করোনায় কাদের মৃত্যু ঝুঁকি বেশি: গবেষণা নিয়ে গবেষণা

Deadbody_Corona
প্রতীকী ছবি। স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের তান্ডবলীলা যেন থামছেই না! ২০২০ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং প্রায় আট লাখেরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন। বাংলাদেশেও করোনার প্রভাব বেশ ধ্বংসাত্মক। সরকারি হিসাব মতে, ইতিমধ্যে প্রায় তিন লাখের মতো মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং সৃষ্ট শারীরিক জটিলতায় প্রায় চার হাজারের বেশি মৃত্যুবরণ করছেন। নতুন এই করোনাভাইরাসের অনেক কিছুই প্রাথমিকভাবে অজানা থাকলেও, ধীরে ধীরে গবেষকরা নানা রহস্য উন্মোচন করছেন। প্রতিনিয়ত মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন একথা যেমন সত্য, তেমনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ সুস্থ হয়েও উঠছেন। তাই সাধারণের মাঝে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও তো সবাই মৃত্যুবরণ করছে না?

স্বাস্থ্যকর্মীরা শুরু থেকেই করোনায় আক্রান্তদের মাঝে যাদের পূর্ববিদ্যমান অন্যান্য অসংক্রমক রোগ রয়েছে, তাদের নিয়ে শংকা প্রকাশ করেছেন। জনসাধারনের মনেও ঘুরে ফিরে কিছু প্রশ্ন বারবার উঁকি দেয়- করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে মৃত্যু ঝুঁকি আসলে কাদের বেশি? কাদেরই বা করোনাভাইরাসের সংক্রমন থেকে রক্ষা পেতে বেশি সতর্ক থাকা উচিত?

দেশ-বিদেশের অসংখ্য গবেষক এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। আমরা একদল গবেষক- সারাবিশ্বে পরিচালিত অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীদের করোনায় মৃত্যুর ঝুঁকি শীর্ষক উল্লেখযোগ্য ৪১টি গবেষণাপত্র পুনরায় বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের (মেটা-এনালাইস) মাধ্যমে এই প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি। অতি সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব গ্লোবাল হেলথ কর্তৃক প্রকাশিত বিখ্যাত ‘জার্নাল অব গ্লোবাল হেলথ’-এ আমাদের বিশ্লেষণাত্তক গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে।

আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যাদের পূর্বে থেকে কোনো দীর্ঘমেয়াদি বা অসংক্রামক রোগ ছিল, তাদের মধ্যেই বেশি সংখ্যক রোগী মৃত্যুবরণ করেছেন। সারাবিশ্বে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মৃত্যু ঝুঁকি শুধুমাত্র করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চেয়ে প্রায় সাড়ে তিনগুণ বেশি। গবেষণাটিতে আমরা পেয়েছি, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে পূর্বে বিদ্যমান কিছু রোগ বা কো-মরবিডিটি যেমন, উচ্চ রক্তচাপ (৩৬ দশমিক পাঁচ শতাংশ), হৃদরোগ (১১ দশমিক নয় শতাংশ) এবং ডায়াবেটিস (২২ শতাংশ)-এর প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে বেশি। শুধু বহির্বিশ্ব নয়, এই ফলাফল বাংলাদেশি উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগে আক্রান্ত বা এসব রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা রোগীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা বহন করে। আইসিডিডিআর,বি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে ২০১৫ সালে প্রায় ২০ শতাংশ পুরুষ ও ৩২ শতাংশ নারী উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ছিলেন। ২০১৮ সালের তথ্য মতে, ৪০-৫৯ বয়সী ১৫ দশমিক পাঁচ শতাংশ বাংলাদেশির হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। সুতরাং উচ্চরক্তচাপ ও হৃদরোগীদের করোনা সংক্রান্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে খুব বেশি সতর্ক হওয়া উচিত এবং এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই!

আমাদের এই গবেষণা আরও নিশ্চিত করে, সারাবিশ্বে ডায়াবেটিস, ক্যান্সার বা টিউমার ও শ্বসনতন্ত্র সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত রোগীরা করোনায় আক্রান্ত হলে শুধুমাত্র করোনা আক্রান্ত রোগীদের চেয়ে পূর্ববর্তী এসব রোগ ও করোনায় আক্রান্তদের মৃত্যু ঝুঁকি প্রায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিস এবং দেড় লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এছাড়াও, যে সমস্ত রোগীরা আগে থেকে স্ট্রোক বা অনান্য সেরিব্রোভাসকুলার রোগ অথবা কিডনি রোগে ভুগছেন, তাদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর মৃত্যু ঝুঁকি শুধুমাত্র করোনা রোগীর চেয়ে প্রায় তিন থেকে চার গুণ বেড়ে যায়। বাংলাদেশে প্রায় ১৭-১৮ শতাংশ মানুষ কিডনির রোগে আক্রান্ত। লিভার সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যু ঝুঁকিও শুধুমাত্র করোনায় আক্রান্ত রোগীর তুলনায় প্রায় ২৫০ শতাংশ বেশি। দুঃখজনক তথ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি মানুষ হেপাটাইটিস বি ও সি রোগে আক্রান্ত এবং প্রায় চার কোটি মানুষ ফ্যাটি লিভার রোগে আক্রান্ত। যা আমাদের অধিক সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেয়।

আমাদের পরামর্শ

যেহেতু বাংলাদেশে উচ্চ-রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার বা টিউমার, শ্বাসতন্ত্র, কিডনি ও লিভার জনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক এবং এসকল রোগীদের করোনায় উচ্চ-মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে, সেহেতু তাদের এ ব্যাপারে আগেই সতর্ক হতে হবে। কারণ, করোনা আক্রান্ত হলে এসব রোগীদের শারীরিক জটিলতা ও মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিশ্বব্যাপী করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে উন্নত দেশগুলোও হিমসিম খাচ্ছে। উপরন্তু, বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল। তাই করোনা সংক্রমণের পূর্বেই যদি সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়, অথবা হাসপাতালে ভর্তির সময় শুরুতেই তাদের যদি চিহ্নিত করা সম্ভব হয়; তাহলে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও যথাযথ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে পূর্ববর্তী রোগে আক্রান্ত করোনা রোগীদের মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। সর্বোপরি, এই গবেষণার ফলাফল স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক এবং অন্যান্যদের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ করোনা রোগীদের চিহ্নিতকরণ ও যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ভীষনভাবে সাহায্য করবে বলে আমরা নিশ্চিত। 

গবেষক দল: মোস্তাওরিদ খান, নুরুজ্জামান খান, গোলাম মোস্তাগির, জুয়েল রানা, সাইফুল ইসলাম ও ইকবাল কবির।

গবেষণাপত্রটি পড়তে: http://www.jogh.org/documents/issue202002/jogh-10-020503.htm

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Kudos for consensus in some vital areas

Kudos for consensus in some vital areas

If our political culture is to change, the functioning of our political parties must change dramatically.

4h ago