করোনা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব ও অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান।

• ১০ দিন আগে যে পরিমাণ রোগী ছিল, এখন তার থেকে বেড়েছে বা বাড়ছে।

• এখনকার রোগীদের মধ্যে শ্বাসযন্ত্র সংক্রান্ত সমস্যা আগের রোগীদের থেকে বেশি।

• বাংলাদেশে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আছে বা এটি বাংলাদেশ থেকে চলে যাবে, তা বলার কোনো সুযোগই নেই।

• মার্চের মতো বিভ্রান্তিমূলক মন্তব্যগুলো করোনা পরিস্থিতি আরও জটিল করে দিতে পারে।

• সার্বজনীনভাবে পরীক্ষা তো আমাদের হয়নি। তাহলে কম-বেশি কীভাবে বলা যাবে?

• সার্বিকভাবে বড় ধরনের কোনো সার্ভে না করে “কমেছে” বলার কোনো সুযোগ তো নেই। আর করোনার সংক্রমণ কমার তো কোনো উপযুক্ত কারণও দেখছি না। স্বাস্থ্যবিধি তো মানা হচ্ছে না।

• দেশে সংক্রমণ কমে গেছে, সেটা এখন বলা ঠিক না।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ইতোমধ্যে তিন লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে, এখন পর্যন্ত মারা গেছেন চার হাজার ১৭৪ জন, আর সুস্থ হয়েছেন এক লাখ ৯৬ হাজার ৮৩৬ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া করোনা তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিদিন যা পরীক্ষা হচ্ছে, এতে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। আর মারা যাচ্ছেন ৪০ জন। যারা মারা যাচ্ছেন, তারা করোনা পজিটিভ। আর উপসর্গ নিয়ে যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের কোনো তালিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দেওয়া করোনা বিজ্ঞপ্তিতে নেই।

দেশে সংক্রমণের এই পরিস্থিতিতেও ‘বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে’ বা ‘ভ্যাকসিন ছাড়াই করোনা দেশ থেকে চলে যাবে’— এমন মন্তব্য করা হচ্ছে মন্ত্রী পর্যায় বা সরকারের পক্ষ থেকে। আমাদের দেশে বর্তমান করোনা পরিস্থিতি তাহলে কেমন? সংক্রমণ কী আসলেই কমছে? নাকি বাড়ছে?— এ বিষয়ে তিন জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার

দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘আমাদের এখানে প্রতিদিন গড়ে যে ৪০ জনের মতো মানুষ মারা যাচ্ছেন, তাদের করোনা শনাক্ত হয়েছে। সারাদেশে করোনার উপসর্গ নিয়ে যারা মারা যাচ্ছেন, তারা তো এই তালিকার মধ্যে নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের খোঁজ নিয়েছি। সেখান থেকে জানতে পেরেছি, আনুমানিক ১০ দিন আগে যে পরিমাণ রোগী ছিল, এখন তার থেকে বেড়েছে বা বাড়ছে। দ্বিতীয়ত, এখনকার রোগীদের মধ্যে শ্বাসযন্ত্র সংক্রান্ত সমস্যা আগের রোগীদের থেকে বেশি। এখন অক্সিজেন সাপোর্টও আগের থেকে বেশি লাগছে। একইসঙ্গে এখন আইসিইউ রোগী অর্থাৎ, ভেন্টিলেশন বা হাই-অক্সিজেন প্রয়োজন, এমন রোগীর সাড়ি বাড়ছে। তার মানে যে ফ্যাসিলিটি আছে, তার চাইতে উপসর্গ অনুযায়ী রোগীদের চাহিদা অনেক বেশি। অর্থাৎ হাসপাতালগুলোতে যে কয়টা বেড আছে, তার চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি।’

‘যারা “করোনার সংক্রমণ কমে গেছে বা নিয়ন্ত্রণে এসেছে” এমনটি বলছেন, তারা কোনো তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এগুলো বলছেন না। তারা আসলে কৃতিত্ব নিতে চাচ্ছেন যে সব ম্যানেজ করে ফেলেছেন। দেশে করোনার সংক্রমণ কোনো অবস্থাতেই কমেনি। অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। তাই বাংলাদেশে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আছে বা এটি বাংলাদেশ থেকে চলে যাবে, তা বলার কোনো সুযোগই নেই।’

বর্তমানে করোনা মোকাবিলায় আমরা সঠিক পথে হাঁটছি কি না এবং আমাদের করণীয় নিয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘আমরা তো প্রথম থেকেই সঠিক পথে হাঁটছি না। আর আমাদের বিভিন্ন রকমের যে মন্তব্য-বক্তব্য, এগুলো তো সঠিক পথে হাঁটার মন্তব্য-বক্তব্য না। এগুলোই তো প্রমাণ করছে যে আমরা সঠিক পথে হাঁটছি না। মার্চের পরবর্তী সময়গুলোতে প্রকোপের ভয়াবহতা সৃষ্টির আগ পর্যন্ত আমরা অব্যবস্থাপনা দেখলাম। ঠিক এ ধরনের মন্তব্য-বক্তব্য আমরা তখনও শুনেছি। সবাই মিলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে আসায় এবং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা আগের চেয়ে অনেকটাই উন্নত হয়েছে। কিন্তু, এখন আবার সেই মার্চের মতো বিভ্রান্তিমূলক মন্তব্যগুলো করোনা পরিস্থিতি আরও জটিল করে দিতে পারে।’

