করোনায় বিপাকে ঠাকুরগাঁওয়ের মৃৎশিল্পীরা

ঠাকুরগাঁও শহর থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে আকচা ইউনিয়নের পালপাড়া ও দক্ষিণ ঠাকুরগাঁও পালপাড়া গ্রাম। সেখানে প্রায় ৭০০ পরিবারের বসবাস। একসময় তাদের জীবন কাটতো মৃৎশিল্পকে ঘিরে। পরিবারের সবাই মিলে গৃহস্থালী নানা সামগ্রী তৈরি করে সেগুলো হাট-বাজার ও গ্রামে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা।
Thakurgaon potters
ছবি: স্টার

ঠাকুরগাঁও শহর থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে আকচা ইউনিয়নের পালপাড়া ও দক্ষিণ ঠাকুরগাঁও পালপাড়া গ্রাম। সেখানে প্রায় ৭০০ পরিবারের বসবাস। একসময় তাদের জীবন কাটতো মৃৎশিল্পকে ঘিরে। পরিবারের সবাই মিলে গৃহস্থালী নানা সামগ্রী তৈরি করে সেগুলো হাট-বাজার ও গ্রামে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা।

যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কলকারখানার বিকাশে মাটির তৈরি তৈজসপত্রের জায়গা অনেকাংশে দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম, মেলামাইনসহ অন্যান্য ধাতব পণ্য।

মৃৎ-সামগ্রীর চাহিদা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকায় জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে তাদের অনেকেই পৈতৃক পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

এরপরেও যারা বংশগত ঐতিহ্য রক্ষায় মনের টানে এই পেশাতেই নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছেন, এ বছরে বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে তারা নিতান্তই বিপাকে পড়েছেন।

সম্প্রতি, আকচা ইউনিয়নের পালপাড়া ও দক্ষিণ ঠাকুরগাঁও গ্রামের এই পরিবারগুলোর অনেকের সঙ্গে কথা হয়, উঠে আসে এই শিল্পের অতীত ও আজকের অবস্থা।

গত শনিবার বিকেলে দেখা যায়, পালপাড়া গ্রামের অনিল পালের ছেলে রাখাল পাল (৪৫) এঁটেল মাটির সঙ্গে প্রয়োজন মতো পানি দিয়ে দুই পায়ে সেই মাটি মাড়িয়ে বাসন তৈরির উপযোগী করে তুলছেন। আপন মনে গেয়ে চলেছেন, ‘ওকি ভাইরে ভাই, বাপ-দাদার যে ব্যবসা আছিল এই কলিকালত তাক গুটে ফেলাই’।

চোখে চোখ পড়তেই গান থামিয়ে জানতে চান, ‘কী মনে করে হামার বাড়িত এই অবেলাত তমহরা (তোমরা)?’

‘আপনাদের কাজকর্ম দেখতে এসেছি।’ এমনটি জানালে এক রকম হতাশার সুরে বলে উঠেন ‘হামার আর কাম..., এলা কী আর সেই দিন আছে, অন্য কিছু তো শিখি নাই, এইতানে না পশালেও এইলায় করিবা নাগেছে।’

এরপর কথায় কথায় অতীত ও বর্তমান অবস্থার চিত্র তুলে ধরেন রাখাল পাল।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এই কাজ করে জীবন অতিবাহিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। সম্প্রদায়ের অনেকেই বাধ্য হয়ে এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। বিশেষ করে তরুণরা এই শিল্পকর্মে আগ্রহ বোধ করছে না। আর্থিকভাবে তেমন লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই, তাই।’

গত ১০ থেকে ১৫ বছর আগেও মৃৎ সামগ্রীর চাহিদা ভালো ছিল বলে বর্ষার সময়টা ছাড়া সারা বছরই ব্যস্ত সময় কাটাতে হতো।

Thakurgaon potters
ছবি: স্টার

উমেশ পালের ছেলে পূর্ণ পাল (৫৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এই পড়ন্ত অবস্থার মধ্যেও এক রকম কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু, করোনা পরিস্থিতির কারণে চরম প্রতিকূল সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আয় রোজগারের পথ একরকম বন্ধই হয়ে গেছে।’

তিনি জানান, বছরের চৈত্রসংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখকে ঘিরেই মূলত মৃৎ সামগ্রীর উল্লেখযোগ্য বেচাকেনা হয়। বছরের বেশির ভাগ আয় আসে সে সময়েই। কিন্তু, এ বছর করোনা রোধে গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী সব অনুষ্ঠান— বিশেষ করে চৈত্রসংক্রান্তি, বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় বিক্রি তো হয়নি, উল্টো এ সব উৎসবকে ঘিরে ঋণ নিয়ে যে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করায় ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।’

করোনার প্রাদুর্ভাবে কর্মহীন হয়ে পড়লেও সরকারি প্রণোদনা কিংবা অন্যান্য সহায়তা মেলেনি বলেও জানান তিনি।

পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ ঠাকুরগাঁও পালপাড়া গ্রামে মাটির বাসন বানাতে ব্যস্ত রঞ্জিত পালের স্ত্রী লিমা রানী পালের (৩৮) সঙ্গে কথা হয়। তিনি  ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যদিও করোনা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের বিষয়টি অনিশ্চিত, তবুও অর্থ খরচ করে সংগৃহীত মাটি দিয়ে ফুলের টবসহ অন্যান্য সৌখিন দ্রব্যাদি বানিয়ে রাখছি।’

সামনের শীতে মেলা হলে মৃৎ সামগ্রী বিক্রি করে কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হবে বলেও জানান তিনি।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুব্রত কুমার বর্মন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এই ইউনিয়নে পাল সম্প্রদায়ভুক্ত প্রায় ৭০০ পরিবার বাস করেন। এক সময় ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে ঘিরে ছিল বছরব্যাপী অবিরাম কর্মযজ্ঞ। কালের বিবর্তনে দিনে দিনে এর ব্যাপ্তি কমতে শুরু করেছে। এখন কমবেশি ২০০ পরিবার এ পেশায় সম্পৃক্ত রয়েছে।’

তিনি মনে করেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

করোনাকালে কর্মহীন হয়ে পড়া এসব পরিবারের জন্য কী সহায়তা দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মৃৎশিল্প নির্ভর ১৭টি পরিবারের সবাইকে সরকারি প্রণোদনার আড়াই হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।’

‘এছাড়াও দেড়শত পরিবারের সবাইকে উপজেলা ত্রাণ তহবিল থেকে এককালীন খাদ্য সহায়তা হিসেবে পাঁচ কেজি চাল, এক কেজি মুসুরের ডাল ও দুই কেজি করে আলু দেওয়া হয়েছে,’ যোগ করেন তিনি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্লাহ আল মামুন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মৃৎশিল্পসহ গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সব হস্তশিল্পকে উৎসাহ দিতে সরকার তৎপর। সরকারিভাবে আয়োজিত সব মেলায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ সদাতৎপর। কিন্তু, করোনার কারণে এই উদ্যোগ ব্যাহত হয়েছে।’

Comments

The Daily Star  | English

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago