চাপ বাড়ছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে

করোনা মহামারিতে কাজ হারিয়ে গ্রামের পথে হাজারো মানুষ। এই শহরের খরচ তারা আর বহন করতে পারছেন না। সেই মানুষদের ভিড়েই কয়েকটি মুখ নার্গিস আক্তার, মো. লোকমান ও তাদের তিন সন্তান।

করোনা মহামারিতে কাজ হারিয়ে গ্রামের পথে হাজারো মানুষ। এই শহরের খরচ তারা আর বহন করতে পারছেন না। সেই মানুষদের ভিড়েই কয়েকটি মুখ নার্গিস আক্তার, মো. লোকমান ও তাদের তিন সন্তান।

ঢাকায় প্রথম এসে দিনমজুরের কাজ করতেন লোকমান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের পেশা বদলে নিয়েছিলেন। দিনমজুর থেকে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন পিকআপ ভ্যান চালক হিসেবে। মাসে তার আয় হতো ১৮ হাজার টাকা। এর থেকে চার হাজার টাকা খরচ হয়ে যেত এক রুমের ঘরের ভাড়া ও ইউটিলিটি বিল দিয়ে। বাকি টাকায় চলত তাদের সংসারের অন্যান্য খরচ।

মার্চের শেষে দেশে লকডাউন শুরু হলে লোকমানের আয় বন্ধ হয়ে যায়। তার ঘর ভাড়া বাকি পড়ে চার মাস। পাঁচ জনের এই পরিবারটা পুরোপুরিভাবে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ে।

নার্গিস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা তো মনে করেছিলাম লকডাউন শেষ হয়ে যাবে। আবার সব আগের মতো হয়ে যাবে।’

জুনে লকডাউন শেষ হয়ে গেলেও আর আগের মতো আয় করতে পারছিলেন না লোকমান। এত মাসের বাকি পড়ে থাকা বাসা ভাড়া আর সংসারের খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছিল না তাদের। এরই মধ্যে তাদের বাড়িওয়ালা বাসা ছাড়ার নোটিশ দেয়।

নার্গিস বলেন, ‘কী করব তা ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবে দেখলাম, যা আয় হচ্ছে তা দিয়ে দুবেলা হয়তো খেতে পারব, কিন্তু বাসা ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ চালাতে পারব না।’

গত মাসে এই পরিবারটি নেত্রকোনার কলমাকান্দায় তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যান। গ্রামের পরিচিত একজনের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সেই টাকায় লোকমান দুই কাঠা জমি লিজ নেন। তার আশা, এই জমিতে চাষ করে অন্তত ছয় মাস তার পরিবারের খাবারের ব্যবস্থা করত পারবেন।

ভাড়াটিয়া পরিষদ অনানুষ্ঠানিকভাবে ডেইলি স্টারকে জানায়, নিয়মিত আয় না থাকায় অন্তত ৫০ হাজার পরিবার রাজধানী ছেড়ে চলে গেছে।

সদস্যরা ভালো চাকরি করে, এমন পরিবারের অবস্থাও খুব বেশি আলাদা না।

বায়িং হাউজ থেকে মার্চেন্ডাইজারের চাকরি চলে যাওয়ার পর থেকে পূণ্য গোপাল পাল ও সুদীপ্তা রানী চৌধুরী পড়েছেন অকূল পাথারে। গত ২১ এপ্রিল চাকরি হারানোর পর এই নবদম্পতি কী করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন।

সঞ্চয়ের সব টাকা বাড়ি ভাড়া আর অন্যান্য খরচে শেষ হওয়ার পরও যখন কোনো আশার আলো জ্বলেনি, তখন এই ‘জাদুর শহর’ ছেড়ে তারা পাড়ি জমান পাবনায় নিজেদের গ্রামের বাড়িতে।

সুদীপ্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘চাকরি নেই। তিন জনের পরিবারের খরচই চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। তার ওপর প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা বাসা ভাড়া।’

তিনি জানান, বর্তমানে তারা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে যৌথ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

