স্লোভেনিয়ার সাথে দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি করতে পারে বাংলাদেশ
মধ্য ইউরোপের দেশ স্লোভেনিয়া। প্রায় ২১ লাখের কাছাকাছি জনসংখ্যার দেশটির উত্তরে অস্ট্রিয়া, পশ্চিমে ইতালি, উত্তর-পূর্বে হাঙ্গেরি, দক্ষিণ-পূর্বে ক্রোয়েশিয়া আর দক্ষিণ-পশ্চিমে আড্রিয়াটিক সাগর। রাজধানী লুবলিয়ানা দেশটির বৃহত্তম শহরও। ১৯৯১ সালের ২৫ জুন প্রথম কোনও রাষ্ট্র হিসেবে স্লোভেনিয়া যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। তারপর থেকেই দেশটি অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ যাবতীয় ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি পেতে থাকে।
যদিও স্লোভেনিয়া অপেক্ষাকৃত নতুন রাষ্ট্র, তবুও শিক্ষাক্ষেত্রে দেশটির অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। ইএফ ইংলিশ প্রফিসিয়েন্সি ইনডেক্স অনুযায়ী স্লোভেনিয়ার স্কোর ৬৪ দশমিক ৪৮, যা বিশ্বে নবম।
ইউনিভার্সিটি অব লুবলিয়ানা, ইউনিভার্সিটি অব মারিবোর, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, ইউনিভার্সিটি অব প্রিমরস্কা দেশটির নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়। এদের মধ্যে ইউনিভার্সিটি অব লুবলিয়ানা এবং ইউনিভার্সিটি অব মারিবোর আন্তর্জাতিক যে কোনও সূচকে বিশ্বের প্রথম ৫০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে স্থান পেয়েছে। আমাদের দেশ থেকে যখন কেউ বাইরের কোনও দেশে আসার পরিকল্পনা করে প্রথমেই যে বিষয়টি মাথায় আসে তা হলো ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যারিয়ার আর এক্ষেত্রে স্লোভেনিয়া অনেকটাই নমনীয়। দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যাচেলর, মাস্টার্স কিংবা পিএইচডি সব ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ডিগ্রি প্রোগ্রাম পাওয়া যায় ইংরেজিতে এবং এখনও ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় স্লোভেনিয়াতে পড়াশোনার খরচ তুলনামূলক কম।
স্লোভেনিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোনও লেভেলে পড়াশোনা করতে হলে এক বছরে টিউশন ফি ২৮০০ ইউরো থেকে ৪০০০ ইউরোর মতো দরকার হয় এবং দেশটির জীবনযাত্রার ব্যয়ও ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। পার্ট টাইম কাজের ক্ষেত্রেও সুবিধা রয়েছে এখানে। ‘এম জব সার্ভিস’ এবং ‘ই-স্টুডেন্টস্কি সার্ভিস’ নামে দুটি সংগঠন রয়েছে যারা শিক্ষার্থীদের পার্টটাইম চাকরির ব্যাপারে সহযোগিতা করে এবং এ দুটি অর্গানাইজেশন স্লোভেনিয়ার প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই স্বীকৃত।
স্লোভেনিয়াতে একজন শিক্ষার্থী লেখাপড়ার পাশাপাশি ফুলটাইম কাজ করতে পারেন। তবে অবশ্যই আয়ের একটি অংশ স্লোভেনিয়া সরকারকে ট্যাক্স হিসেবে দিতে হয়। ফ্ল্যাট ট্যাক্স ২২ শতাংশ এবং সোশ্যাল প্রভিডেন্ট ফান্ড মিলিয়ে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৪- ৪০ শতাংশ। একজন শিক্ষার্থীর জন্য যা অনেক বড় বোঝা। তবে স্লোভেনিয়া সরকারের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক চুক্তির কারণে পৃথিবীর অনেক দেশ এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কিংবা শ্রীলঙ্কার শিক্ষার্থীদেরও ট্যাক্সের এ বিশাল বোঝা থেকে অনেকটা নিষ্কৃতি দেওয়া হয়েছে। বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া, মেসিডোনিয়া, কসোভোসহ কয়েকটি দেশের শিক্ষার্থী কোনো ধরনের ট্যাক্স দেওয়া ছাড়াই স্লোভেনিয়াতে কাজ করতে পারেন। তবে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বড় অংকের ট্যাক্স দিতে হয়। এছাড়াও স্লোভেনিয়াতে মাস্টার্স কিংবা পিএইচডি লেভেলে বেশ কিছু শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা থাকলেও বাংলাদেশ সরকারের সাথে স্লোভেনিয়া সরকারের কোনো চুক্তি না থাকায় সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
স্লোভেনিয়াতে বাংলাদেশের কোনও দূতাবাস নেই। তাই যে কোনও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে দেশটিতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় বাংলাদেশ অ্যাম্বাসির সাথে যোগাযোগ করতে হয়। টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট নবায়ন কিংবা অনেক সময় ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির কাজে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস স্লোভেনিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে লিগালাইজেশন করতে হয়। বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে আগে ভিয়েনাতে বাংলাদেশ অ্যাম্বাসি থেকে এসব ডকুমেন্ট সত্যায়িত করা। তারপরই কেবল স্লোভেনিয়ার মন্ত্রণালয় সেসব ডকুমেন্টস লিগালাইজেশনের জন্য গ্রহণ করে।
স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা থেকে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার দূরত্ব প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। লুবলিয়ানা থেকে ভিয়েনা পৌঁছাতে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার মতো সময় লাগে এবং বাসে লুবলিয়ানা থেকে ভিয়েনা যেতে ২০ ইউরোর মতো খরচ হয়। লুবলিয়ানার সাথে ভিয়েনার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব একটা সহজ নয়। স্লোভেনিয়াতে বাংলাদেশের একটি অনারারি কনস্যুলেট থাকলেও নানা কারণে সেটি দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয়। এছাড়া কারও যদি টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট কিংবা পাসপোর্টের মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে থাকে অথবা কোনও ডকুমেন্টে কোনও সমস্যা থাকে তাহলে তার পক্ষে অস্ট্রিয়াতে যাতায়াত করা সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশ সরকারের সাথে স্লোভেনিয়া সরকারের শিক্ষাভিত্তিক একটি দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি এখন সময়ের দাবি। এটি হলে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা ট্যাক্সের বিশাল বোঝা থেকে অনেকটাই রক্ষা পাবে, যা একজন শিক্ষার্থীর জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। সেই সাথে অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাও শিক্ষাবৃত্তি কিংবা ফান্ডিংসহ স্লোভেনিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে।
পাশাপাশি স্লোভেনিয়াতে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি স্থায়ী এবং কার্যকরী কনস্যুলেট অফিস স্থাপন প্রয়োজন যাতে পাসপোর্ট সেবাসহ যে কোনো ধরনের ডকুমেন্ট সত্যায়ন কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরিষেবা পাওয়া যায়। আশা করি এ সব সমস্যা সমাধান হলে পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের মতো স্লোভেনিয়াতেও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার একটি বড় ক্ষেত্র তৈরি হবে এবং আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরাও গবেষণা ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে স্লোভেনিয়ার বুকেও বাংলাদেশের সুনাম প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হবে।
(লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া)
Comments