ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নারীর সুরক্ষায় কতটুকু কার্যকর?

ইন্টারনেটে নারীদের অপমান, দোষারোপ এবং নারীদের উপর নৈতিক পুলিশিং নিয়ে নতুন করে বলার মতো খুব সামান্যই বাকি আছে।

ইন্টারনেটে নারীদের অপমান, দোষারোপ এবং নারীদের উপর নৈতিক পুলিশিং নিয়ে নতুন করে বলার মতো খুব সামান্যই বাকি আছে।

কোনো নারী যখন সংবাদের শিরোনামে আসেন, তখন তার ভূমিকা কী- সেটা কেউ বিবেচনা করে না। এটি বারবার প্রমাণিত হয়েছে। এমন ক্ষেত্রে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- তিনি একজন নারী। আর এই পরিচয়ই তাকে একজন ঘৃণার পাত্র করে তোলার জন্য যথেষ্ট।

আমরা উদাহরণ দেখতে পারি। নারী যখন অপরাধের শিকার, যখন অপরাধের সাক্ষী কিংবা নিজেই যখন অপরাধী- এই তিন ক্ষেত্রে আইন ও সামাজিক মূল্যবোধ তাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে। এটি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা যেতে পারে।

মডেল-অভিনেত্রী ও উন্নয়ন কর্মী রাফিয়াথ রশীদ মিথিলার একটি বহুল আলোচিত ঘটনা দিয়ে শুরু করি। সম্মতি ছাড়াই তার ব্যক্তিগত কিছু ছবি ইন্টারনেটে ফাঁস হয়। এর ফলে জনপ্রিয় এই তারকা মূহুর্তেই মানুষের রোষানলে পড়ে যান।

তার এই ‘কেলেঙ্কারি’ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় ওঠে। ফেসবুকে সেদিন মিথিলার সম্পর্কে মানুষের সমালোচনা ও মতামত ছাড়া বলতে গেলে আর কোনো পোস্টই ছিল না। আমি খুব কম মানুষকেই দেখেছি, মিথিলা যে এখানে ভুক্তভোগী সেটা স্বীকার করে নিচ্ছেন এবং প্রতিবাদ করছেন।

তার সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষই একমত ছিলেন যে, ‘অবশ্যই, ছবি ফাঁস করা অপরাধ। তবে এই খারাপ নারীকে উপযুক্ত জবাব দেওয়া উচিত।’

ঘটনাটি ঘটেছে প্রায় নয় মাস আগে। অথচ, এখনও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথিলাকে নিয়ে একের পর এক ঘৃণ্য ও নোংরা মন্তব্য চলতে থাকলেও মন্তব্যকারীদের কারো বিরুদ্ধেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো খবর আমরা পাইনি।

লিখতে বসার আগে,  আবারো তার ফেসবুক থেকে ঘুরে আসি। এখনও সেখানে অনেক পুরুষ (এবং পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধিত্বকারী কয়েকজন নারী) মিথিলাকে তার ‘উপযুক্ত’ জবাব দিয়ে যাচ্ছেন।

অবাক হয়ে দেখি, মিথিলার  শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন, এমনকি একজন প্রতিভাবান মডেল-অভিনেত্রী হিসেবে তার যে খ্যাতি, এর কোনোটিই তাকে গুটিকয়েক পুরুষকে নোংরা মন্তব্য করা থেকে আটকাতে পারেনি। এসব পুরুষ তারাই যারা মনে করেন মিথিলাকে উপযুক্ত জবাব দেওয়া উচিত। তারা অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করতে একটুও দ্বিধা বোধ করেন না।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার হুমকি ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থাই তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে বলে মনে হয় না।

ক্ষমতাসীনদের জন্য সুবিধা হয় এমন কয়েকটি সুনির্দিষ্ট ঘটনা ছাড়া যে আইনের প্রয়োগ নেই, সেই আইন কল্যাণকর হয় কী করে?

কক্সবাজারে নিহত মেজর (অব.) সিনহার সহকর্মী শিপ্রা দেবনাথকে দুই উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নোংরা আলোচনায় একরকম টেনে এনেছেন। অথচ, তিনি এমন এক নির্মম ঘটনার ট্রমায় ভুগছেন।

শিপ্রার বিরুদ্ধে একটি সন্দেহজনক মাদক মামলা করা হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এই দুই বিষয় জড়িয়ে তার চরিত্র নিয়ে কুমন্তব্যের ঘটনায় তিনি মামলা করার ঘোষণা দেন। এর আগ পর্যন্ত ইন্টারনেটে তার বিরুদ্ধে অশ্লীল মন্তব্যের ছড়াছড়ি চলছিল।

অনুমতি ছাড়াই শিপ্রার ছবি ফেসবুকে শেয়ার করার অভিযোগে দুই পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে, তা নিতে অস্বীকৃতি জানান কক্সবাজার থানার ওসি।

ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও তাদের পোস্টে মন্তব্যকারীরা শিপ্রাকে সাক্ষী হিসেবে অপমান করার চেষ্টা করেন। তারা বলেন, শিপ্রা ধূমপান ও মদ্যপানের মতো অনৈতিক কাজে জড়িত।

এটা বেশ মজার একটা বিষয় যে, কীভাবে একই জিনিস পুরুষকে আরও পুরুষালী করে তোলে এবং নারীকে তকমা দেয় দুশ্চরিত্রের।

