ভ্যাকসিন পাওয়ার দৌড়ে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন পাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত পুরো পৃথিবী। যাদের সাধ্য আছে তারা ব্যস্ত ভ্যাকসিন আবিষ্কারে। আর যাদের সাধ্য নেই তারা চেষ্টা করছে— যে দেশই ভ্যাকসিন আবিষ্কার করুক না কেনো সে দেশ থেকে তা সংগ্রহ করতে। বর্তমানে বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন ক্লিনিকাল ট্রায়ালের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এই ভ্যাকসিন পাওয়ার দৌড়ে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, কেবলমাত্র গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনসের (জিএভিআই) সদস্য হওয়ার আগ্রহ প্রকাশের মাধ্যমে সরকার বহুল কাঙ্ক্ষিত ভ্যাকসিন পাওয়ার পথে সামান্য কিছুটা অগ্রসর হয়েছে।
করোনার ভ্যাকসিন বিনামূল্যে দেওয়া হবে, নাকি উৎপাদন খরচের কিছুটা নেওয়া হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আগামী মাসে বোর্ড মিটিংয়ে বসবে জিএভিআই। সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে ‘সবার জন্য টিকা’ নিশ্চিত করতে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এখনও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির (এনটিএসি) সুপারিশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গতি অর্জন করতে পারেনি সরকার।
গত ১৯ আগস্ট এনটিএসি-এর ১৭তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তৃতীয় পর্যায়ে থাকা সংস্থা বা দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। ট্রায়ালের তৃতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশকে অংশ নিতেও পরামর্শ দিয়েছে এই কমিটি। যাতে করে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল সফল হওয়ার পর বাংলাদেশ ‘গ্যারান্টি বেনিফিট’ পেতে পারে।
এনটিএসির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা প্রতিযোগিতায় (ভ্যাকসিন সংগ্রহের) অনেক পিছিয়ে আছি। মূল প্রশ্নটা হলো, আমরা কোনো প্রস্তুতকারকের কাছ থেকে সরাসরি ভ্যাকসিন নিতে পারব কিনা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা জিএভিআই এর বিষয়টি আসবে পরে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী চার থেকে দশ মাসের মধ্যে সবার ব্যবহারের জন্য বাজারে প্রচুর পরিমাণে ভ্যাকসিন পাওয়া যেতে পারে। তবে এগুলো কতটা কার্যকর হবে বা কত দিনের জন্য কার্যকর থাকবে তা পরিষ্কার নয়।
বিশ্বের ২০৩টিরও বেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বর্তমানে আটটি প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য কাজ করছে। শেষ পর্যায়ের ট্রায়ালে থাকা এই আট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছয়টি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত।
তৃতীয় পর্যায় বা চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষার অর্থ, হাজার হাজার মানুষকে এই ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। বিশ্বের অনেক দেশ বিভিন্ন ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় স্বেচ্ছাসেবক হয়েছে।
গত ৯ আগস্ট সৌদি আরবের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে যে চীনের ক্যানসিনো বায়োলজিক্স তাদের দেশে তৃতীয় পর্যায়ের এই পরীক্ষা চালাতে পারবে। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের শেষ পর্যায়ে থাকা চীনের তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্যানসিনো অন্যতম।
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের কাজ করছে এমন আরেকটি চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাক। এই প্রতিষ্ঠান তাদের তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশকে।
নিউইয়র্ক টাইমসের ভ্যাকসিন ট্রাকারের প্রতিবেদন অনুসারে, ১৩৫টিরও বেশি ভ্যাকসিন প্রার্থী দেশ প্রাক-ক্লিনিকাল বা ক্লিনিকাল ট্রায়ালে রয়েছেন। যাদের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে রয়েছে ২১টি এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে ১৩টি দেশ।
ব্রাজিল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, চিলি, ফিলিপাইন, তুরস্কসহ বেশ কয়েকটি দেশে চীনের ভ্যাকসিন ট্রায়াল চললেও বাংলাদেশ এখনও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
চীনের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের মধ্যে ১৭ আগস্ট বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও, পরবর্তীতে তা স্থগিত করা হয়।
বৈঠক স্থগিত করার একদিন পর পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব হার্শ বর্ধন শ্রিংলাকে জানান, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন উৎপাদন ও ট্রায়ালে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
একই দিনে ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করে যে এই বছরের শেষ নাগাদ ভারতীয়দের জন্য অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন আনার বিষয়ে চিন্তা করছে ভারত সরকার। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা তাদের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত পর্বের পরীক্ষা চালাচ্ছে।
অধ্যাপক নজরুলের মতে, সরকার চীনের ভ্যাকসিন পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশ যদি এই ট্রায়ালে অংশ নেয়, তাহলে ভ্যাকসিন পাওয়া সহজ হবে। তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত শিগগির এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান ডেইলি স্টারকে জানান, ভ্যাকসিনগুলো এখনও তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে থাকলেও অনেক উন্নত দেশ ইতোমধ্যে এগুলোর জন্য অগ্রিম অর্থ প্রদান করেছে।
উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠানের ট্রায়াল শেষ হলে সংশ্লিষ্ট দেশ ও জাতিসংঘ ভ্যাকসিনগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে একটি ট্রায়াল পরিচালনা করবে।
এখনও এসব ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া না গেলেও উন্নত এবং ধনী দেশগুলো ইতোমধ্যে উৎপাদক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ৩০ কোটি থেকে ১০০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন বুক করেছে।
অনুমোদন পাওয়ার পর উদ্ভাবক ও তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রথম ছয় মাসে সর্বোচ্চ ৩০ কোটি ডোজ একক ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে সক্ষম হতে পারে। এই ভ্যাকসিনগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাবে ধনী দেশগুলো, যারা ইতোমধ্যে এর জন্য আগাম অর্থ দিয়ে রেখেছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে আছি।’
বাংলাদেশের উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে তাদের ভ্যাকসিন তৈরির জন্য আমন্ত্রণ জানানো উচিত জানিয়ে অধ্যাপক রহমান বলেন, ‘এর ফলে আলোচনার টেবিলে বাংলাদেশ আরও শক্ত অবস্থানে থাকবে। সেই সঙ্গে ভ্যাকসিন পাওয়ার সময়ও সাশ্রয় করতে পারে।’
‘এখন পর্যন্ত আমরা জানি, আরও একটি নতুন ভ্যাকসিন উৎপাদন কেন্দ্র আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কার্যকর হতে পারে।’
ভ্যাকসিন পাওয়ার উপায়
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের তিনটি উপায় রয়েছে।
প্রথমত, চার হাজার ডলারের কম জিডিপির দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ তার প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনের ২০ শতাংশ পেতে পারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এবং জিএভিআইয়ের কাছ থেকে।
এটি কোভিক্স সুবিধার আওতায় পাওয়া যাবে। বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দ্রুত, সুষ্ঠু ও ন্যায়সঙ্গত ভাবে বিতরণের জন্য এটি একটি প্রক্রিয়া।
কোভিক্স বর্তমানে নয়টি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ট্রায়ালকারী সংস্থাকে নিয়ে কাজ করছে। তাদের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে নিবন্ধন করা দেশগুলোতে দুই বিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, বিশ্বের প্রায় ১৭২টি দেশ এই কর্মসূচীর আওতায় রয়েছে। এসব দেশের অনেকগুলোকেই এই কর্মসূচির আওতায় ভ্যাকসিনের আংশিক অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য প্রথম বিকল্পটি এখনও নিশ্চিত না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, বাংলাদেশ শুধুমাত্র ভ্যাকসিনের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এই ভ্যাকসিন বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে পাওয়া যাবে কিনা তা নির্ভর করছে পরবর্তী মাসে জিএভিআইয়ের বোর্ড সভার সিদ্ধান্তের ওপর।
দ্বিতীয়ত, ভ্যাকসিন উদ্ভাবনকারী সংস্থা বা সরকারে সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা।
বাংলাদেশ এখনও এমন কোনো প্রচেষ্টা করেনি।
তৃতীয়ত, ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অংশ হয়ে। সেটা হতে পারে আইসিডিডিআর,বি-তে সিনোভাকের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল কিংবা কোনো ভারতীয় ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের মাধ্যমে।
গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) লাইন ডিরেক্টর শামসুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ভ্যাকসিন পাওয়ার চেষ্টা চলছে। আমি যতদূর জানি, মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিভিন্ন জায়গায় এ বিষয়ে যোগাযোগ করছেন।’
গত সোমবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন আনতে সরকারের সকল সংশ্লিষ্ট বিভাগ সক্রিয় রয়েছে।’
গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ কয়েকটি দেশ ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
তিনি আরও যোগ করেন, ‘এই ভ্যাকসিনগুলোর গুণগত মান পরীক্ষার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত দেবেন।’
Comments