সুদীপ্তা বলেন, ‘পূণ্য ব্যবসা বা কৃষিকাজ শেখেনি। পাবনাতেই চাকরি খুঁজছে সে। আমিও সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। যদিও বলতে গেলে এখন চাকরির তেমন কোনো বিজ্ঞপ্তিই নেই।’

গ্রাম অঞ্চলে বেকারদের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলছে বিদেশফেরত বিশাল সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুয়িশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, প্রতিবছর প্রায় ছয় লাখেরও বেশি মানুষ বিদেশে চাকরির জন্য গেলেও, এই বছর তারা যেতে পারেনি।

বেশিরভাগ অভিবাসী শ্রমিক গ্রাম অঞ্চলের এবং বিশেষত নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের পরিবার থেকে আসে।

এদের মধ্যে কেউ কেউ ছুটিতে বেড়াতে এসে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় আটকে গেছেন। কিংবা দেশে ফিরে এসেছেন করোনা সংকটে চাকরি হারিয়ে।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল থেকে আগস্টের মধ্যে অন্তত ৯৫ হাজার ৬২ বাংলাদেশি শ্রমিক ২৬টি দেশ থেকে দেশে ফিরেছেন।

ইরাকের এক অভিবাসী শ্রমিক একরামুল হোসেন চাকরি হারিয়ে বাংলাদেশে ফিরে নিজের ব্যবসা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। ইরাকে তিনি মাসে প্রায় এক হাজার ২০০ ডলার আয় করতেন।

একরামুল তার এক আত্মীয়ের কাছ থেকে চার লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক থেকে আরও দুই লাখ টাকা (নয় শতাংশ হারে সুদে) ঋণের জন্য আবেদন করেছে। এই টাকায় তিনি একটি ডেইরি ফার্ম করবেন।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছিলেন, প্রবাসফেরত শ্রমিকদের জন্য ৭০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে মন্ত্রণালয়। এই ঋণের সুদের হার হবে চার শতাংশ।

প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে এই সুবিধা পেতে পারতেন একরামুলও। কিন্তু, এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু জানেন না।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সব খরচ বাদ দিয়ে এখন আমি মাসে আয় করি তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। পরে হয়তো সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারব, কিন্তু এখন আমার অবস্থা মোটেই ভালো না।’

সমাধান কী?

পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান ডেইলি স্টারকে জানান, নীতিনির্ধারকদের উচিত গ্রামীণ অকৃষিজ খাতের চাহিদা নীতিমালা ও উদ্দীপনা প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত করা।

গ্রামের মানুষের ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া কঠিন উল্লেখ্য করে তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার জন্য ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার উদ্দীপনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির জন্য।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার একটি উদ্দীপনা প্যাকেজ ঘোষণা করতে পারে, যা ব্যাংকের মাধ্যমে নয় বরং ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলো বিতরণ করবে। তবে এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিত তা জানতে প্রথম পর্যায়ে সরকারের উচিত নীতিমালা সংক্রান্ত বৃহত্তর পরামর্শ প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা করা।’

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পল্লী অর্থনীতির জন্য প্রণোদনা প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত কৃষিখাতের পাঁচ হাজার কোটি টাকা এবং কুটির, ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের ২০ হাজার কোটি টাকা দ্রুত বিতরণ করতে হবে।’

গ্রামাঞ্চলে আরও অকৃষিজ কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের কাজের সুযোগ বাড়াতে হবে। গ্রামীণ রাস্তা সংস্কার ও অন্যান্য সরকারি কাজে তাদের সংযুক্ত করতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়েমা হক বিদিশা ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সরকারের নীতিনির্ধারণের সময় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মতো গ্রামীণ ক্ষুদ্র কর্মসংস্থানভিত্তিক কর্মসূচি অন্তর্ভূক্ত থাকতে হবে।’

তিনি বিকেন্দ্রীকরণের জন্য গ্রামীণ অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিনিয়োগের ওপরও জোর দেন। যাতে মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য মানুষকে শহরমুখি হতে না হয়।

Comments

The Daily Star  | English

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago