রবীন্দ্রনাথ কেন জরুরি

রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য অনেক কারণেই জরুরি। বিশেষভাবে জরুরি তিনি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে। রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বলেছেন। কিন্তু, সেটা একটা বিশেষ ধরনের জাতীয়তাবাদ; সেটির চরিত্র পুঁজিবাদী, আচরণ সাম্রাজ্যবাদী। আরেক প্রকার জাতীয়তাবাদ আছে; সেটি আত্মপরিচয়ের ও আত্মরক্ষার। এই জাতীয়তাবাদ কেবল রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিকও। রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন এর পক্ষে কাজ করেছেন।
Rabindranath Tagore
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য অনেক কারণেই জরুরি। বিশেষভাবে জরুরি তিনি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে। রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বলেছেন। কিন্তু, সেটা একটা বিশেষ ধরনের জাতীয়তাবাদ; সেটির চরিত্র পুঁজিবাদী, আচরণ সাম্রাজ্যবাদী। আরেক প্রকার জাতীয়তাবাদ আছে; সেটি আত্মপরিচয়ের ও আত্মরক্ষার। এই জাতীয়তাবাদ কেবল রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিকও। রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন এর পক্ষে কাজ করেছেন।

বাঙালির জাতীয় সত্তার বিকাশ; জাতীয় পরিচয় সুসংহতকরণ ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন অর্জনের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা তুলনাবিহীন।

বাঙালির জাতীয়তাবাদের শত্রু ছিল দুটি। একটি বাইরের, অপরটি ভেতরের। বাইরেরটি ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী ও অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা। রবীন্দ্রনাথ এই শত্রুর বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন এবং এর বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সজাগ করতে চেষ্টা করেছেন। ভেতরের শত্রু ছিল সাম্প্রদায়িকতা ও শ্রেণি বিভাজন। দুইয়ের ভেতর সম্পর্কটা ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ, এবং তারা উভয়েই নিজ নিজ পদ্ধতিতে সক্রিয় ছিল।

সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারটা মূলত রাজনৈতিক; ব্রিটিশের দুঃশাসন নিরন্তর প্রচেষ্টায় তাকে বাড়িয়ে তুলেছে।

তাদের উস্কানি ভীষণভাবে কার্যকর ছিল। জনগণের মুক্তিকামী স্বাধীনতা আন্দোলনের একেবারে প্রাথমিক শর্ত ছিল সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটানো। সেটা করা গেলে শ্রেণি সমস্যার সমাধানের দিকে এগোনো যেত। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা কমেনি, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। কংগ্রেসের হিন্দু মহাসভাপন্থি অংশ, লিগের স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী ও প্ররোচনাদানকারী ব্রিটিশ— এই তিনে মিলে বাংলাকে ভাগ করে ছেড়েছে। এটি রাষ্ট্রীয় বিভাজন। এর আগে ১৯০৫ সালে প্রশাসনিক বিভাজনের আয়োজন করা হয়েছিল; রবীন্দ্রনাথ তার বিরোধিতা করেছেন, এবং এটা দেখে হতাশ হয়েছে— এই আন্দোলন যে উগ্রপন্থিদের হাতে চলে গেছে তাদের কার্যক্রম সাম্প্রদায়িকতাকে স্তিমিত না করে উল্টো প্রজ্জ্বলিত করছে। এ নিয়ে তার উদ্বেগ ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে প্রকাশ পেয়েছে। বাঙালির ঐক্য ও মুক্তি তিনি সর্বতোভাবে কামনা করেছেন; সে জন্য সাম্প্রদায়িকতা তো অবশ্যই শ্রেণিদূরত্বও ঘোঁচাতে চেয়েছেন। পারেনি। সে ব্যর্থতা তার নয়। তার দেশবাসীর।

আরও অনেক কারণেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য জরুরি, এবং জরুরি থাকবেন। আমরা তাকে নিয়ে গর্ব করব, তার পরিচয়ে নিজেদের পরিচয় দেওয়া অব্যাহত রাখব। রবীন্দ্রনাথ অনেক বিষয়ে আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, বহু ক্ষেত্রে। শান্তিনিকেতনে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে ছাত্র ও অধ্যাপক এসেছেন পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়। যে বহুমুখিনতাকে আধুনিক ইউরোপ তার জন্মকালে অত্যন্ত প্রশংসা করত, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সেই গুণ ছিল, তার আগে অন্য কোনো বাঙালির মধ্যে এটা দেখা যায়নি, পরেও দেখা যাবে বলে আশা করা যায় না। কেননা, ইতোমধ্যে যুগ এসে গেছে বিশেষজ্ঞ হওয়ার। রবীন্দ্রনাথ কেবল বৃহৎ নন, বৃহৎ তো তিনি অবশ্যই, তিনি মহৎও। তার সেই মহত্ত্বের নানা মাত্রা রয়েছে।

