলেও জার্মানির সবচেয়ে ‘ঘৃণিত’ ক্লাব হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে লাইপজিগ। প্রতিপক্ষ দলগুলোর ভক্ত-সমর্থক থেকে শুরু করে কর্মকর্তারাও বহুবার তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। কয়েকটি উদাহরণে স্পষ্ট হয়ে যাবে ঠিক কতখানি ঘৃণার পাত্র দলটি।

ইউনিয়ন বার্লিনের সমর্থকরা ২০১৫-১৬ মৌসুমে লাইপজিগের বিপক্ষে ম্যাচে কালো রঙের প্লাস্টিকের তৈরি পোশাক পরে মাঠে গিয়েছিলেন এবং প্রথম ১৫ মিনিট গ্যালারিতে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিলেন। এখনও সিনিয়াল ইদুনা পার্কে খেলতে গেলে লাইপজিগের লোগো ব্যবহার করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে থাকে স্বাগতিক ডর্টমুন্ড। ২০১৬-১৭ মৌসুমের জার্মান কাপে দলটির খেলোয়াড়দের লক্ষ্য করে ষাঁড়ের কাটা মাথাও ছুঁড়ে মেরেছিলেন ডায়নামো ড্রেসডেনের সমর্থকরা। কারণ, লাইপজিগের লোগোতে দুইটি ষাঁড়কে মুখোমুখি অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়।

কিন্তু লাইপজিগের প্রতি এত ক্ষোভের কারণটা কী? সহজ কথায় প্রতিবাদকারীরা যা বলে থাকেন- জার্মানির ফুটবল দর্শনের সঙ্গে মিল নেই তাদের। কোনো বড় প্রতিষ্ঠান একটি ক্লাব কিনে দেদার অর্থ বিনিয়োগ করবে এবং সেটা হঠাৎ করে সাফল্য পেতে থাকবে, এটা নাকি মোটেও মানানসই নয়।

rb leipzig
ছবি: টুইটার

কাড়ি কাড়ি টাকা অবশ্য ঢালেনি লাইপজিগ। দলীয় সাফল্য অর্জনের পাশাপাশি তরুণ খেলোয়াড়দের দলে টেনে পরিচর্যা করে তারকাখ্যাতি পাইয়ে দেওয়ার মন্ত্র নিয়ে এগোচ্ছে তারা। লিভারপুলে যোগ দেওয়ার আগে নাবি কেইতা খেলতেন লাইপজিগে। ২০১৬ সালে ২৯.৭৫ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে অস্ট্রিয়ান ক্লাব সালজবুর্গ (এই ক্লাবের মালিকও রেড বুল) থেকে তাকে দলে নিয়েছিল লাইপজিগ। এর চেয়ে বেশি দামে আর কাউকে এখন পর্যন্ত কেনেনি তারা।

জার্মান ফুটবল ফেডারেশনের (ডিএফবি) নিয়ম অনুসারে, ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করবেন ভক্ত-সমর্থকরা, যা ‘৫০+১’ নামে পরিচিত। অর্থাৎ ক্লাবের অধিকাংশ শেয়ারের মালিকানা থাকবে তাদের কাছে। বছরে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে সদস্য হবেন তারা। তবে লাইপজিগের বিরুদ্ধে অন্য ক্লাবগুলোর অভিযোগ হলো, এই নিয়মের থোড়াই করেছে রেড বুল।

অভিযোগ অস্বীকার করাও কঠিন লাইপজিগের জন্য। প্রতিষ্ঠার সময় মাত্র ১৭ জন সদস্য ছিল তাদের। আর তাদের বেশিরভাগই পরোক্ষভাবে রেড বুলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যদিও সদস্য সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে, তবে বৃদ্ধির হার ক্লাবের সাফল্যের হারের মতো বড় নয়। ২০১৮ সাল নাগাদ ক্লাবটির সদস্য ছিলেন সাত হাজার ৫০০ জন।

লাইপজিগকে প্রতিপক্ষরা সহ্য করতে পারুক বা না পারুক, এটা সত্য যে, তাদের উত্থান চিন্তায় ফেলেছে জার্মানির বড় বড় ক্লাবগুলোকে, যারা মূলত সাবেক পশ্চিম জার্মানির প্রতিনিধিত্ব করে। দুই জার্মানির পুনর্মিলনের পর আর্থিক অস্বচ্ছলতাসহ নানা কারণে পূর্ব জার্মানির ক্লাবগুলো বুন্ডেসলিগায় সফল হতে পারেনি। সেই ধারায় ছেদ টেনে ঘরোয়া লিগ তো বটেই, খুবই অল্প সময়ের মধ্যে ইউরোপের সেরা ক্লাব আসরেও নজর কেড়েছে লাইপজিগ।

সমালোচনার মাঝেও লাইপজিগ এগিয়ে চলেছে নিজস্ব দর্শনে। তাদের স্কোয়াডের গড় বয়স ২৫ বছরেরও কম। দলটির কোচ নাগেলসমানের বয়স মাত্র ৩৩ বছর। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে অ্যাতলেতিকোর বিপক্ষে লাইপজিগের জয়সূচক গোলটি করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের টেইলর অ্যাডামস, যার বয়স মাত্র ২১ বছর।

লাইপজিগ ক্লাবটি কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তা বুঝে নিতে তাই খুব বেশি কষ্ট হওয়ার কথা নয়। সাফল্য পেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ একটি তরুণ দল দারুণ ফুটবল উপহার দিতে এবং দীর্ঘদিন ধরে শীর্ষে থাকাদের টপকে যেতে মরিয়া। মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত একটায় পিএসজির বিপক্ষে দুটি লক্ষ্যই পূরণ করার চেষ্টা তাদের থাকবে নিঃসন্দেহে।

Comments

The Daily Star  | English

Shammo murder: DMP chief pledges to end probe within a week

Says case to be sent to a special tribunal after investigation

44m ago