শিল্প-কারখানার পরিচালনায় শ্রমিকদের শরীক কর

বাংলাদেশ ফেডারেশন-অব-চেম্বার্স অব কমার্স এণ্ড ইণ্ডাষ্ট্রিজের সভাপতি গত শুক্রবার একটি মূল্যবান বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিটি আসলে বঙ্গবন্ধুর সরকারের নিকট একটি আবেদন। এই আবেদনে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কথা সাধারণভাবে এবং শিল্প-বাণিজ্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হইয়াছে। কথাগুলি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এটা ধরিয়া লওয়া যায়, সভাপতি সাহেব ফেডারেশনের পক্ষ হইতেই কথা বলিয়াছেন; ব্যক্তিগতভাবে বলেন নাই। তা যদি সত্য হয় তবে ব্যক্তিগতভাবে বিবৃতির আকারে এসব কথা না বলিয়া ফেডারেশনের প্রস্তাব আকারে অথবা সরকারের কাছে একটি স্মারকলিপি হিসাবে পেশ করিয়া তারই কপি সংবাদপত্রে ছাপানো উচিত ছিল।
Abul Mansur Ahmed
আবুল মনসুর আহমদ (৩ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮ – ১৮ মার্চ ১৯৭৯)।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের শিল্প-কারখানা প্রসঙ্গে অত্যন্ত আন্তরিকতা নিয়ে লিখেছেন আবুল মনসুর আহমদ। এটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক ইত্তেফাকে ১৯৭৩ সালের ১৬ নভেম্বর। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয় সম্পর্কে প্রায় ৪৫ বছর আগে তিনি ভেবেছিলেন যৌক্তিকভাবে। সঙ্কট-সম্ভাবনায় এগিয়ে যাওয়ার নানা দিক নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধে সে বিষয়গুলো তিনি অসামান্যভাবে তুলে ধরেছেন। ঐতিহাসিক এই প্রবন্ধ আজও প্রাসঙ্গিক রাষ্ট্রের প্রয়োজনে। আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও রাজনীতি–ত্রিধারার অভিজ্ঞতায় বাংলার একজন অভিভাবক হিসেবে ছিলেন। ষাটের দশকে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতাকে বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধে প্রকাশ করেছেন। তার আত্মজীবনীমূলক রচনাদি দৈশিক-আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-অধ্যয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টেক্সট হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। (প্রবন্ধে তার নিজস্ব বানানরীতি রাখা হয়েছে। ৩ সেপ্টেম্বর আবুল মনসুর আহমদের জন্মদিন— ইমরান মাহফুজ

বাংলাদেশ ফেডারেশন-অব-চেম্বার্স অব কমার্স এণ্ড ইণ্ডাষ্ট্রিজের সভাপতি গত শুক্রবার একটি মূল্যবান বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিটি আসলে বঙ্গবন্ধুর সরকারের নিকট একটি আবেদন। এই আবেদনে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কথা সাধারণভাবে এবং শিল্প-বাণিজ্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হইয়াছে। কথাগুলি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এটা ধরিয়া লওয়া যায়, সভাপতি সাহেব ফেডারেশনের পক্ষ হইতেই কথা বলিয়াছেন; ব্যক্তিগতভাবে বলেন নাই। তা যদি সত্য হয় তবে ব্যক্তিগতভাবে বিবৃতির আকারে এসব কথা না বলিয়া ফেডারেশনের প্রস্তাব আকারে অথবা সরকারের কাছে একটি স্মারকলিপি হিসাবে পেশ করিয়া তারই কপি সংবাদপত্রে ছাপানো উচিত ছিল।

সভাপতি সাহেবের ব্যক্তিগত মর্যাদা হেয় না করিয়াও একথা বলা চলে যে, ফেডারেশনের প্রস্তাবাকারে অথবা স্মারকলিপি হিসাবে এসব অভিমত প্রকাশ করিলে অনেক দিক হইতেই বেশি কাজে লাগিত। প্রথমতঃ তাতে বিভিন্ন দিককার সমস্যামূহের বিবরণের সাথে তাদের সমাধানের সুপারিশও থাকিত। দ্বিতীয়তঃ ঐ কারণে প্রস্তাব বা স্মারকলিপির বিষয়বস্তু সাধারণভাবে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে বিবেচিত হইত এবং সেই দফতরের নির্দেশ মতো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সব বিষয় আলোচিত ও মীমাংসিত হইবার সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল হইত। আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় এটা করিবার সময় উত্তীর্ণ হইয়া যায় নাই। সভাপতি সাহেব ফেডারেশনকে দিয়া এই কাজ এখনও করাইতে পারেন। সভাপতি সাহেবের বিবৃতিতে সরকারী নীতি সংশোধন-পরিবর্তনের সুপারিশের ইংগিত আছে।

