২ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি উচ্চ আদালতের রায়
মৌলভীবাজার জেলার অনেক স্থান থেকে অবৈধভাবে সিলিকা বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ করার রায় দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। এই আদেশে সিলিকা বালুর পরিবেশ প্রভাব মূল্যায়ন (এনভায়ারমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট, ইআইএ) করতেও নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট বিভাগকে। কিন্তু, ওই আদেশের দুই বছর পার হয়ে গেলেও চিঠি চালাচালির মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো।
এই সুযোগে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন অব্যাহত আছে এবং স্থানীয় কিছু অতি মুনাফালোভীদের কারণে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ।
২০১৮ সালের ৩ জুলাই উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ সংশ্লিষ্ট বিভাগকে মৌলভীবাজারের অধীনে সিলিকা বালুর এনভায়ারমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) পরিচালনার নির্দেশ দেন। খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো কর্তৃক পরিবেশের ছাড়পত্র (ইসিসি) ছাড়া অবৈধভাবে ইজারা দেওয়া ১৯টি কোয়ারিসহ জেলার ছয় উপজেলায় চিহ্নিত ৫১টি কোয়ারি (সিলিকা বালি উত্তোলন অঞ্চল) থেকে সিলিকা বালু উত্তোলন বন্দের নির্দেশ দেন।
তখন আদালত বলেছিলেন, ‘আইন অনুসারে পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কমিটি কর্তৃক এনভায়ারমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্টের (ইআইএ) উপর ইসিসি প্রাপ্তির পরেই কোয়ারি ইজারা দেওয়া যেতে পারে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) দায়ের করা একটি রিট আবেদনের পর আদালতে এই রায় দেওয়া হয়।
বেলার প্রতিনিধিত্বকারী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, ‘জেলার ছয় উপজেলার ইজারা-বহির্ভূত সিলিকা বালু উত্তোলন এবং অনিয়ন্ত্রিত, নির্বিচার ও বিপজ্জনকভাবে বালু উত্তোলনে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইন ও সরকারি নীতি লঙ্ঘন করেছে।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘ড্রিল, ড্রেজিং বা মেশিনের ব্যবহার ইজারা চুক্তির লঙ্ঘন। এগুলো পরিবেশের পাশাপাশি রাস্তাঘাট, সেতু, কৃষি ও ভূমিসহ বেসরকারি ও সরকারি সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’
আবেদনকারী বলেছিলেন, ‘পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের অভাবে সিলিকা বালি উত্তোলনের অনুমতি দেওয়ার কারণেই তারা আইন লঙ্ঘন করছে। সিলিকা বালু মূলত খনিজ সম্পদ এবং খনি থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং এটি অন্যান্য খনিজ সম্পদের মতো ‘রেড ক্যাটাগরি’ এর আওতায় পড়ে এবং বাধ্যতামূলক পরিবেশ ছাড়পত্রের (ইসিসি) জন্য ইআইএ প্রয়োজন।’
তবে, গত দুই বছর ধরে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো একটি এনভায়ারমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো এনভায়ারমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) পরিচালনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে বেশ কয়েকটি চিঠি পাঠিয়েছিল। তবে, পরবর্তীতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্তারা জানায় এটি তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।
পরিবেশ অধিদপ্তর জবাবে জানিয়েছিল, তারা খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো থেকে এনভায়ারমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) পাওয়ার পরে কেবল পরিবেশগত ছাড়পত্র সরবরাহ করতে পারে।
বিধি অনুযায়ী, খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর সিলিকা বালির খনির একটি এনভায়মেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) পরিচালনার কথা ছিল। কিন্তু, এনভায়ারমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) না হওয়ায় অবৈধভাবে সিলিকা বালি উত্তোলনে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার অন্তর্গত সাতগাঁও, ভূনবীর শাসন, মির্জাপুর, ইসলামপাড়া ও ইছামতি গ্রামে সরেজমিনে ড্রেজার এবং লম্বা পাইপ ব্যবহার করে অবৈধভাবে সিলিকা বালু উত্তোলন করতে দেখা গেছে।
ইসলামপুর গ্রামের বাসিন্দা কবির মিয়া বলেন, ‘স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় মেশিন ও ড্রেজার স্থাপন করে কৃষিজমি থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বালু ব্যবসায়ীরা ভূপৃষ্ঠের ৩০ থেকে ৪০ ফুট নিচ থেকে সিলিকা বালু উত্তোলন করছে। ফলে, আশেপাশের কৃষি, পার্বত্য জমি এবং খালগুলো ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।’
২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। ওই চিঠিতে জেলার ৫১টি সিলিকা থেকে বালু উত্তোলনের পরিবেশগত প্রভাবের মূল্যায়ন করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল।
২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি চিঠির উত্তরে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক লিখেছিলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো বিভাগ বা সংস্থা পরিবেশগত প্রভাবের মূল্যায়ন করে না।’
খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে আরও একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। ওই চিঠিতেও জেলার ৫১টি সিলিকা থেকে বালু উত্তোলনের পরিবেশগত প্রভাবের মূল্যায়ন করার অনুরোধ জানানো হয়।
এ প্রসঙ্গে লাউয়াছড়া বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক জলি পাল বলেন, ‘চিঠি চালাচালি করতে করতে দুই বছর চলে গেছে। কিন্তু, বালু উত্তোলন থামেনি। কোটি কোটি টাকার অবৈধ বালুর ব্যবসা চলছে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন অব্যাহত থাকায় বিপদগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের জীবন ও সম্পদ। ফলস্বরূপ, প্রাকৃতিক জলাশয়, পাহাড়ি ছড়া, সুরক্ষিত অঞ্চল, চা বাগান, ফসলের জমি, ভূমিধ্বস, রাস্তাঘাট, ঘাট, সেতু, কালভার্ট এবং প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কঠোর নজরদারি সত্ত্বেও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন অব্যাহত আছে। গত ২১ মাসে সাড়ে ৭৮ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের সহকারী পরিচালক বদরুল হুদা বলেন, ‘আমরা এখনো খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো থেকে কোনো আবেদন গ্রহণ করতে পারিনি। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ অনুসারে এনভায়ারমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্টের (ইআইএ) সঙ্গে ইসিসির আবেদন জমা দেওয়ার জন্য খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা আবেদন জমা দিলে আমরা হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী উদ্যোগ নেব।’
খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর উপপরিচালক মামুনুর রশিদ বলেন, ‘এনভায়ারমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) পরিচালনার জন্য আমাদের তহবিল নেই। এনভায়ারমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) মূল্যায়ন করা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপর নির্ভর করে। এটি তারা এখনো করেনি। এজন্য প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত হচ্ছে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘যখনই আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন পরিবেশের ক্ষতি করার জন্য একটি নতুন উপায় উদ্ভূত হয়। সরকারি সংস্থাগুলোর দ্রুত ও স্বচ্ছ উপায়ে একটি ভালো সিদ্ধান্ত অনুসরণ করার কথা ছিল। তারা কেবল অবৈধ বালু উত্তোলন যেন অব্যাহত থাকে ও পরিবেশের যেন বেশি ক্ষতি হয় সেজন্য বিলম্ব করছে।’
Comments