মিথিলা এবং শিপ্রা- এই দুই ক্ষেত্রেই নারীর উপর পুরুষের যে আধিপত্য খাটানোর চেষ্টা, তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

নারী কী পোশাক পরবেন, কী জিনিস পছন্দ করবেন, জীবনে কী হতে চাইবেন-- এ সবকিছুতেই পুরুষের একটা মতামত থাকতেই হবে। এমন পুরুষদের সঙ্গে সুস্থ ও যুক্তিযুক্ত আলোচনা চালানো কঠিন। কারণ তারা সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করেন, নারীর কোনো কিছুর উপরেই অধিকার থাকা উচিত না। এমনকি নিজের শরীর কিংবা জীবনের উপরও না।

মিথিলার মতো নারীরা সফল, কারণ পুরুষ তাকে সেই ‘অনুমতি’ দিয়েছিল এবং ‘কেলেঙ্কারি’র পর অনুমতি প্রত্যাহার করা হয়েছে। এমনটাই বিশ্বাস করেন মফস্বলের এক ঔষধ বিক্রয়কর্মী, যিনি মিথিলার ছবিতে নোংরা মন্তব্য করেছেন। একই মন্তব্যে তিনি সৃষ্টিকর্তার নামও নেন। (মিথিলার উপরে তার সৃষ্টিকর্তাও যে অখুশি, এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত।)

কোনো অপরাধে জড়িত না থেকেই নারীদের এ ধরনের আক্রমণের শিকার হতে হয়। তাহলে যখন একজন নারী অবৈধ এবং অনৈতিক কাজের জন্য শিরোনামে আসেন, তখন কী হয়?

ফটোজেনিক ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীকে তার প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথ কেয়ার থেকে ভুয়া কোভিড-১৯ সার্টিফিকেট দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। প্রচলিত সমাজে ‘আকর্ষণীয়’ এই নারীকে হাতকড়া পরা অবস্থায় দেখে আমজনতা ব্যাপক আনন্দিত হন।

ডা. সাবরিনা কীভাবে পোশাক পরেন, কীভাবে চলাফেরা করেন- কোনো ভয় ছাড়াই সরাসরি এসব নিয়ে মন্তব্য করা শুরু হয়। এক্ষেত্রে জঘন্য ভাষার কোনো সীমাই আর ছিল না। কারণ, এখানে সাবরিনা একজন অপরাধী। সুতরাং তিনি কাউকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের হুমকিও দিতে পারছেন না। এমনকি তারা যখন সীমা ছাড়িয়ে অশ্লীল ফুটেজের ওপর এডিট করে তার মুখ বসিয়ে ৫৬৩তম বারের মতো ‘হট ভিডিও’ আপলোড করছেন, তখনও তাদেরকে থামানোর উপায় নেই।

ভুয়া সার্টিফিকেট দেওয়ার অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করা হলেও তার প্রথম পাপ হলো- তিনি একজন নারী।

বাস্তবে কোনো নারী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে উত্ত্যক্তকারীদেরকে থামাতে পারবেন কিনা, এ নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।

শিপ্রার মামলা নিতে কক্সবাজারের ওসির অস্বীকৃতি জানানো এটাই প্রমাণ করে যে, আইনটি সাধারণ মানুষকে রক্ষার জন্য না, বরং ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কথা বলার সময় জনগণকে চুপ করিয়ে দেওয়ার জন্য।

ইন্টারনেটে নারীদের সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়ে কী করা যায়, সে সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়ার মতো আমার কাছে কিছুই নেই। আইন এক্ষেত্রে কাজ করে না, সুস্থ- স্বাভাবিক কথোপোকথনও না।

নারীর ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম কাজের বিরুদ্ধেও ধর্ম ও সামাজিক মূল্যবোধকে বিদ্বেষের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই ঘৃণ্য মন্তব্যকারীরা স্বীকার করেন না যে, প্রত্যেকের বিশ্বাস সমান মাপকাঠি দিয়ে বিবেচনা করা যাবে না। ভিন্ন লিঙ্গ, ধর্ম, সম্প্রদায় বা নৃগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে সহাবস্থান করাটাও তারা অসম্ভব বলে মনে করেন। নিজেদের সব কিছুকে তারা তাদের (ধর্মান্ধ) পরিচয়ের বিরুদ্ধে হুমকি হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্যগুলো পড়ার পর, এ দেশের নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন বোধ করি। আমি নিশ্চিত, কমেন্টে যেসব পুরুষ জঘন্য শব্দ ব্যবহার করে আক্রমণ করেন, তারা বাস্তব জীবনেও নারীর উপর জোর খাটানো থেকে বিরত থাকবেন না।

ফেসবুক নাম-পরিচিতিবিহীন কোনো মাধ্যম নয়। এখানে যে কাওকেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু তারপরও কেউ থেমে থাকছে না। আইন প্রয়োগকারীরা নিজেরাই এখন এই সমস্যার অংশ হয়ে গেছেন।

শুধু ভাবি, নারীদের সহজাত অস্তিত্বের জন্য আর কতদিন তাদেরকে পুরুষতন্ত্রের চোখে ‘অপরাধী’ হিসেবে মাশুল দিয়ে যেতে হবে!

Comments

The Daily Star  | English

Yunus's 'Reset Button' call was not about erasing Bangladesh's proud history: CA office

He meant resetting the software, not the hardware created by 1971 Liberation War, statement says

53m ago