সবচেয়ে প্রথম বৈশিষ্ট্য অবশ্য সৃষ্টিশীলতা। অমন সৃষ্টিশীলতা বাঙালির মধ্যে দুর্লভ তো বটেই, কিন্তু এটি এমনি এমনি সৃষ্টি হয়নি। পিছনে ছিল কঠোর পরিশ্রম। শিক্ষিত বাঙালি যে পরিশ্রমপ্রিয় নয় এটা বলবার অপেক্ষা রাখে না। রবীন্দ্রনাথ অবকাশের আবশ্যকতার কথা অনেকভাবে বলেছেন। কিন্তু তাই বলে আলস্য বা অল্পে সন্তুষ্টির প্রশ্রয় তার মধ্যে ছিল এমনটা মোটেই সত্য নয়। বাংলার কৃষক খুবই পরিশ্রমী। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সেই একই শ্রমশীলতা দেখি আমরা। কিন্তু, কৃষক বাধ্যতামূলকভাবেই স্বল্পে সন্তুষ্ট, রবীন্দ্রনাথ যেটা ছিলেন না।

এক কথায় বলতে গেলে বলা যায়— রবীন্দ্রনাথের মূল ভূমিকাটি ছিল সাংস্কৃতিক। এই যে তার সংস্কৃতিচর্চা, এর মধ্যে সাহিত্য আছে, গান তো অবশ্যই রয়েছে, যে গান সম্পর্কে অত্যন্ত সঙ্গতভাবেই তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে, বাঙালিকে তা গাইতে হবে। বাঙালি যত দিন বাঙালি থাকবে ততদিন রবীন্দ্রনাথের গান যে অবশ্যই গাইবে। রবীন্দ্রনাথের গান ভারতের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পেয়েছে, সেটাও খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। ভারতে বাঙালির স্থান আজ যতই প্রান্তবর্তী হোক না কেন, রবীন্দ্রনাথ মোটেই প্রান্তে ছিলেন না, ছিলেন কেন্দ্রে। ভারতীয় মধ্যবিত্তের মনে স্বাধীনতার স্পৃহাকে গভীর করার ব্যাপারে তার ভূমিকা সামান্য ছিল না। তার গান বাংলাদেশেরও জাতীয় সংগীত হয়েছে। যদিও এ বাংলাদেশ সেই অবিভক্ত বাংলা নয়, যার তিনি মুখপাত্র ছিলেন। তিনি ভারতবর্ষের, বিশ্বেরও বটে। কিন্তু তারও আগে তিনি বাংলার। বিশ্বের সঙ্গে নানা সূত্রে তার যোগাযোগ ছিল। তবে সবটাই বাঙালি হিসাবে। বাঙালির নাটকে, চিত্রকলায়, বিজ্ঞানমনস্কতায়, লোকসাহিত্যচর্চায়, ভাষাবিজ্ঞানে কোথায় তিনি ছিলেন না, কোথায় থাকবেন না, অনেককাল?

সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ আমাদেরকে বড় একটি উত্তরাধিকার তুলে দিয়ে গেছেন, সেটা রুচির। দুর্বলের রবীন্দ্রানুরাগ কখনো কখনো কৃত্রিমতার রূপ নেয় এটা সত্য, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজে সব সময়েই সহজ ও অত্যন্ত স্বাভাবিক। রুচি শিক্ষায় আসে না, যদিও শিক্ষা রুচির জন্য অত্যাবশ্যকীয়।

এ কেবল শিল্পকলার চর্চার ভিতর দিয়েও প্রবেশ করবে না। রুচির অভ্যন্তরে রয়েছে, যেমন সব উন্নত রুচিতেই থাকে, একটি নৈতিকবোধ। ন্যায়-অন্যায়ের চেতনা না থাকলে মানুষ মহৎ হয় না, তা যতই সে বৃহৎ হোক না কেন, কিম্বা উঁচু।

