সম্প্রীতির এক সীমান্ত ‘বাঁশজানি-ঝাকুয়াটারী’
চার শিশু খেলছে। তাদের বয়স ৮ থেকে ১০ বছর। তাদের মধ্যে দুজন বসে আছে ভারতের ভূখণ্ডে আর দুজন বাংলাদেশে। ভারতের দুই শিশু সামিয়া খাতুন (৯) আর সদিরুল ইসলাম (১০) চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের মিজানুর রহমান (৮) তৃতীয় শ্রেণির আর নয়ন ইসলাম (১০) পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
পাশেই দাড়িয়ে তাদের খেলা দেখছে ভারতীয় নাগরিক নুসরাত খাতুন (৯)। সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। নুসরাত যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটি ভারতের ভূখণ্ড আর যে বাঁশের খুঁটিটা ধরে আছে তা বাংলাদেশে।
এমনি এক সম্প্রীতির সীমান্ত বাঁশজানি-ঝাকুয়াটারী। বাঁশজানি বাংলাদেশের অংশ। এটা কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ইউনিয়নের একটি গ্রাম। আর ঝাকুয়াটারী ভারতের অংশ। এটা পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার সাহেবগঞ্জ থানার একটি গ্রাম।
দুই বাংলার চার শিশু খেলছে ‘বলছল’। মনের আনন্দে তাদের খেলা দেখে মনে হচ্ছিল, তারা যে দুই বাংলার নাগরিক এটা ভুলেই গেছে।
সামিয়া খাতুন বলে, ‘আমরা প্রতিদিনই খেলি। কোনোদিন কারো সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ হয় না।’
শুধু এক সঙ্গে খেলা নয়, তারা একে অপরের বাড়িতে যাতায়াত করে বলেও সে জানায়।
নয়ন ইসলাম জানায়, তারা যে পৃথক দেশে নাগরিক, এটা তাদের মনেই হয় না। ‘ভারতের বন্ধুদের বাড়িতে সবসময় যাওয়া আসা করি, খাওয়া-দাওয়া করি। ওরাও আসে আমাদের বাসায়।’
এখানে কোনো কাঁটা তারের বেড়া নেই, নেই কোনো সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ঝামেলা। সবকিছুই স্বাভাবিক বলে জানালো এই শিশু।
বাঁশজানি-ঝাকুয়াটারী সীমান্তের ভারতের ঝাকুয়াটারী গ্রামে বসবাস করেন ৪৫টি পরিবারের প্রায় ২৫০ মানুষ। আর বাংলাদেশের বাঁশজানি গ্রামে ৭০টি পরিবারে বসবাস প্রায় ৩০০ মানুষের। দুটি গ্রামের পরিবারের মধ্যে রয়েছে আত্মীয়তা। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় তারা বিভক্ত হয়ে যান, কিন্তু তাতে আত্মীয়তায় ছেদ পরেনি।
ঝাকুয়াটারী গ্রামের লুৎফর রহমান (৮৫) বলেন, ‘প্রায় ৩০ বছর আগে যখন কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়, তখন আমরা এর ভেতর যাইনি। কারণ এই গ্রামেই আমাদের সব জমিজমা। আমাদের দাবি সরকার মেনে নিয়েছে এবং আমরা এই গ্রামেই থাকছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ এই দুই গ্রামের মানুষ একে অপরের আত্মীয়। এই আত্মীয়তা কিন্তু অনেক পুরানো। নতুন করে আর কোনো আত্মীয়তা হয়নি। আমরা সবাই একসঙ্গে আছি। আমাদের সমাজও এক। পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমরা একে অপরের বাড়িতে দাওয়াতে যাই, কেউ মারা গেলে জানাজায় যাই।’
বাঁশজানি গ্রামের আকলাস আলী (৭৬) বলেন, ‘এটা আমাদের সম্প্রীতির সীমান্ত। এখানে নতুন কেউ আসলে বুঝতেই পারবে না এখানে দুটি দেশের ভূখণ্ড আছে। আমাদের মধ্যে কোনো হিংসা-বিবাদ নেই। আমরা ভারতে যাই আর তারা বাংলাদেশে আসে। একসঙ্গে সময় কাটাই। একে অপরের প্রয়োজনে অর্থ লেনদেনও করি।’
কুড়িগ্রাম জেলার পাথরডুবি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর মিঠু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বাঁশজানি-ঝাকুয়াটারী সীমান্ত সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণ। দুই গ্রামের সব মানুষই কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল। একসঙ্গে তারা ওঠাবসা ও চলাফেরা করছে কোনো ধরনের সমস্যা ছাড়াই।’
Comments