কোরিয়ার বাড়িটা অবশেষে ইতিহাস হয়ে গেল!

কত বছর ধরে বাড়িটিতে বাংলাদেশিরা অবস্থান করেছিল ঠিক জানা নেই। আমরা মজা করে এই বাড়িটিকে বলতাম বাংলাদেশিদের 'কিংডম অফ গাম্মান্ডোং'। একেবারে কোরিয়ান পুরাতন আমলের বাড়ি। এমন বাড়ি বর্তমানে আধুনিক দক্ষিণ কোরিয়ায় বিশেষত বুসানের মতো শহরে খুবই বিরল।
স্মৃতিবিজড়িত বুসানের সেই বাড়িটা। ছবি: লেখক

কত বছর ধরে বাড়িটিতে বাংলাদেশিরা অবস্থান করেছিল ঠিক জানা নেই। আমরা মজা করে এই বাড়িটিকে বলতাম বাংলাদেশিদের 'কিংডম অফ গাম্মান্ডোং'। একেবারে কোরিয়ান পুরাতন আমলের বাড়ি। এমন বাড়ি বর্তমানে আধুনিক দক্ষিণ কোরিয়ায় বিশেষত বুসানের মতো শহরে খুবই বিরল।

উত্তরাধিকার সূত্রেই হোক কিংবা ছাত্রাবস্থায় একটু সস্তায় থাকার জন্য হোক আমরা বাড়িটাতে উঠেছিলাম। এর আগে ছিলেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক তাওহীদ ভাই। এর পরে বাসাটিতে আমরা উঠেছিলাম। এর আগে কতজন যে এই বাসায় থেকে ডিগ্রি নিয়েছেন হিসেব নেই।

একজনের পর আরেকজন বাংলাদেশি উঠেছেন। এই ধারাবাহিকতার ব্যতিক্রম হয়নি এক যুগেরও বেশি সময়ে! পূজা-ঈদের পুনর্মিলনী কিংবা নববর্ষের জন্য আঙিনাযুক্ত খোলামেলা এই বাড়িতে কতজনের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে!

গান, আড্ডাবাজি, কিংবা বিয়েও বাদ যায়নি এখানে! রান্নাবান্নার আয়োজন তো ছিলই, উপরন্তু বাংলাদেশি কমিউনিটি থেকে বড় আকারের রান্নার আয়োজনের জন্য সবকিছুই কেনা হয়েছিলো। এগুলো অবশ্য সবই এখন অতীত। দক্ষিণ কোরিয়া সরকার এই এলাকাটা নতুন করে সাজাবে। এজন্য বাসার মালিক আর বাসাটা রক্ষণাবেক্ষণের ঝামেলা পোহাতে রাজি নয়।

শুধু বাংলাদেশি নয়, ভারতের বাঙালিরাও আসতেন এখানে। সাউথ ইন্ডিয়ার পার্থ দাদার একটা অভ্যাস ছিল নিজের বাসায় যাওয়ার আগে এই বাসায় এসে দরজায় নক দিয়ে, কুশলাদি বিনিময়। অসাধারণ ভালো এই মানুষটিকে আমরা বিখ্যাত সাউথ ইন্ডিয়ান হিরো রজনীকান্তের নামে 'দাদা দি রজনীকান্ত' নামে ডাকতাম। উনি নিশ্চয়ই মিস করবেন এই বাসাটিকে!

আমি দক্ষিণ কোরিয়ায় আসার পর মাত্র কয়েকটি অনুষ্ঠান পেয়েছিলাম উপভোগ করার। প্রতিটি অনুষ্ঠানে সেই সকাল থেকে রান্নাবান্না, দুপুরে খাওয়া-দাওয়া আর আড্ডাবাজি আর বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খেলাধুলা। আহ, সেইসব দিনগুলো! এই বাসায় আর কখনো এমন আড্ডা জমবে না, শুধু গল্প করবো আর শুনবো, এটি এখন অতীত হয়েই গেলো।

দক্ষিণ কোরিয়ার নিয়ম অনুযায়ী ময়লা ফেলার কঠোর নিয়ম কানুন বর্তমান। বাসা বদলের সময় সব সাফসুতরো না করে দিলে বাসার ডিপোজিট মানি ফেরতও দেবেন না বাড়িওয়ালা। আর আপনি নির্ধারিত কোম্পানিও জায়গা ছাড়া যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলতেও পারবেন না। মহা মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলাম। তদুপরি ডিগ্রি শেষে দেশে যাওয়ার সময় অনেকেই নির্ধারিতভাবে ময়লা না ফেলে ঝামেলা এড়ানোর জন্য স্টোর রুমগুলোতে ডিপোজিট করে গিয়েছিলেন। একজনের পর আরেকজন এই বাসায় উঠার জন্য। বাড়িওয়ালাও কখনো চেক করতে আসেনি।

এভাবেই চলেছে অনেক বছর। কিন্তু শেষমেশ এই বাসার সর্বশেষ বাসিন্দা হিসেবে সব ফেলে দেয়ার দায়িত্ব এসে পড়লো আমার ঘাড়ে। চলমান ফ্রিজ, কিছুদিন আগেই রিপ্লেস করা ওয়াশিং মেশিন, ওভেন, বেড, টেবিল, সোফা আর বহু বছরের ময়লা ফেলে দেয়ার মাধ্যমে একটা বাড়ি ইতিহাসে জায়গা করে নিলো।

গত দুই সপ্তাহ জুড়ে এই ময়লা গুছানো ও ফেলার জন্য সবসময়ই সাথে ছিল ছোট ভাই হাবীব। ওর সহযোগিতা ছাড়া এটা প্রায় অসম্ভব ছিল। আর সাথে নাজমুল যে পরিমাণ পরিশ্রম করেছে। শেষমেশ যখন ময়লা ফেলার কোম্পানি এসে টাকা নির্ধারণ করে ফেলে দেয়া কনফার্ম করলো হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। সাথে অতীত হয়ে গেলো অনেকের মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনের এই বাসস্থান। কারণ এই বাড়িটিতে থেকেই যে তারা লেখাপড়া শেষ করেছিল। এই বাড়িটিতেই যে জড়িয়ে আছে অনেক বাংলাদেশির স্মৃতি।

(লেখক: পিএইচডি গবেষক, বুসান, দক্ষিণ কোরিয়া)

 

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

7h ago