serajul_islam_choudhury
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

নৈতিকতাকে রবীন্দ্রনাথ রুচিতে পরিণত করেছিলেন। তার অবিরল ও বহুমুখী সৃষ্টিশীলতার ধারার মধ্যে অবিচলিত ছিল ভালো-মন্দের একটি প্রখর জ্ঞান। নৈতিকতার নানাবিধ শিক্ষার আয়োজন সমাজে বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত নৈতিকতা তখনই নির্ভরযোগ্য ও ধারাবাহিক বিকাশ বজায় রাখতে সক্ষম হয় যখন তা রুচিতে পরিণত হয়। মানবদেহে জিহ্বার যে স্থান, নৈতিকতায় রুচির স্থান যদি সে রকম হয় তাহলে অনেক বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার আশা থাকে। বুদ্ধির তেমন দরকার হবে না, স্বাদই বলে দেবে কোনটা বাসি, কোনটা তাজা, কোনটা গ্রহণযোগ্য, কোনটা বর্জনীয়।

রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন তার সংস্কৃতিচর্চা এই ব্যাপারে সাহায্য করুক তার দেশবাসীকে। এই উত্তরাধিকারকে আরও দৃঢ় ও প্রসারিত করার জন্যও রবীন্দ্রনাথ আমাদের সহায় বটে।

রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু তবু তার পক্ষে না জড়িয়ে উপায় থাকেনি, ওই রুচি বোধের কারণেই। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ তিনি যতটা কার্যকর ও সাংস্কৃতিভাবে করেছিলেন তেমনভাবে অপর কোনো ভারতবাসী করতে পারেননি। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে তিনি যোগ দিয়েছিলেন, স্বভাবতই; কিন্তু পরে এর উগ্র ও সাম্প্রদায়িক প্রবণতা দেখে পিছিয়েও এসেছেন। রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে ভেবেছেন। কী ভেবেছেন সেটাও জানা দরকার।

১৯১৭ সালে জাতীয়তাবাদের ওপরে ইংরেজি বক্তৃতায় রাষ্ট্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি ডিমের খোসার সঙ্গত উপমাটি ব্যবহার করেছিলেন। রাষ্ট্রের কাজ ডিমের খোসার মতো; বলেছিলেন তিনি। আর ওই খোসার উপযোগিতা যে একেক পক্ষের কাছে একেক রকমের সেটাই ছিল তার উল্লেখ করবার বিশেষ বিষয়।

ডিমের ভিতরের ছানাটির জন্য খোসাটি কাজ করে নিরাপত্তাদাতার; কিন্তু প্রাতঃরাশকারীর জন্য খোসার উপকার একেবারেই অন্য প্রকারের। পরাধীন ভারতবর্ষে যে রাষ্ট্রকে রবীন্দ্রনাথ নির্মম অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে জেনেছেন সেটি প্রাতঃরাশকারীরই কাজে লেগেছে, ডিমের ভেতরের ছানার কোনো উপকার করেনি। এ রাষ্ট্র নিরীহ ছিল না, ছিল ভয়াবহ। যে বোতল দিয়ে সে দুধ খাওয়াতো শিশুকে— অর্থাৎ, সরবরাহ করত শিক্ষা, সেটা গিয়েছিল শুকিয়ে; পয়ঃনিষ্কাশন প্রণালী নিজের দুর্দশা দেখে হতাশ হয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি মুখে দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু স্ফীত হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যপ্রদেশ, যেখানে কার্যকর ছিল সামরিক বাহিনী, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, সিআইডি ও টিকটিকি।

এই রাষ্ট্রকে রবীন্দ্রনাথ ধিক্কার দিয়েছেন। তার পক্ষপাত সর্বদাই সমাজের প্রতি। ইউরোপ রাষ্ট্রপ্রধান, ভারতবর্ষ সমাজপ্রধান। আমাদের সমস্যা রাজনৈতিক নয়, সামাজিক। ভারতবর্ষ নিজেকে রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেনি, প্রকাশ করেছে সমাজের মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বিতৃষ্ণার আরেক কারণ হচ্ছে রাজনীতিকরা। তাদের সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না, প্রথম জীবনে। ১৮৯৩ সালে কলকাতার টাউন হলে একটা তামাসা দেখেছিলেন তিনি।

লিখেছেন, ‘সেদিন টাউন হলে মস্ত একটা তামাসা হইয়া গিয়াছে, দুই চারিজন ইংরাজে মিলিয়া আশ্বাসের ডুগডুগি বাজাইতেছিল ও দেশেরি কতগুলি বড় লোক বড় বড় পাগড়ি পরিয়া নাচন আরম্ভ করিয়া দিয়াছে।’ এ ছিল এক ধরনের রাজনীতি। ভিক্ষার, আবেদনের, নিবেদনের।

বিপরীতে ছিল আরেক চরমপন্থা, ব্যক্তিগত সন্ত্রাসের; যাকে তিনি ‘বিভীষিকা’ পন্থা বলেছেন এবং সমর্থন করতে পারেননি, ওই রুচির কারণেই। সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়ে তার মনে হয়েছে তীর্থ ভ্রমণে এসেছেন। বিশেষভাবে মুগ্ধ হয়েছেন সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা দেখে, কিন্তু পছন্দ হয়নি ধনবৈষম্য দূরীকরণের ব্যাপারে বলপ্রয়োগের আয়োজনটিকে।

এর পিছনে কাজ করেছে তার ব্যক্তিগত প্রবণতাও। ‘আমার জন্মগত পেশা জমিদারী, কিন্তু আমার স্বভাবগত পেশা আসমানদারী’, বলেছিলেন তিনি। জমিদারির চেয়ে অবশ্য অনেক অনেক বড় ছিল তার আসমানদারি।

তার চিঠিতে আছে, ‘আমার স্বীকার করতে লজ্জা করে এবং ভেবে দেখতে দুঃখ হয়— কারণ মানুষের সংসর্গ আমাকে বড় বেশি উদভ্রান্ত করে দেয়—আমার চারিদিকেই এমন একটা গণ্ডি আছে আমি কিছুতেই ভাঙতে পারিনে— অথচ মানুষের সংসর্গ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকাও আমার পক্ষে স্বাভাবিক নয়— থেকে থেকে মানুষের মাঝখানে গিয়ে গড়তে ইচ্ছা করে— মানুষের সঙ্গে যে জীবনোত্তাপ তাও যেন প্রাণ ধারণের পক্ষে আবশ্যক।’ (‘ছিন্নপত্র’, ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯১৪)।

রাষ্ট্রের তুলনায় সমাজ সম্পর্কে অনেক বেশি বলেছেন তিনি। তপোবনের কথা তার রচনার নানা স্থানে পাওয়া যায়। এই তপোবন গান্ধীর রামরাজ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে হয়তো, কিন্তু তবু তফাৎ আছে।

রবীন্দ্রনাথের তপোবন ভবিষ্যতের স্বপ্ন, গান্ধীর রাম রাজ্য অতীতের স্মৃতি। গান্ধী মোটেই সাম্প্রদায়িক ছিলেন না; ধর্মের চেয়ে মানুষ বড়— এটা তিনি সর্বদাই বলেছেন, কিন্তু গান্ধী যে ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন সেটাও সত্য। কাজটা তিনি শুরু করেননি, মিশ্রণের ব্যাধি আগেই ছিল। কিন্তু এই ব্যাধিকে তিনি নিরুৎসাহিত না করে বরঞ্চ উৎসাহিত করেছেন।

বললে অন্যায় হবে না যে, গান্ধী যে অর্থে ইহজাগতিক হতে অস্বীকার করেছেন, রবীন্দ্রনাথ প্রায় সে অর্থেই ইহজাগতিক ছিলেন। গান্ধী ইতিহাসে উৎসাহী ছিলেন না। কেননা, সত্যের কোনো ইতিহাস নেই বলে তিনি মনে করতেন। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ ইতিহাসে বিশ্বাসী ছিলেন। সে ইতিহাস রাজা-বাদশার মারামারি কাটাকাটির বিবরণ নয়। সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের ইতিহাস বটে। এই ইতিহাস জনগণ রচনা করে, কঠিন শ্রমে। রবীন্দ্রনাথের লেখায় দেখব তার গভীর আস্থা ছিল ইহজাগতিকতার দুটি ভিত্তিতে— বিজ্ঞানে ও যুক্তিবাদিতায়।

গান্ধীর সঙ্গে এ ব্যাপারে তার বিরোধের অত্যন্ত নাটকীয় প্রকাশ ঘটেছিল, বিহারে যখন ভয়ঙ্কর এক ভূমিকম্প ঘটে তখন। ১৯৩৪ সালের সেই ঘটনার সময় গান্ধী বলেছিলেন, ‘এ হচ্ছে অস্পৃশ্যতার পাপের জন্য বিধাতা প্রেরিত শাস্তি।’ রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করেন। রাজনীতিক গান্ধীর সমালোচনা করে কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে, ‘গান্ধী যে শুধু ঈশ্বরকে টেনে আনছেন তা নয়, তিনি এমন এক ঈশ্বরের ধারণা প্রচার করেছেন যিনি পাপীকে শান্তি দিতে গিয়ে নিষ্পাপকেও সাজা দিয়ে ফেলেন। তার চেয়েও বড় কথা, গান্ধী সেই অন্ধত্বকেই শক্তিশালী করেছেন যা মানুষের দুর্ভোগের কারণ খোঁজে ঐশ্বরিক জগতে।’ গান্ধী এর উপযুক্ত জবাব দিতে পারেননি। তবে তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন।

সমাজে বিচ্ছিন্নতার দৌরাত্ম্য যে বৃদ্ধি পাচ্ছিল তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি জানতেন যে এর প্রধান কারণ হচ্ছে বৈষম্য। পুঁজিবাদ যে বৈষম্যকে পুষ্ট করেছে, কিন্তু তাই বলে এই মত তিনি প্রচার করেননি যে, যন্ত্রকে পরিত্যাগ করে চলে যেতে হবে কুটির শিল্প ও ব্যক্তিগত উৎপাদনের যুগে। ‘রক্ত করবী’তে পুঁজিবাদের প্রাণবিনাশী বস্তুতান্ত্রিকতার ভয়াবহতাকে তিনি আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন। কমিউনিস্টদের তিনি বলপ্রয়োগকারী হিসাবেই জানেন, কিন্তু ‘অমৃত’ নামের কবিতায় অমিয়া যে জেলগেটে রায়বাহাদুর নন্দন কমিউনিস্ট মহীভূষণকে বরণ করে নিচ্ছে সেটা এই ভরসাতেই যে, মহীভূষণ তাকে মুক্তি দেবে অন্য এক কারাগার থেকে, সে-কারাগার উপকরণের, সে কারাগার বস্তুতান্ত্রিকতার। পরাধীন ভারতে ভারতবাসী যে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল তার প্রধান কারণ এই নয় যে, দেশ অন্যরা দখল করে নিয়েছিল। প্রধান কারণ এটা যে, সেবা ও ত্যাগের দ্বারা দেশকে ভারতবাসী নিজেদের আত্মীয় করে নিতে পারেনি। কারণ অবশ্য আরও একটি ছিল। সেটি ধনবৈষম্য। ‘মোটকথা হচ্ছে দেশের যে অতিক্ষুদ্র অংশে বিদ্যাবুদ্ধি, ধনমান, সেই শতকরা পাঁচ পরিমাণ লোকের সঙ্গে পঁচানব্বই পরিমাণ লোকের ব্যবধান মহাসমুদ্রের ব্যবধানের চেয়ে বেশি।’ ‘আমরা এক দেশে আছি, অথচ আমাদের এক দেশ নয়।’ (‘পল্লী সমাজ’) তিনি জেনেছেন, ‘রাশীকৃত বিচ্ছিন্নতাকে কেবলমাত্র স্তূপাকার করিতে থাকিলেই তারা এক হয় না।’ (‘স্বদেশী সমাজ’) এবং এ উপলব্ধিও অত্যন্ত প্রখর ছিল তার কাছে যে, ‘বিচ্ছিন্নতা যেখানে প্রবল সেখানে বিপ্লব না এলে তার সমন্বয় হয় না, কিন্তু রাষ্ট্রতন্ত্রে, কি সমাজতন্ত্রে, কি ধর্মতন্ত্রে’।  (‘সামঞ্জস্য’, ‘শান্তিনিকেতন’)।

ধনবৈষম্য তাই দূর করা আবশ্যক। কিন্তু, কাজটা ‘জবরদস্তি’ দ্বারা সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলুপ্ত করাও অসম্ভব কাজ। এই দুই সত্যকে মেনে নিয়ে তিনি একটি ‘মাঝামাঝি সমাধান’ সন্ধানের কথা বলেছেন। বলা বাহুল্য, ওই মাঝামাঝি সমাধান এখনও পাওয়া যায়নি, এবং ইতোমধ্যে ধনবৈষম্য এবং তার ফলে বিচ্ছিন্নতা অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

