শ্রিংলার ঢাকায় ছুটে আসার কারণ বাংলাদেশের প্রতি চীনের আগ্রহ?

হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। ছবি: সংগৃহীত

চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন মধ্যেই বাংলাদেশে আকস্মিক সফরে এসেছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। মহামারির মধ্যে ভারতীয় আমলার ঢাকা সফর নিয়ে বাংলাদেশে যেমন আলোচনা তৈরি হয়েছে বিষয়টি তেমনি ভারতের কূটনৈতিক বিশ্লেষকদেরও মনোযোগ কেড়েছে।

ভারতের পররাষ্ট্র নীতি বিশেষক বিশ্লেষক সীমা গুহ নিউজ ম্যাগাজিন আউটলুকে বুধবার প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেছেন, শ্রিংলা ঢাকায় ছুটে আসার পেছনে কারণ মূলত বাংলাদেশের প্রতি চীনের আগ্রহ।

কিছুদিন আগে শেখ হাসিনার সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ফোনে কথা বলেছেন। এর আগে, চীন বাংলাদেশকে আট হাজার ২৫৬টি পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা দেওয়া ঘোষণা দেয়। মহামারির মধ্যে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করার জন্য একটি মেডিকেল দলও পাঠিয়েছে চীন।

ভারতীয় বিশ্লেষকের দাবি, এ সমস্তই নয়াদিল্লি মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। তবে, তিস্তা নদীর উপর একটি প্রকল্পের জন্য চীনের এক বিলিয়ন ডলার দেওয়ার ঘোষণার পর টনক নড়ে নয়াদিল্লির। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গভীর সংকট রয়েছে।

এই বিশ্লেষকের মতে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নয়াদিল্লির নিরাপত্তা ও কৌশলগত আগ্রহের জায়গাগুলোর প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের চাইতে ভালো কোনো প্রতিবেশীও নেই ভারতের।

আসামে সহিংসতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা কমার জন্য শেখ হাসিনার অবদানকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি লিখেছেন, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরে হাসিনা সরকারের প্রথম কাজ ছিল ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসামের (উলফা) নেতাদের ভারতে প্রত্যর্পণ। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে এই বিদ্রোহীরা এর আগে সহজেই সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে পারত।

সীমা গুহ মনে করছেন, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তায় বাংলাদেশের এই অবদানের পরও নয়াদিল্লির সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয় তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি পিছিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে। এর পর বাংলাদেশ থেকে কথিত অনুপ্রবেশকে বিজেপির নির্বাচনী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার ও নাগরিকত্ব আইন সংশোধন নিয়ে ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক শীতল হয়েছে নয়াদিল্লির। এর পরই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য চীন তার ডালপালা ছড়িয়ে দিতে শুরু করে।

২০১১ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকায় সফরকালে তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তাতে আপত্তি জানান। এখনও পর্যন্ত ওই চুক্তির বাস্তবায়ন হয়নি।

আউটলুকের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশকে ভালো করেই জানেন শ্রিংলা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও তার ভালো সম্পর্ক আছে। ঢাকায় সফরকালে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গেও বৈঠক করেন। মোমেন ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ বাংলাদেশকে অবজ্ঞা করে খবর প্রচার করে বলে অভিযোগ করেন।

ভারতীয় এই বিশ্লেষক বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের শীতলতার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ দোষ ভারতেরই। অনুপ্রবেশের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুকে নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহারে সম্পর্কের ক্ষতি হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহসহ ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতারা এটিকে নির্বাচনের জন্য বড় ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করেছেন। শাহ এর আগে বাংলাদেশিদের ‘উইপোকা’ বলে মন্তব্য করেছেন।

ঢাকা এর বিরুদ্ধে কোনো জবাব দেয়নি। শেখ হাসিনা সরকার ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল কিংবা কাশ্মীরে ভারতের দমন অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না জানালেও আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) বাংলাদেশের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে সামনে এসেছে।

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া অমুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই তিনটি দেশ থেকেই মুসলমান বাদে হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধরা ভারতে আশ্রয়ের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে। লোকসভায় আইনটি প্রবর্তনের সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই তিন দেশে ধর্মীয় নিপীড়নের অভিযোগ তোলেন।

এনআরসিতে যারা নিজেদের ভারতীয় বলে প্রমাণ করতে পারবে না তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার বিষয়টিও স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের। যদিও ভারত সরকার এনআরসিকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বারবার ঢাকাকে আশ্বাস দিয়েছে।

দিল্লিতে ধর্মীয় সহিংসতা ও ভারতে মুসলিম বিরোধী প্রবণতা বাংলাদেশের অনেক নাগরিককে বিক্ষুব্ধ করেছে। বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের পরিকল্পনায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা ব্যাপক বিক্ষোভের হুমকি দেয়। যদিও মহামারির কারণে সফরটি শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়।

সীমা গুহ জানান, বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশ নিয়ে ভারতের প্রতিনিয়ত গুঞ্জন ও মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশিদের ক্ষুব্ধ করে দিচ্ছে। কেবল বিরোধীরা নয়, আওয়ামী লীগের সমর্থকরাও ভারতের ব্যাপারে হতাশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। তবে, আগামী বছরের গোড়ার দিকে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের সময় বাংলাভাষী মুসলমান ও অনুপ্রবেশ নিয়ে বিতর্ক আবারও বড় আকারে সামনে আসতে পারে। তখন নয়াদিল্লি কিভাবে ঢাকাকে আশ্বস্ত করে সেটাই দেখার বিষয়।

Comments

The Daily Star  | English
Khaleda Zia calls for unity

‘Seize the moment to anchor democracy’

Urging people to remain united, BNP Chairperson Khaleda Zia has said the country must quickly seize the opportunity to institutionalise the democratic system.

2h ago