কাজেই এটা ধরিয়া লওয়া যায়, ফেডারেশন সরকারী শিল্প ও বাণিজ্য নীতি সম্পর্কে মৌল, ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ কথা বলিতে চান। এ ধরনের কথা সুপারিশ সরকারের বলাই ভাল। ফেডারেশনের মতো দায়িত্বশীল ও কর্তব্যবোধসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের কথা তেমনভাবে প্রকাশ করা উচিৎও। অপজিশন লিডারদের অনেকের মত সরকারের শুধু সমালোচনা করিয়াই দায়িত্ব শেষ করা ফেডারেশনের মতো প্রতিষ্ঠানের উচিৎ হইবে না। দেশের কল্যাণের খাতিরে ত বটেই, সাধারণ ন্যায়-নীতির খাতিরেও কারো ত্রুটি দেখাইতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে সে ত্রুটির প্রতিকারটাও দেখান উচিৎ। আশা করি ফেডারেশনের সভাপতি বিশেষভাবে এবং মেম্বার সাহেবান সাধারণভাবে, এ কাজে উদ্যোগী হইবেন। সে উদ্যোগে বিলম্ব করিবেন না। কারণ সভাপতি সাহেব তাঁর বিবৃতিতে ঠিকই বলিয়াছেন: ‘এ সব ব্যাপারে এই মুহূর্তে পদক্ষেপ না নিলে অপূরণীয় ক্ষতি হইবে।’

ফেডারেশনের সভাপতি সাহেব অর্থনীতি, শিল্প-বাণিজ্য, বিদেশী মুদ্রা ও আইন-শৃংখলা ইত্যাদি প্রায় সব জরুরী ব্যাপারেই কথা বলিয়াছেন।

আমি স্বভাবতঃই আজকার আলোচনার জন্য একটি বিষয় বাছিয়া লইতেছি। সে বিষয়টি হইতেছে আমাদের শিল্প-কারখানা। সভাপতি সাহেব বলিয়াছেন যে শিল্প-কারখানা, বিশেষতঃ পাটকল বন্ধ হইতেছে তারা পৌনঃপুনিক লোকসান খাইতেছে; শিল্প উৎপাদন মারাত্মকরূপে হ্রাস পাইতেছে। সভাপতি সাহেবের এসব কথাই সত্য। এই অবস্থার কারণ সম্পর্কে তিনি বলিয়াছেন: ‘স্বাধীনতার পর শিল্পে অভিজ্ঞ অস্থানীয় পুঁজিলগ্নিকারী লোকেরা বাংলাদেশ ছাড়িয়া চলিয়া যান। তাতে শিল্পক্ষেত্রে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। কতিপয় বৃহৎ-শিল্পের বাঙ্গালি লগ্নিকারীরাও দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে বাধ্য হন। অনভিজ্ঞ ব্যক্তিরা তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হন। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানাগুলিতেও ব্যবস্থাপনায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। এতেই উৎপাদন প্রতিনিয়ত ব্যাহত হইতেছে।’ পরিচালক সম্বন্ধে সভাপতি সাহেব এই যে সব কথা বলিয়াছেন, তার সাথেও দেশবাসী মোটামুটি একমত হইবে। আমি নিজেও মোটামুটি এরূপ ধারণাই পোষণ করি। শিল্পের আসল পরিচালক যে শ্রমিকরা তাদের সম্পর্কে সভাপতি সাহেব বলিয়াছেন: ধর্মঘট, ঘেরাও, অবিবেচনা প্রসূত ও অসংগত মজুরি দাবি। কোন মুনাফা অর্জনের আগেই বোনাস দাবি, উৎপাদনে অংশ গ্রহণ না করিয়াই মজুরি দাবি ইত্যাদি আজ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে দাঁড়াইয়াছে। এসব কথাতেও আমাদের দ্বিমত নাই।

