লালন একাডেমি: ভবন আছে, দর্শনের প্রচার নেই
প্রায় দুইশ বছর ধরে ফকির লালন শাহ’র বাউল-দর্শন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বাউল দর্শন-প্রিয় মানুষ ও লোক-দর্শনের গবেষকদের নানাভাবে সমৃদ্ধ করলেও এই মরমী বাউলের নামে তারই মাজার প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠিত লালন একাডেমি বাউল-দর্শন প্রচার ও প্রসারে প্রায় কোনো ভূমিকাই পালন করতে পারছে না।
মাজার ঘিরে বেশ কিছু স্থাপনা নানা আঙ্গিকে গড়ে উঠলেও সেগুলো কেবল অট্টালিকার শোভা বর্ধন করছে। বাউল-দর্শনের উন্নয়ন, এ দর্শনকে ছড়িয়ে দিতে সেগুলোর একেবারেই কার্যকর কোনো ভূমিকায় নেই।
অথচ বাউল-অনুসারী, লালন-গবেষক, লালন-ভক্ত ও বাউলরা বলছেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মনোযোগ সৃষ্টি ও দৃষ্টি আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারতো এই লালন একাডেমি। কিন্তু, অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তা হয়ে উঠেনি।
ফকির লালন (জন্ম: আনুমানিক ১৭৭২/৭৪ – মৃত্যু: ১৮৯০) তার দর্শন নিয়ে প্রসিদ্ধি লাভ করেন ১৭৯০ থেকে ১৮১০ সালের মধ্যে। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কালি নদীর ঠিক ওপরে ছেঁউরিয়া গ্রামে ছিল লালনের বাস। লালনের দর্শনের যাত্রা সেখান থেকেই। লালন-দর্শন বলতে বোঝায় তার গান। তার রেখে যাওয়া দুই হাজার মতো গান ও গানের বাণীই মূলত লালন-দর্শন।
ঐ সময়টিকে লালন-দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু ধরলে তারও প্রায় ১৫০ বছর পর লালনের আখড়াবাড়িতে ১৯৬৩ সালে লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এটি ছিল একটি বেসরকারি উদ্যোগ। পরে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ১৯৬৫ সালে সরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় লালন একাডেমি। ১৯৭৮ সালে লালন একাডেমি একটি পূর্ণ অবয়ব পায়। সরকারের স্থানীয় প্রশাসন এর নিয়ন্ত্রণ নেয়।
তবে অনেক আগে থেকেই আখড়াবাড়িতে লালন সেবাসদন ও মাজার কমিটি নামে লালনের অনুসারীদের নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান কার্যকর ছিল। এই প্রতিষ্ঠানটি লালন মাজারের দেখভাল ছাড়াও লালনের জীবদ্দশা থেকে চলে আসা দোল উৎসব বা তিরোধান দিবসের (১ কার্তিক) মতো অনুষ্ঠানাদি পালনের মধ্য দিয়ে বাউলচর্চা অব্যাহত রেখেছিল।
লালন একাডেমি গঠনের পর আমালাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ে পড়ে লালনের অনুসারীদের একটি বড় অংশ তার মাজার থেকে বের হয়ে যান। কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বে মামলা পর্যন্ত হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সম্প্রতি এ বিষয়ে রায়ও দিয়েছেন।
যা হোক প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে লালন একাডেমি যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা বাস্তবায়নে খুব সাফল্য দেখাতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানটি যেমন একদিকে বিকশিত হতে পারেনি, তেমনি লালন-দর্শন বিস্তারে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।
একাডেমি পরিচালিত হয়ে আসছে একটি নির্বাচিত কমিটির মাধ্যমে। আজীবন সদস্য ও সাধারণ সদস্যরা এক বছরের জন্য ভোট দিয়ে এ কমিটি গঠন করে থাকেন। বর্তমানে আজীবন ও সাধারণ মিলে ভোটার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এখানে একজন সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের কমিটি গঠিত হয়ে থাকে। স্থানীয় জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে এর সভাপতি।
লালন সেবাসদন ও মাজার কমিটির মামলার পর হাইকোর্ট বিভাগের ২০১৩ সালের রায়ে নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। আপিল বিভাগের আরেকটি রায় ২০১৯ সালে আসে। এখন একাডেমির প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম বন্ধ।
জেলা প্রশাসন লালন একাডেমির সাবেক কিছু সদস্য নিয়ে এডহক কমিটি করে একাডেমির কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
লালন একাডেমিতে যা যা রয়েছে
লালন একাডেমি বলতে ১৯৯৮ সালে সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত একটি দ্বিতল অডিটোরিয়াম, সঙ্গেই চারতলা ভবনে লালন একাডেমি। ভবনের নিচতলায় রয়েছে লালন শাহর জীবদ্দশায় ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে লাইব্রেরি যেখানে লালন-দর্শনভিত্তিক বিভিন্ন গবেষক ও লেখকদের লেখা কিছু বইপত্র। তৃতীয় তলায় একাডেমি পরিচালনা পর্ষদের অফিস কক্ষ এবং চতুর্থ তলার হলরুমটিতে শেখানো হয় লালন সংগীত।
এখানে একাডেমির একমাত্র একাডেমিক কার্যক্রম বলতে সংগীত বিভাগ। এর যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালে। শুরুর দিকে সংগীত শিক্ষার্থী না পাওয়া গেলেও ধীরে ধীরে বেড়ে এখানে কাগজে-কলমে ৭৯ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। সপ্তাহে দুই দিন সংগীত ক্লাসে অংশ নেয় ৩০ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থী। তারা সবাই বয়সে নবীন।
লালন একাডেমির অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। একাডেমির অনেক দায়িত্ব থাকলেও বর্তমানে এটি মাজার দেখভাল, বছরে যে অনুষ্ঠানগুলো হয় তা আয়োজনের কাজ করে। তাদের হাতে অর্থ নেই বলে দ্য ডেইলি স্টারকে জানান এর কর্মকর্তারা। অর্থ বলতে বছরে দুটি অনুষ্ঠান থেকে আয়োজিত মেলায় স্টল বরাদ্দ দিয়ে একাডেমির আয় হয় প্রায় ১০ লাখ টাকা এবং মাজারের ‘সিন্দুক অনুদান’ থেকে আয় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে বার্ষিক অনুদান আসে দেড় লাখ টাকা।
একাডেমির সর্বশেষ নির্বাচিত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ও পরে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সেলিম হক ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে বছরে দুটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হয়। যেখানে খরচ হয়ে যায় প্রায় ৩০ লাখ টাকার বেশি। লালন-দর্শন উন্নয়নে কাজ করবার সুযোগ পাওয়া যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘একাডেমি থেকে গবেষণা জার্নাল, গবেষণা বই, বাউল সংগীত উন্নয়নে নানা উদ্যোগ আমাদের মাথায় থাকে কিন্তু তা করা হয়ে উঠে না।’
সেলিম হক বর্তমান এডহক কমিটিরও সদস্য। তিনি ডেইলি স্টারকে জানান, একাডেমির স্টাফ ১৬ জন। প্রতিদিন মাজারের পবিতা রক্ষায় পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা একটি বড় বিষয়। তাদের বেতন দিতে প্রতিনিয়তই হিমশিম খেতে হয়। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির কারণে পুরো মাজার এলাকা লকডাউনে রয়েছে। এতে মাজারের আয় আরও কমে যাবে।’
সেলিম হক সরকারি উদ্যোগের দাবি জানান।
বাউল আব্দুল কুদ্দুস একাডেমির সংগীত প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ডেইলি স্টারকে জানান, তারা দুই জন শিক্ষক প্রশিক্ষণ চালিয়ে নিচ্ছেন। বলেন, ‘একটি সংগীত বিদ্যালয় চালাতে যেসব আনুষঙ্গিক উপকরণের প্রয়োজন হয় এখানে তার কোনোটিই নেই। স্থানীয় একটি এনজিও এই সংগীত শাখা পরিচালনা করতে মাসে ২১ হাজার টাকা অনুদান দিয়ে থাকে।’একাডেমির সভাপতি ও কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আইনগত জটিলতার কারণে একাডেমির নির্বাচন করা যাচ্ছে না। তবে একাডেমির উন্নয়নে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে।’
দেশ ও দেশের বাইরে থেকে যাতে লালন গবেষকরা এখানে এসে অবস্থান করতে পারেন সেজন্য ভালোমানের একটি পর্যটন মোটেল নির্মাণ, একটি গবেষণা সেল গঠন করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান তিনি।
‘জেলা ব্রান্ডিং-এ লালন একাডেমির উন্নয়নে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে,’ যোগ করেন তিনি।
Comments