‘বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন আমাদের অবশ্যই আরও অধিক সতর্ক হওয়া উচিত, প্রস্তুতি নেওয়া উচিত এবং জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদ্বুদ্ধ করা উচিত’, যোগ করেন অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘গত ২৫ মের আগে দৈনিক শনাক্তের হার ২০ শতাংশের নিচে ছিল। ২৫ মে থেকে শনাক্তের হার ২০ শতাংশে উঠে গেল। এরপর থেকে শনাক্তের হার ২৪-২৫ শতাংশ পর্যন্ত দেখা গেছে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত। ১৭ আগস্টের পর থেকে সংক্রমণের হার ২০ শতাংশের নিচে চলে এসেছে। সেই হিসেব বিবেচনা করেই হয়তো বলা হচ্ছে সংক্রমণ কমেছে।’

‘বিগত কয়েকদিনের দৈনিক শনাক্তের যে হার, সে অনুযায়ী সংক্রমণ কম দেখা গেছে। কিন্তু, দেশে সংক্রমণ কমে গেছে, সেটা এখন বলা ঠিক না। এটা আরও এক সপ্তাহ দেখতে হবে। হয়তো আরও কমতেও পারে। আরও সপ্তাহখানের দেখার পর এ বিষয়ে বলা যাবে। যদি দুই সপ্তাহ ধরে সংক্রমণের হার নিচের দিকে থাকে, তাহলে হয়তো আমরা বলতে পারব যে না এটা এরকমই থাকবে’, যোগ করেন অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘যদি সরকারি হিসাব দেখি, যে পরিমাণ পরীক্ষা হচ্ছে, সেই তুলনায় শনাক্তের হারটা এখন একটু কম। আগে যেখানে ২০ শতাংশের বেশি হতো, এখন সেটা ২০ শতাংশের কম। এখন এটা বিবেচনায় কম বলা হচ্ছে। কিন্তু, সার্বজনীনভাবে পরীক্ষা তো আমাদের হয়নি। তাহলে কম-বেশি কীভাবে বলা যাবে? আমরা অন্যান্য গবেষকদের থেকে যা জানি, বাংলাদেশি কমিউনিটিতে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু, কমিউনিটিতে তো আর পরীক্ষা করা হচ্ছে না। যদি কমিউনিটিতে অ্যান্টিজেন বা অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা হতো, তাহলে অবস্থা বোঝা যেত। তাই করোনার সংক্রমণ কমে গেছে, এই কথার বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। কারণ, সার্বিকভাবে বড় ধরনের কোনো সার্ভে না করে “কমেছে” বলার কোনো সুযোগ তো নেই। আর করোনার সংক্রমণ কমার তো কোনো উপযুক্ত কারণও দেখছি না। স্বাস্থ্যবিধি তো মানা হচ্ছে না।’

‘এখন আগে যেখানে হয়তো দৈনিক তিন থেকে চার হাজার শনাক্ত হতো, এখন সেখানে তিন হাজারের কম শনাক্ত হচ্ছে। সেটা যদি দেখেন, তাহলে সরকার সঠিক। অর্থাৎ, সংক্রমণ কমছে। কিন্তু, আমরা যদি বাস্তবতার নিরিখে বৈজ্ঞানিক উপায়ে দেখতে চাই, তাহলে তো আমাদেরকে গণমানুষের ওপর সার্ভে করে দেখতে হবে। তাহলে এ বিষয়ে বলা যাবে। আমাদের এখন যে পরিস্থিতি, যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানা হয়, তাহলে করোনার সংক্রমণ আরও প্রকট হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো পথ আমি দেখছি না’, যোগ করেন তিনি।

অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব আরও বলেন, ‘প্রথমে আমাদেরকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে সার্ভে করতে হবে যে, আমাদের সংক্রমণের অবস্থা। পরীক্ষা করে এখন কম শনাক্ত হচ্ছে, তা ঠিক আছে। কিন্তু, পুরো কমিউনিটিতে আমাদের সংক্রমণ কী পরিমাণে আছে, কী পরিমাণ ইমিউনিটি আছে, তা জানতে হবে। এই দুটো দেখে আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বলা যাবে। এমনিতে তো এটা বলা যাবে না। তবে, যেহেতু সরকার সব চালুর দিকে যাচ্ছে, আর আমাদের বর্তমান যেই পরিস্থিতি, এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি না মানলে আমাদের জন্য বিপদ আছে।’

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

38m ago