নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে গ্রাম ছাড়ছেন প্রতাপনগর ও শ্রীউলার মানুষ
নদীভাঙনে তিনটি ঘরই বিলীন হয়ে গেছে ৫২ বছর বয়সী কামরুজ্জামানের। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আগে আশ্রয় নিয়েছিলেন প্রতাপনগর লঞ্চঘাটে। ভেবেছিলেন নদীর ভাঙন ঠিক হলে আবার বাস্তুভিটায় ফিরবেন। কিন্তু, গত ১৯ আগস্ট থেকে প্রবল বৃষ্টি ও খোলপেটুয়া নদীর জোয়ারের পানির চাপে পুরো গ্রাম নয় পুরো ইউনিয়ন এখন পানির নিচে। এমন পরিস্থিতিতে কেউ কারো পাশে দাঁড়াতে পারছেন না। কামরুজ্জামানের ঘরে কোনো খাবার নেই। নেই সুপেয় পানি। তাই বাধ্য হয়েই এবার এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন কামরুজ্জামান।
কামরুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাউনিয়া ইউনিয়নে লঞ্চঘাট এলাকায় খোলপেটুয়া নদীর ধারে দশ কাঠা জমির উপর ছিল আমার বসতবাড়ি। নদীতে মাছ ধরে আবার কখনো শ্রমিকের কাজ করে ভালোই ছিলাম। গত বছর নতুন করে একটি ঘর বেঁধেছিলাম। স্বপ্ন ছিল পৈত্রিক জমিতে একটি কবরস্থান করার। কিন্তু, সেই স্বপ্ন আর পূরণ হবার নয়। বাড়িঘর ও জমি সব বিলীন হয়ে গেছে নদীতে।’
‘বাধ্য হয়ে বেঁচে থাকার জন্য গ্রাম ছেড়েছি। কোথায় যাব তা ঠিক না থাকলেও প্রথমে আশাশুনি সদরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাব। তারপর ঠিক করব কোথায় স্থায়ী হওয়া যায়। তবে, আর গ্রামের ফিরতে চাই না,’ যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘দুর্যোগ এলেই বাঁধ ভাঙে আর কপাল পোড়ে আমাদের। এখন গ্রামে আর কিছু থাকলো না, ফিরে আর কী হবে। তার চেয়ে শহরে থিতু হওয়ার কথা ভাবছি।’
কামরুজ্জমানের প্রতিবেশী নজরুল ইসলামও গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তারও চিত্র একই।
তিনি বলেন, ‘কুল্যা ইউনিয়নে দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছি। সেখানে কী করা যায় ভাবতে হবে। তবে, আর গ্রামে ফিরতে চাই না।’
গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছেন চাকলা গ্রামের কুরবান সরদার, সকিনা খাতুন, আরবিনা বিবি, রোকসনা বেগম, আলাউদ্দিন সরদার ও নাসিরউদ্দিন সরদার।
তারা জানান, নদীর ধারে তাদের বসবাস। দাদার আমল থেকে এখানে বসবাস করে আসছেন। দাদা ও বাবাকে এ ভিটায় কবর দিয়েছেন। কিন্তু, দুর্যোগ এলে চাকলা এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ভেঙে যায়। তাই সবসময় উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন পার করতে হয়। এভাবে তো আর চলা যায় না। ১৯ আগস্টের জোয়ার আর অতিবৃষ্টিতে তাদের সবকিছু নদীতে চলে গেছে। গ্রামে থাকার মতো অবস্থা নেই। মাথা গোঁজার ঠাই নেই। খাবার নেই। বাঁধ কবে মেরামত হবে তাও কেউ বলতে পারে না। তাই বাধ্য হয়েই সাতক্ষীরা শহরে যাচ্ছেন সবাই। সেখান থেকে সিদ্ধান্তে নেবেন কোথায় যাবেন।
আশাশুনি প্রতাপনগর ও শ্রীউলা ইউনিয়নের একই অবস্থা। প্রতিদিনই কেউ না কেউ বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে গ্রামে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। প্রতাপনগরের ১৮টি গ্রামের আট হাজার ১১৮ পরিবারে জনসংখ্যা ৩৮ হাজার। ১৮টি গ্রামের ফসলি জমি, চিংড়ি ঘের, পুকুর, জলাশয়, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট সব পানিতে তলিয়ে গেছে।
শ্রীউলা ইউনিয়নের ২২টি গ্রামের সাত হাজার পরিবারের ৩২ হাজার পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত। পানিতে তলিয়ে আছে এখানের সবকিছু। এই দুই ইউনিয়নের যোগাযোগ ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে যারা গ্রামে আছেন তারা সব হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
তিন মাসের অধিক সময় ধরে এই দুই ইউনিয়ন পানিতে তলিয়ে আছে। লোকালয়ে নদীর লোনা পানি ঢোকা বন্ধ করতে পারেননি বলে জানান প্রতাপনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন।
জাকির হোসেন বলেন, ‘প্রচণ্ড জোয়ার ও বৃষ্টির কারণে এই ইউনিয়ন এখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। মানুষ তো স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। এখানকার বিপর্যয় দেখলে নতুন করে কেউ স্বপ্ন দেখতে পারবে না। তাই বাধ্য হয়ে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অন্যত্র চলে যাচ্ছে।’
শ্রীউলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু হেনা সাকিল বলেন, ‘বেঁচে থাকতে হলে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে না যেয়ে কী করবে। কবে বাঁধ সংস্কার হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।’
Comments