‘তিস্তা প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগে চ্যালেঞ্জের মুখে ভারত’

বিশ্ব ভারতীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ফাইল ছবি (সংগৃহীত)

চীন, নেপাল ও পাকিস্তানের ত্রিমুখী চাপে চিন্তিত হয়ে পড়েছে নয়াদিল্লি। ভারতীয় বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে ভারত এখন বিশেষ মনোযোগী।

সম্প্রতি চীন ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়নের মধ্যে তিস্তা নদীর উপর একটি প্রকল্পের জন্য চীনের কাছ থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করেছে বাংলাদেশ।

আজ শুক্রবার দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ভারতের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক শুভজিৎ রায় লিখেছেন, ‘তিস্তার পানি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ আছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আলোচনা এমন সময়ে এসেছে যখন লাদাখ সীমান্ত নিয়ে চীন ও ভারতের সম্পর্ক চরম পর্যায়ে আছে।’

বাংলাদেশ ও চীনের আলোচনার মধ্যে এ সপ্তাহে বাংলাদেশে আকস্মিক সফরে আসেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর তিনিই প্রথম বিদেশি অতিথি, যার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখা করেছেন।

গত পাঁচ মাসে মহামারি সম্পর্কিত বিষয়ে একে অন্যের পাশে ছিল ভারত ও বাংলাদেশ। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আঞ্চলিক জরুরি তহবিল গঠনের ব্যাপারে মোদির আহ্বানকে সমর্থন জানান শেখ হাসিনা। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জরুরি তহবিলে ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার অনুদানের ঘোষণা দেন। গত মাসে, ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তির আওতায় চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহে সড়কপথে কনটেইনারে পণ্য পরিবহনের প্রথম ‘ট্রায়াল রান’ হয়।

ভারতীয় বিশ্লেষক জানায়, সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান শেখ হাসিনাকে ফোন করায় নয়াদিল্লির কপালে ভাঁজ পড়েছে। ইসলামাবাদ এটিকে কাশ্মির বিষয়ে কথোপকথন হিসেবে উল্লেখ করলেও ঢাকা জানিয়েছে, কোভিড-১৯ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ব্যাপারে কথা হয়েছে।

শ্রিংলার সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠকে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানায়, এই বছরের প্রথমার্ধে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ‘বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) বা ভারতীয় নাগরিক’ এর হাতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় ‘গভীর উদ্বেগ’ জানিয়েছে বাংলাদেশ।

ভারতীয় পক্ষ আশ্বাস দিয়েছে, বিএসএফ এই বিষয়ে সংবেদনশীল হয়েছে। আগামী মাসে বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) এর মধ্যে ডিজি-পর্যায়ের একটি বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে উল্লেখিত দুই দেশের আলোচনার অন্যান্য বিষয়গুলো হলো-

  • উভয় পক্ষ একমত হয়েছে যে, চুক্তিবদ্ধ প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন একটি সময়সীমা অনুযায়ী হওয়া উচিত। ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) অধীনে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে আরও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
  • ভারতে তাবলিগ জামায়াতের সদস্য, যারা আকস্মিক লকডাউনের কারণে আটকা পড়েছেন এবং আসামে থাকা ২৫ বাংলাদেশি জেলের মুক্তি চেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশি নাগরিকরা শিগগির ফিরে আসবেন বলে বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছে ভারত।
  • ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের কাছ থেকে জরুরি ভিত্তিতে ভিসা প্রদান পুনরায় চালু করার জন্য অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ। উল্লেখ্য, অনেক বাংলাদেশি রোগী চিকিৎসার জন্য ভারতে যাতায়াত করেন।
  • মহামারির প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন্ধ করে দেওয়া বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থলবন্দর দিয়ে আবারও চলাচল শুরুর ব্যাপারেও অনুরোধ জানানো হয়েছে।
  •  বাংলাদেশ সরকার শ্রিংলাকে জানায়, কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সহযোগিতা করতে বাংলাদেশ প্রস্তুত। ভ্যাকসিন তৈরি হলে দ্রুত ও সাশ্রয়ী মূল্যে সেটি পাওয়ার আশাও জানিয়েছে বাংলাদেশ।

গত দশকে ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বাংলাদেশে ভারতের রফতানির পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার এবং একই সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ০৪ বিলিয়ন।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন বলছে, চিকিত্সা, পর্যটন, কর্মস্থল এমনকি শুধু বিনোদনের জন্যও ভারত প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ লাখ বাংলাদেশিদের ভিসা দিয়ে থাকে।

এই বিশ্লেষকের মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী হিসেবে বরাবরই সুসম্পর্ক ছিল ভারতের। তবে, সম্প্রতি এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিড়ম্বনা দেখা দিয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো, প্রস্তাবিত ভারতের জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) ও নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ)। এর প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সিএএ ও এনআরসি ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’। তবে, সিএএ পদক্ষেপ হিসেবে ‘প্রয়োজনীয় না’।’

বাংলাদেশের সুপ্ত ভারতবিরোধী মনোভাব ভারতের সিএএ-এনআরসি পরে চাঙ্গা হয়েছে এবং তা ঢাকা-নয়াদিল্লির সম্পর্কের জন্য হুমকি হতে পারে বলে মনে করেন ভারতীয় বিশ্লেষকরা।

অন্যদিকে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনাকেও গুরুত্ব দিচ্ছে নয়াদিল্লি।

নয়াদিল্লি-ভিত্তিক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র গবেষক জয়িতা ভট্টাচার্য জানান, বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার চীন। বাংলাদেশ সবচেয়ে আমদানি করে থাকে চীনে থেকে। ২০১৯ সালে, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ছিল ১৮ বিলিয়ন ডলার, যার সিংহভাগই চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য চীনের পক্ষে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লাভজনক। সম্প্রতি, চীন বাংলাদেশকে আট হাজার ২৫৬টি পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। স্বাধীনতার পর, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার- যারা চীনা অস্ত্র পরিচালনায় দক্ষ ছিলেন তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর চীনা অস্ত্রেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। ফলে, চীনা ট্যাঙ্ক, মিসাইল লঞ্চার, ফাইটার এয়ারক্রাফ্ট ও বেশ কয়েক ধরনের অস্ত্র ব্যবস্থা দ্বারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সজ্জিত। সম্প্রতি চীন থেকে বাংলাদেশ দুটি মিং শ্রেণির সাবমেরিনও কিনেছে।

লাদাখের পর চীনা অস্ত্র বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে ভারত এখন বেশ সংবেদনশীল।

ভারতীয় বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দেশের মধ্যে তিস্তা প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি হলেও পরের বছর পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের আগে এটি নিয়ে শান্তিপূর্ণ আলোচনা কঠিন হবে। দিল্লি এখন প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় যা করতে পারে তা হলো অন্যান্য বিষয়গুলো সমাধান করা।

বাংলাদেশকে দেওয়া আশ্বাস সময়সীমার মধ্যে বাস্তবে রূপ দিতে পারাটাও ভারতের পক্ষে বেশ চ্যালেঞ্জিং।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago