সাংবাদিকের কাজই তথ্য প্রকাশ করা, ব্যবস্থা কেন নেওয়া হবে?

অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের হত্যার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির জমা দেওয়া প্রতিবেদন প্রকাশের আগেই তার ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রথম আলো। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি আলোড়ন তৈরি করেছে।
মতিউর রহমান চৌধুরী, মনজুরুল আহসান বুলবুল ও শ্যামল দত্ত।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের হত্যার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির জমা দেওয়া প্রতিবেদন প্রকাশের আগেই তার ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রথম আলো। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি আলোড়ন তৈরি করেছে।

এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর মূলত তিনটি প্রসঙ্গ আলোচনায় এসেছে।

এক. এরকম একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে গণমাধ্যম কাজটি সঠিক করেছে কি না?

দুই. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন কীভাবে পত্রিকায় প্রকাশ পেল সেটা তিনি জানেন না। তিনি এও বলেন, ‘এটা যে প্রকাশ করেছেন বা তথ্য সরবরাহ করেছেন, আমি মনে করি কাজটি সঠিক করেননি।’

তিন. একজন সাংবাদিক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছেন, প্রকাশিত প্রতিবেদনের জন্যে পত্রিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না।

এই তিনটি প্রশ্ন বা প্রসঙ্গ নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল ও ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্তের সঙ্গে।

মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘আমি মনে করি এটা সঠিক কাজ হয়েছে। একজন রিপোর্টারের কাজই হলো তথ্য বের করা। আমি নিজেও রিপোর্টার ছিলাম। বহুবার এ ধরনের বিষয় বের করার চেষ্টা করেছি। এর মধ্যে অসুবিধা বা সমস্যার কিছু আমি দেখছি না। যারা বলছেন, এটা করায় অসুবিধা হয়েছে, তারা স্বাধীন সাংবাদিকতায় হস্তক্ষেপ করছেন বলে আমি মনে করি। একজন সাংবাদিকের কাজই হচ্ছে তথ্য বের করা।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জায়গা থেকে তিনি ঠিকই বলেছেন। তিনি তো বলেননি যে পত্রিকা ভুল করেছে। একজন রিপোর্টারের কাজই তো এটা। না হলে তো কোনোদিন রিপোর্টই বের হবে না। এটাই তো রিপোর্টারের ক্রেডিট। এখন তিনি কীভাবে বের করেছেন বা কারা তাকে তথ্য দিয়েছেন, সেটা তো জানার বিষয় না।’

গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের বিষয়ে মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘অনেক সময় আমাদের দেশে যেটা হয়, আমি না পেলে, অন্য যে পেল, তাকে খোঁচানো। আমি বলব, এটা অসুস্থ সাংবাদিকতার একটা লক্ষণ। এটা কোনো কথা হতে পারে না। আমি পারিনি বলে যা ইচ্ছে তাই বলব যে এটা কীভাবে পেল? এটাই হলো আমাদের দেশের সাংবাদিকতার স্ট্যান্ডার্ড। দীর্ঘদিন আমি রিপোর্টার ছিলাম, এখনো রিপোর্ট করি। আমি মনে করি এটা স্বাধীন সাংবাদিকতায় এক ধরনের হস্তক্ষেপ। আমাদের সাংবাদিকদের সমস্যাটাই এটা। এটা কোনো প্রশ্ন হয়েছে যে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? ব্যবস্থা নেবে কেন, এটা তো ক্রেডিট। তাহলে তো ওয়াশিংটন পোস্ট বা ওয়াশিংটন টাইমস ওই সময়ে নিক্সনের (সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট) বিরুদ্ধে যে রিপোর্ট করেছিল, নিক্সন কি ওই রিপোর্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল? নেয়নি। এটা হয় না। কোনোকালেই হয় না। কালে কালে আমাদের দেশে তো কত কিছুই হচ্ছে। এমনটাই দেখলাম ৫০ বছরের সাংবাদিকতার জীবনে।’

মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘আমি মনে করি সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত দায়িত্বই পালন করা হয়েছে। সাংবাদিকের কাছে যদি সঠিক তথ্য থাকে, সেটা প্রকাশ করাই তার কাজ। সাংবাদিকতার আরেকটা খুব শক্ত পেশাগত থিউরি আছে যে, যদি কোনো তথ্য কেউ গোপন করতে চায়, সেটা প্রকাশ করাই সাংবাদিকের পেশাগত কাজ। তা জনগণের সামনে তুলে ধরা। এখানে একটা বড় প্রশ্ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে থাকে, তা হলো— এটা গোপনীয়। গোপনীয় তথ্য মানে কী? একটা ফাইলের ওপর গোপনীয় তথ্য লিখে দিলেই সেটা কিন্তু গোপনীয় তথ্য না। এটাকে আইনগতভাবে ক্লাসিফাইড ঘোষণা করতে হবে। পৃথিবীর সব দেশের সরকারের এটা নিয়ম আছে যে কিছু বিষয় বা তথ্যকে তারা ক্লাসিফাইড ঘোষণা করবে।’

‘আমাদের সংবিধানের ৩৯ নম্বর ধারায় বলা আছে যে এমন কোনো তথ্য প্রকাশ করা যাবে না যার মধ্য দিয়ে সমাজে বৈরিতা সৃষ্টি হয়, বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়, এমন কিছু শর্ত দেওয়া আছে। কিন্তু, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের কারণে ৩৯ ধারার কোনো শর্ত লঙ্ঘন হয়নি। ফলে আমি মনে করি, একজন সাংবাদিক পেশাদারিত্বের সঙ্গেই কাজটি করেছেন। যদি মন্ত্রণালয় মনে করে থাকেন যে তারা এখনই এটা প্রকাশ করবে না, সেটা তাদের তথ্য ব্যবস্থাপনার অংশ। আমাদের বাংলাদেশ সরকারের মূল সমস্যা হলো তাদের হাতে তথ্য থাকে; কিন্তু, সেই তথ্য ব্যবস্থাপনার কোনো দক্ষতা তাদের নেই। কোন তথ্য কখন প্রচার করতে হবে, কখন করা যাবে না, এটা ব্যবস্থাপনার জন্য বিশেষজ্ঞ আমাদের সরকারের নেই’, বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার যদি মনে করে, তারা কোনো তথ্য ক্লাসিফাইড ঘোষণা করতে পারে। তাহলে আমরা বুঝব যে এই তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু, (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির) ওই প্রতিবেদন এখন পর্যন্ত ক্লাসিফাইড ঘোষণা করা হয়নি। কাজেই আমাদের যে সাংবাদিক এই কাজটা করেছেন, তাকে আমি ধন্যবাদ জানাই যে তার সোর্স এত শক্তিশালী। যার মাধ্যমে এরকম একটি তথ্য তিনি নিয়ে এসেছেন।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়তো একটু বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি সাংবাদিক হিসেবে কাজটি সঠিক হয়েছে। সাংবাদিক হিসেবে এটি আমাদের দায়িত্ব যে মানুষকে তথ্যটা জানানো। এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়তো একটু বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে যে তাদের দপ্তরের তথ্য কীভাবে পাওয়া গেল। অতীতেও এমন ঘটনার নজির রয়েছে। অনেক তথ্যই সাংবাদিকরা জনগণের সামনে তুলে ধরেছে। আমি নিজেও করেছি। কাজেই সরকার যদি কিছু গোপন রাখতে চায়, তাহলে সেটা তার ব্যবস্থাপনার মধ্যে রাখতে হবে যে এটাকে ক্লাসিফাইড ঘোষণা করা বা কীভাবে এটা সংরক্ষণ করা হবে। কিন্তু, সাংবাদিকের দায়িত্বই হচ্ছে তথ্য প্রকাশ করা। যে তথ্য গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়, সেটা প্রকাশ করার মধ্যেই সাংবাদিকতার মুনশিয়ানা। আমি মনে করি একজন সাংবাদিক পেশাদারিত্বের সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করেছেন। ভুল কোনো কাজ করেনি।’

তবে, গণমাধ্যমকর্মীদের কাছ থেকেই এই ধরনের প্রশ্ন খুব দুঃখজনক বলে মনে করেন মনজুরুল আহসান বুলবুল। তিনি বলেন, ‘পেশাগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবেই যে, এই পত্রিকা ভালো রিপোর্ট করবে, আমরা কেন করতে পারলাম না। কিন্তু, সেটা পেশাগত প্রতিহিংসা হতে পারে না যে, আমি পারিনি, ওই পত্রিকা পেরেছে। কাজেই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেন। আমি মনে করি এটা খুবই নিচুমানের একটা রুচির পরিচয়। আমার যে বন্ধুটি একটি পত্রিকায় ভালো রিপোর্ট করলেন, আমার দায়িত্ব তার প্রশংসা করা। একইসঙ্গে ভাবা, আমি এরচেয়েও ভালো রিপোর্ট করব। যদি একটি পত্রিকা মনে করে যে, আজকে এই পত্রিকায় একটি ভালো রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে, আমরা পারিনি, তাহলে ওই পত্রিকার উচিত হবে তার সাংবাদিকদের ওইভাবে সুযোগ দেওয়া যাতে তারাও একটি ভালো রিপোর্ট করতে পারে। কিন্তু, যারা ভালো করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন, এটা খুবই অরুচিকর। এটা মানুষের কাছে খুব হাস্যকর। আমি জানি না সচেতনভাবে এই প্রশ্ন করা হয়েছিল কি না। যদি করা হয়ে থাকে, তাহলে এটা খুবই দুঃখজনক হবে।’

প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে একজন সাংবাদিকের কাজই সাংবাদিক করেছেন বলে মনে করেন শ্যামল দত্ত। তিনি বলেন, ‘আমি এর মধ্যে নেতিবাচক কিছু দেখি না। সাংবাদিকের কাজই তো হচ্ছে স্কুপ বের করা। সেই হিসেবে তারা সেটা করেছেন। এর মধ্যে অন্যায় কী আছে? সরকারের কাজ হচ্ছে, সেটা গোপন রাখা। সেটা তারা পারেনি। পৃথিবীতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে রিপোর্ট বের করে নেওয়া সোর্সের মাধ্যমে, এটা তো আমাদের একটা রীতিসম্মত কাজ। এটা আমি খারাপভাবে দেখছি না। এটা সাংবাদিকতারই অংশ। পৃথিবীতে উল্লেখযোগ্য রিপোর্ট যেগুলো হয়েছে, সবগুলোই এভাবে স্কুপ হিসেবে প্রকাশ হয়েছে।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন, সেটা সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে— আমাদের কাজই তো এই রিপোর্ট খুঁজে বের করা। যারা এটা খুঁজে বের করতে পেরেছেন, আমি মনে করি তারা সার্থক।’

শ্যামল দত্ত বলেন, ‘এ বিষয়ে ব্যবস্থার নেওয়ার কথা যে বা যারা বলেছেন, কেন ব্যবস্থা নেবে? এটা কি নিষিদ্ধ কোনোকিছু ছিল যেটা প্রকাশ করা যাবে না? এটা তো নিষিদ্ধ কোনো ডকুমেন্ট না। আমরা পুরো বিষয়টি দেখব সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে। আমরা বিষয়টি প্রকাশ করেছি। যেটা সরকার মনে করেছিল এখন প্রকাশ করবে না। কিন্তু, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে তো অনেক লোক জড়িত। সুতরাং এটা কি আসলে গোপন রাখা যায়? কোন গণমাধ্যমকর্মী প্রশ্ন তুলেছেন, তা আমি জানি না। কিন্তু, যদি এসব প্রশ্ন তোলা হয়, তাহলে তো কেউ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে পারবে না। গোপন তথ্য, নথি— এগুলোর ভিত্তিতেই তো আমরা রিপোর্ট করি। পৃথিবীর কোন সাংবাদিকতা সাধারণ নিয়ম মেনে হয়েছে? যে আমাদেরকে নিউজ দেয়, সেই সোর্স কখনই কি আমরা ডিসক্লোজ করি? এই প্রোটেকশন তো আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে।’

‘মূল কথা আমরা কোন কারণে করেছি? আমরা কি এমন কোনো কারণে করেছি যেখানে সমাজের বা ব্যক্তির স্বার্থ হানি হয়েছে? এটা তো গণমানুষের স্বার্থে করা হয়েছে যে ওই প্রতিবেদনে কী আছে তা তুলে ধরা’, যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

4h ago