কিন্তু প্রশ্ন এই যে, এমন হইবার কারণ কি? সে সব কারণ দূর করিবার উপায় কি? উপায় নিশ্চয়ই আছে এবং একাধিকই আছে। সে সব উপায় সম্পর্কে আলোচনা সিদ্ধান্ত করিবার জন্য বিভাগীয় মন্ত্রী আছেন। তাঁকে সাহায্য করিবার জন্য পার্লামেন্টারি হাউস কমিটি আছেন। প্ল্যানিং কমিশনের বিশেষজ্ঞরা আছেন। তাঁরা সকলে মিলিয়া যে সিদ্ধান্ত করিবেন, তা প্রয়োগ করিবার জন্য মন্ত্রণালয় আছেন: নাই কি? সবই আছে। সবাই আছেন। তাঁরা সবাই যার তাঁর কাজও নিশ্চয়ই করিতেছেন। নিশ্চয়ই করিতেছেন এই জন্য যে, কিছু না করিয়া তাঁরা মাহিয়ানা খাইতেছেন। এটা সম্ভব নয়। তবে তাঁরা যে কি করিতেছেন দেশবাসী তা জানিতে পারিতেছে না। জানিতে পারিতেছে না এই জন্য যে, সমস্যাগুলির কোনও সমাধান হইতেছে না। সমাধানের যে চেষ্টা হইতেছে, সে সম্পর্কে যে সংশ্লিষ্ট সকলে আলোচনা ও ডিবেট করিতেছেন, তারও কোনও প্রমাণ দেশবাসী পাইতেছে না। দেশবাসীর সামনে এ সব আলাপ আলোচনা উপস্থিত হয় ওপেন ডিবেটে, খোলাখুলি আলোচনায়। তেমন আলোচনা ডিবেট হয় পার্লামেন্টে, পার্লামেন্টারি হাউস কমিটিতে। তেমন আলোচনা বিতর্কের রিপোর্ট প্রকাশ হয় খবরের কাগজে, প্রচার হয় রেডিও-টেলিভিশনে। বিভাগীয় যে আলোচনা বিতর্ক প্রকাশ্যে হইতে পারে না, তাও দেশবাসীকে শোনান হয় সরকারের প্রচার দফতরের হ্যাণ্ডআউট, প্রেসনোট ও প্যামফ্লেট পুস্তিকার মাধ্যমে। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের সরকারী প্রচারদফতর এ বিষয়ে অতিশয় দুর্বল ও নিতান্ত নিষ্কর্মা।

সরকারের বহু ভুল-ভ্রান্তির মধ্যে দু’চারটা ঠিক কাজও নিশ্চয়ই তারা করিয়াছেন। সমস্যাসমূহের সমাধান আজও হয় নাই বটে, কিন্তু সে সম্পর্কে বিভিন্ন ধরণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চেষ্টার বিরাম নাই। প্রচারদফতর হইতে এ সবের সঠিক বিবরণ প্রচারিত হওয়া দরকার। তার মানে সরকারের সাফল্যে-অসাফল্যে, ভাল-মন্দে, সকল অবস্থায় জনগণকে কনফিডেন্সে নেওয়া, সরকারী চিন্তা-ভাবনায় জনগণকে শরিক করা, গণতন্ত্রী সরকারের বড় দায়িত্ব এবং প্রথম কর্তব্য। আমাদের পার্লামেন্টে প্রায় একপার্টি সংসদ বলিয়া এখানে কোনও প্রাণবন্ত বিস্তারিত ও শিক্ষাপ্রদ ডিবেট হয় না।

পার্লামেন্টারি রাজনীতির জন্য এটা দুর্ভাগ্যোর বিষয়। কিন্তু এ জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করা যায় না। যত দোষ ভোটারদের। ভোটারদের দোষ ও পরিণামে রাজনৈতিক নেতাদেরই দোষ যারই হোক, আমাদের দেশের বাস্তব সত্য এই যে, আমাদের পার্লামেন্ট কার্য্যতঃ একদলীয় পার্লামেন্ট।

