পাটের দাম কমলেও বেড়েছে উৎপাদন খরচ
উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় আর বিক্রয়মূল্য কমে যাওয়ায় দিন দিন পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের কৃষক। তবে পাট চাষে কৃষকদের আগ্রহী করতে কাজ করছে পাট উন্নয়ন অধিদপ্তর।
চলতি বছরে দীর্ঘ মেয়াদি বন্যা পরিস্থিতিতে পাটের আশানুরূপ উৎপাদন হয়নি। বাজারে প্রতি মন (৪০ কেজি) পাট এক হাজার ৯০০ থেকে দুই হাজার ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত বছরও পাটের মূল্য এমনই ছিল। কৃষকদের প্রত্যাশা ছিল এ বছর তারা পাট বিক্রি করে আগের চেয়ে বেশি দাম পাবেন।
কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের পাট উন্নয়ন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর কুড়িগ্রামে ২০ হাজার ৭২০ একর জমিতে পাট চাষ করে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৯৬ হাজার ৮১৭ বেল্ট (প্রতি বেল্টে ১৮০ কেজি) এবং লালমনিরহাটে ১৪ হাজার ৮০০ একর জমিতে চাষ করে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৬৯ হাজার ১৫৫ বেল্ট।
পাট উন্নয়ন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, প্রতি বিঘা জমিতে উৎপাদন ধরা হয় ছয় মন। দুই জেলায় প্রায় ৩০ হাজার কৃষক পাট চাষ করেছেন।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার হোকুন্ডা গ্রামের কৃষক হামিদুল ইসলাম (৫৮) বলেন, ‘পাট চাষে কৃষকদের কোনো লাভ নেই এখন। উৎপাদন খরচ বেড়েছে অনেক। কিন্তু উৎপাদন বাড়েনি। আর বাড়েনি পাটের দাম। এক বিঘা জমি থেকে কৃষকরা তিন থেকে পাঁচ মন পাট পান। কিন্তু, এক বিঘা জমিতে পাট চাষে খরচ হয় সাত থেকে আট হাজার টাকা।’
‘বাজারে বর্তমানে যে দামে পাট বিক্রি করেছি তাতে উৎপাদন খরচ তুলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে,’ যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও জানান, এ বছর প্রায় ৩২ হাজার টাকা খরচ করে চার বিঘা জমিতে পাট চাষ করে উৎপাদন করতে পেরেছেন ১৫ মন। প্রতি মন পাট বিক্রি করেছেন দুই হাজার ২০০ টাকা দরে।
তিনি বলেন, ‘পাটচাষে শুধু লাভ বলতে কিছু পাট কাঠি পাই। আর এসব পাট কাঠি আমাদের কৃষি জীবনে দৈনন্দিন কাজে লাগে।’
১০ বছর আগে তিনি ১২ থেকে ১৫ বিঘা জমিতে পাট চাষ করতেন বলে জানান।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট গ্রামের কৃষক বাবু রায় (৬৫) বলেন, ‘আগে পাটের আঁশকে বলা হতো সোনালী আঁশ। আর এখন পাটের আঁশ হয়েছে কৃষকের দুঃখের আঁশ।’
তিনি বলেন, ‘পাট চাষে আমরা লাভবান হচ্ছি না। কিন্তু, তবুও পাট চাষ করি। কারণ, পাটের আঁশ ও পাট কাঠি আমাদের কাজে লাগে।’
‘গেল বছর আমি আট বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি। আর এ বছর করেছি মাত্র তিন বিঘা জমিতে। আগামী বছর এক বিঘা জমিতে পাট চাষ করবো,’ বলেন তিনি।
প্রতি মন পাটের দাম দুই হাজার ৮০০ থেকে তিন হাজার টাকা হলে আবার তিনি পাট চাষে আগ্রহী হবেন বলে জানান।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার গুনাইগাছ গ্রামের কৃষক সফিয়ার রহমান (৬০) বলেন, ‘এখন শুধু পাট কাঠির জন্য পাট চাষ করতে হচ্ছে। প্রতি বিঘা জমি থেকে দুই থেকে আড়াই মন পাটকাঠি পাই।’
‘উৎপাদিত পাট বিক্রি করে কোনো রকমে খরচ উঠে আসে,’ তিনি জানান।
তিনি বলেন, ‘গেল বছর আমি পাঁচ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছিলাম। আর এ বছর করেছি তিন বিঘা জমিতে। আগামী বছর হয়তো এক-দুই বিঘা জমিতে পাট চাষ করবো।’
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা গ্রামের কৃষক নাদের আলী (৫৮) জানান, এ বছর বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘ হওয়ায় তারা পাটের ফলন পাননি। পাটের দাম বৃদ্ধি করা না হলে আগামী বছরগুলোতে তারা পাট চাষ থেকে বিরত থাকবেন। কেবল পরিবারের প্রয়োজনে এক-দুই বিঘা জমিতে পাট চাষ করবেন বলে তিনি জানান।
লালমনিরহাট পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা আব্দুস সাত্তার মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পাট চাষে কৃষক আগ্রহ হারাচ্ছেন না, বরং তারা পাট চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। কৃষকদের পাট চাষে উদ্বুদ্ধ করতে তাদেরকে বিনামূল্যে বীজ ও সার দেওয়া হচ্ছে।’
‘উৎপাদন ভালো হলে বাজারে বর্তমানে যে মূল্য আছে তাতে কৃষক লাভবান হবেন,’ তিনি জানান।
কুড়িগ্রাম পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা তৈয়বুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এ বছর দীর্ঘ মেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির কারণে কৃষক পাটের তেমন ফলন পাননি। তাই তারা হতাশ। তবে তাদেরকে পাট চাষে আগ্রহী করতে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। উন্নত জাতের বীজ ও নিয়ম অনুযায়ী পাট চাষ ও আঁশ প্রস্তুত করতে পারলে কৃষক অবশ্যই পাট চাষে লাভবান হবেন।’
‘পাট চাষকে লাভবান করতে আমরা কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণের কাজ করছি। পাট চাষে কৃষকদের পূর্বের অবস্থানে ফিরে আনতে চেষ্টা করছি,’ তিনি জানান।
Comments