সমাজের দুর্বলতাগুলো ভিতর থেকে সংশোধন করতে হবে; সে সমাধান সামাজিক বটে, রাজনৈতিক নয়, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। সে উদ্যোগ তিনি ব্যক্তিগতভাবেও নিয়েছেন; কৃষি ব্যাংক, সমবায়, বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়— এসব পরিকল্পনা তিনি কার্যকর করেছেন, তার নিজের মতো করে; কিন্তু এসব যে বৃহৎ অগ্নিকাণ্ডের মুখোমুখি হয়ে কয়েক বালতি জল নিক্ষেপ মাত্র, এও তিনি জানতেন। তবু শুরু করতে হয়, এগিয়ে আসতে হয়। তিনি এগিয়ে গেছেন। জরুরি ছিল নেতৃত্ব গড়ে তোলা। সমাজকে পরিচালনা করার জন্য নেতা দরকার। ‘আমাদের প্রথম কাজ হইবে’, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘যেমন করিয়া হউক একটি লোক স্থির করা এবং তাহার নিকট বশ্যতা স্বীকার করিয়া ধীরে ধীরে ক্রমে ক্রমে তাহার চারিদিকে একটি ব্যবস্থাতন্ত্র গড়িয়া তোলা।’ (‘স্বদেশী সমাজ’) পরে সংশোধন করে বলেছেন, ‘একজন নয়, দুজন সমাজপতির আবশ্যক হবে। এই দুজন আসবেন দুই সম্প্রদায় থেকে।’ এখানে সমাধানের চেয়ে অধিক তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে স্বীকৃতি। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন যে, সমাজে একটি নয়, দুটি সম্প্রদায় রয়েছে। মুসলমানরা পিছিয়ে আছে বটে, কিন্তু তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদেরকে বিবেচনার মধ্যে না আনলে সমস্যার সমাধান তো হবেই না, সমস্যা প্রবল থেকে প্রবলতর হবে, এবং তা হয়েছেও, হয়ে বঙ্গভূমিকে দুটুকরো করে ফেলেছে। মধ্যখানে নদী নেই, নদী যাচ্ছে শুকিয়ে, যাতে প্রবলতর হচ্ছে দূরত্ব।

রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে এই চিন্তাধারার উত্তরাধিকার তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন। এর সবটা নির্বিচারে গ্রহণ করতে হবে— এ শিক্ষা রবীন্দ্রনাথ আমাদেরকে দেননি। দেবেন না। গ্রহণের স্বার্থেই বর্জনও প্রয়োজন হবে, রবীন্দ্রনাথ সারা জীবনই ওই কাজটি করেছেন। কিন্তু বর্জনের মধ্যেও শিখবার থাকবে অনেক কিছু।

চিন্তাও রুচিরই অংশ বটে। সার্বজনীন তো নয়ই, ব্যাপকভাবে গৃহীত কোনো রুচিও আমরা গড়ে তুলতে পারিনি।

মানুষ ভাগ হয়ে গেছে শ্রেণিতে ও সম্প্রদায়ে। দেশও ভাগ হয়ে গেছে। দেশের এই ভাগাভাগিটা রবীন্দ্রনাথকে দেখতে হয়নি, নজরুলও করুণভাবে বেঁচে গেছেন সম্বিতহারা হওয়ার দরুন, জীবনানন্দ দাশ এর ফলে উদ্বাস্তু হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন কলকাতার বৈরী পরিবেশে। ক্ষতি হয়েছে অর্থনীতির, নদীর, সংস্কৃতির। এখন আবার নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে বিশ্বায়নের, যার মর্মার্থ হচ্ছে একচেটিয়া লগ্নিপুঁজির দুর্বৃত্তায়ন। সেই যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আমরা একবার চলে গিয়েছিলাম, তার অভিশাপ থেকে এখনও মুক্ত হইনি, তার ওপর আবার আরও ভয়ঙ্কর কিন্তু ছদ্মবেশী অভিশাপ নেমে আসতে চাইছে।

নিজের পায়ে দাঁড়ানোর, নিজের স্বাভাবিকতা ও সৃষ্টিশীলতাকে বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় যে প্রতিরোধ তার জন্য রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত জরুরি বৈকি। এই প্রতিরোধ ইতিবাচকও বটে— অর্থাৎ, এর জন্য রুচিকে গড়ে তোলা চাই, যেখানে রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যসহচর। আত্মসমর্পণ যে ধ্বংসের নামান্তর, রবীন্দ্রনাথের সাধনার মধ্যে এই বাণী নিরন্তর উচ্চারিত। তিনি পথ দেখান এবং আশা দেন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক

Comments

The Daily Star  | English
Pro-Palestinian protests on US campuses

Has the war in Gaza exposed limitations of free speech in US?

Protests have rocked US university campuses over the last week as pro-Palestinian students have encamped on the grounds of Columbia, Yale, and New York University, among other prestigious educational institutions, urging universities to divest from the state of Israel amid the ongoing genocide.

1h ago