এমন অবস্থায় রুলিং পার্টিকেই পজিশন-অপজিশন উভয়পক্ষের ভূমিকা পালন করিতে হয়। অভিজ্ঞতার অভাবে বর্তমান রুলিং পার্টির পক্ষে এটা সম্ভব হইতেছে না। ফলে পার্লামেন্টের এই ভূমিকা গ্রহণ করা উচিৎ ছিল রেডিও এবং সংবাদপত্রের। রেডিও ও সংবাদপত্রকে আমি একই পর্যায়ে ফেলিলাম এই জন্য যে, কোনও কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রেডিও ও সংবাদপত্র দুইটাই বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, সেই কারণে আমাদের দেশে এ দুইটাই সরকারী প্রতিষ্ঠান। রেডিও-টেলিভিশন প্রতিষ্ঠানটি আমরা সরকারীযন্ত্র হিসেবে অর্জন করিয়াছি। ফলে এক-আধখানা সংবাদপত্র ছাড়া আর সবাই মন্ত্রীদের সব কাজে ‘মারহাবা, মারহাবা’ করিয়া চলিয়াছেন। ফলে আইউবী ট্রেনিং প্রাপ্ত অতি চালাক সাংবাদিকরা নিতান্ত ‘হাবা সাজিয়া মন্ত্রীদের যে কোথায় ‘মার’ দিতেছেন, স্বয়ং মন্ত্রীরাও তা বুঝিতেছেন না। মূঢ়দেশবাসী ত নয়ই। এই অবস্থায় সুযোগে যাঁর যা খুশি বলিয়া যাইতেছেন। কারণ কারও কথা কেউ রাখিতেছেন না। কান পাতিয়া কেউ কারও কথা শুনিতেছেন না। বুঝিবেন কি? বক্তারা নিজেরাই নিজের কথা বুঝিতেছেন না। কারণ বুঝিবার বা বুঝাইবার উদ্দেশ্যে কেউ কথা বলিতেছেন না।

বরঞ্চ কেউ তাঁর কথা শুনিতেছেন না এটা জানিয়া সকল চক্রই যা-তা বলিতে শুরু করিয়াছেন। সবাই ভাবিতেছেন, কেউ যখন তাঁর কথা শুনিতেছেন না তখন বাক্যকে অর্থপূর্ণ করিয়া লাভ কি?

এই কারণেই বক্তার কোন দায়িত্ব নাই শ্রোতার প্রতি। সংবাদপত্রের কোনও দায়িত্ব নাই পাঠকদের প্রতি। দোকানদারের কোনও দায়িত্ব নাই খরিদ্দারের প্রতি। মেম্বারদের কোনও দায়িত্ব নাই ভোটারদের প্রতি। এই সব না থাকার গোড়ার কথা; শাসকের কোনও দায়িত্ব নাই শাসিতের প্রতি।

এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হইতেছে বিস্ময়কর। বক্তারা অর্থপূর্ণ কথা বলেন না বলিয়া শ্রোতারা নিজেরই অর্থপূর্ণ চিন্তা শুরু করিয়াছেন। সংবাদপত্রেরা সরকারের সমালোচনা করেন না বলিয়া পাঠকরা নিজেরাই সরকারের সমালোচনা শুরু করিয়াছেন। পার্লামেন্টে সরকারবিরোধী দল নাই বলিয়া গোটা দেশটাই বিরোধীদল হইয়া গিয়াছে। সরকারের পক্ষে সুষ্ঠু প্রচারের অভাব ও বিপক্ষে প্রচারের প্রাদুর্ভাবই এই বিপর্যয়ের কারণ। সরকারী প্রচারদফতরের ব্যর্থতার এটাই সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

সরকারী-বেসরকারী সব প্রচার বিভাগেরই আধুনিক নাম পাবলিক রিলেশনস্ ডিপার্টমেন্ট। অতি সুন্দর নাম। অর্থবহ নাম। সরকারী ব্যাপারের বেলায় পাবলিক রিলেশনস্ বিভাগ সরকার পরিচালনায় সক্রিয় গণ-শরিকানা মাস্ পার্টিসিপেশন ইন্ দি এডমিনিস্ট্রেশন স্থাপন করিয়া সত্য-সত্যই পাবলিক রিলেশনস্‌ দফতরে এদিককার দায়িত্ব আরও বেশি ছিল। তার বদলে প্রচার দফতর যা করিয়াছেন তাতে কুল্লে দুইটি কাজ হইয়াছে; একটি নেগেটিভ অপরটি পজেটিভ। নেগেটিভ এই দফতর অতীতের কিছু ভুল ‘প্রতিবাদ’ বাহির করিয়াছেন। আর পজিটিভলি মন্ত্রী-মেম্বাররা হাতী-ঘোড়া মারিয়াও, আসমানের চান ধরিয়া আনিয়া ‘সোনার বাংলা’ গড়ার ভবিষ্যতের যে সব ওয়াদা করেন, ঢাক-ঢোল পিটাইয়া সে সব প্রচার করিয়াছেন। বর্তমানের কোনও কথাই তাঁরা বলেন নাই। প্রচার দফতরের এই ব্যর্থতার দরুণই বোধ হয়, প্রধানমন্ত্রী তিন তিন বার প্রচার-দফতরের দায়িত্ব হস্তান্তর করিয়া অবশেষে নিজের হাতে লইতে বাধ্য হইয়াছেন। দেখা যাক, এবার কি হয়।

কথায় কথায় অনেক দূরে চলিয়ে গিয়াছিলাম। এবার শিল্পকারখানায় ফিরিয়া আসি। ফেডারেশনের সভাপতি সাহেব আমাদের শিল্প কারখানার অব্যবস্থা বিশৃংখলা ও তজ্জনিত উৎপাদন হ্রাসের অনেক কারণের উল্লেখ করিয়াছেন। আমি আজ তার মধ্যে মাত্র একটির আলোচনা করিব। সেটা, শ্রমিক সমস্যা। আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় আমাদের শিল্প সেক্টরের সমস্ত লোকসানের বড় কারণ শ্রমিক অসন্তোষ। এমনকি ব্যবস্থাপক পরিচালকদের অযোগ্যতা ও দুর্নীতির দরুণ মিল কারখানার কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি চুরি জারির যে সব অভিযোগ শুনা যায় এবং তার ফলে যে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হইয়াছে বলা হয়, সে সবেরও মূলে রহিয়াছে ঐ শ্রমিক অসন্তোষ। কারণ আমি বিশ্বাস করি, সন্তুষ্ট শ্রমিক শুধু মিল কারখানা চালু রাখেন না, তাঁরা মিলের হেফাজত ও পাহারাদারিও করেন। প্রায় সব মিল-কারখানার শ্রমিকরা মিল এলাকাতেই বাস করেন। তাঁরা উদাসীন না হইলে অথবা সহযোগিতা না করিলে পরিচালক ম্যানেজারেরা মিলের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি অবৈধ বিক্রয় বা হস্তান্তর করিতে পারেন না। কাজ না করিয়া বসিয়া বেতন খাওয়া বা ভৌতিক শ্রমিকদের নামে বেতন ড্র করা, ইত্যাদি সব দুর্নীতির কথা ফেডারেশনের সভাপতি সাহেব বলিয়াছেন, তার সবগুলির মূলে আছে অসন্তোষ।

কেন এই শ্রমিক অসন্তোষ? আমাদের সরকার প্রায় সবগুলি মিল-কারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত করিয়াছেন। এখন হইতে সব মিল-কারখানার মালিক আর কতিপয় পুঁজিপতি নন। মিল-কারখানার মালিক এখন গোটা জাতি, বিশেষ করিয়া শ্রমিকরা নিজেরাই এই ধরনের উদ্দীপনাময়ী মর্মস্পর্শী অনেক বক্তৃতা মন্ত্রীরা করিয়াছেন। শিল্প-কারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত হইলে সেগুলিতে জনগণের অংশ হিসাবে শ্রমিকদেরও মালিকানা বর্তায়, আমাদের শ্রমিকরাও তাদের প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠান ট্রেড ইউনিয়নসমূহ, তা ভালরূপ জানেন। তাছাড়া বর্তমান জনপ্রিয় সরকার বেতন-ভাতা সম্পর্কে শ্রমিকদের কিছু কিছু সুবিধাও দিয়াছেন। তবুও শ্রমিকরা সন্তুষ্ট নন কেন?

আমার বিবেচনায় সমাজবাদী রাষ্ট্রের শ্রমিকদের মিল-কারখানা পরিচালনে শরিক না করার দরুণই এই অসন্তোষ সৃষ্টি হইয়াছে। শিল্প পরিচালনে ‘শ্রমিকদের শরিকানা’ লেবার পার্টিসিপেশন ইন ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট পুঁজিবাদী সমাজের অজানা নয়। পাকিস্তান আমলেও কথাটা ভারতবর্ষে চালু করিয়াছিলেন। কিন্তু সেই পার্টিসিপেশনের এলাকা ছিল খুবই সংকীর্ণ। তৎকালীন ওয়ার্কস কমিটি শ্রমিক-মালিকদের যুক্ত কমিটি হইলেও শ্রমিক মালিকদের মধ্যেকার মামলা নিষ্পত্তি করার মধ্যেই তাদের এলাকা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন হইয়াছে। অনেকগুলি শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করিয়াছি। অথচ সমাজবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শিল্প পরিচালনায় শ্রমিকের ভূমিকা আজও নির্ধারণ ও নির্দেশ করি নাই। স্বাধীনতার পরে আমাদের সরকার যে শ্রমনীতি ঘোষণা করিয়াছেন, তাতেও শ্রমিকদের ভূমিকা সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয় নাই। সংবিধান চালু হইবার পর যে সমাজবাদী অর্থনীতিক ভিত্তিকে শ্রমনীতি ঘোষণা করার কথা ছিল তা আজও করা হয় নাই।

তবু ঘোষণাটা বড় কথা নয়। কাজটাই বড় কথা। এই কাজটাই হইল শিল্প-পরিচালনায় শ্রমিকদের সক্রিয় শরিকানা। পুঁজিবাদী শিল্পেই হউক আর সমাজবাদী শিল্পেই হউক। মালিকানাটা আসলে থিওরোটিক্যাল কথা। শুধু শিল্প-কারখানায় নয় সব সম্পদ ও সম্পত্তি সম্বন্ধেই এ কথা সত্য। সমাজবাদী রাষ্ট্রের শিল্প-কারখানার শ্রমিকের স্থান নির্দেশ করা হয় সর্বপ্রথম নেহেরু নেতৃত্বের ভারতে ১৯৫৬ সাল। ঐ সালে ভারত সরকার যে শ্রমনীতি ঘোষণা করেন তাতে বলা হয়ঃ “সমাজবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে  শ্রমিকরা শিল্পের অংশীদার পার্টনার। এই অংশীদারত্ব পরিচালনায় প্রতিফলিত হইবে। পরিচালক, টেকনিশিয়ান শ্রমিকদের যুক্ত পরামর্শে সব শিল্প চলিবে। পাবলিক সেক্টরের শিল্পসমূহকেই এ ব্যাপারে পথ দেখাইতে হইবে।”

মনে রাখিতে হইবে, ভারত আমাদের মতই সমাজবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হইলেও আমাদের মত ভারতের সংবিধান সমাজবাদকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অন্তর্ভূক্ত করা হয় নাই। এই কারণে এ ব্যাপারে শ্রমিকদের কাছে আমাদের সরকারের দায়িত্ব অনেক বেশি। এ দায়িত্ব শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে এটা বাস্তব দায়িত্বও বটে। রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তি হিসেবে শ্রমিকরা শিল্পের মালিক সত্য, কিন্তু পরিচালনায় হাত না থাকিলে সে মালিকানা কাগজী অধিকার মাত্র। বাস্তব জীবনে তা নিতান্তই অর্থহীন।

পরিচালনা মানে, শিল্পে কি বস্তু, কত পরিমাণে, কত সময়ের মধ্যে প্রস্তুত হইবে, তার খরচ কত পড়িবে, কত মুনাফা হইবে, প্রতিষ্ঠানের কার কত বেতন হইবে, কার কি এলাকা ও কার কি ক্ষমতা থাকিবে, সে সবই ঠিক করিবেন যে বোর্ড, সেই বোর্ডে শ্রমিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকিবেন।

রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের মালিকানার দুই শরিক। সরকার ও শ্রমিক। পরিকল্পনা বোর্ডে দুই শরিকের প্রতিনিধিদের মধ্যে কি রেশিও থাকিবে, সেটা প্রথমতঃ সরকারী শ্রমনীতিতে ঘোষণা করা হইবে।

পরে সরকার ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা করিয়াই এর খুঁটিনাটি নির্ধারিত হইবে। শ্রমিকদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করিয়া সরকার শ্রমিকদের উপর আস্থা রাখুন। শিল্প-পরিচালনায় তাঁদের দায়িত্ব দিন। দেখিবেন, শিল্পে স্বাভাবিকতা ফিরিয়া আসিতেছি।

Comments

The Daily Star  | English

Abu Sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

12h ago