মিয়ানমারে সামরিক অর্থায়ন করছে যেসব দেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান

আন্তর্জাতিক ব্যবসা কীভাবে মিয়ানমারের সামরিক অর্থায়নের সঙ্গে যুক্ত তা নিয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এর মধ্যে কিছু ইউনিট আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
ছবি: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন থেকে নেওয়া।

আন্তর্জাতিক ব্যবসা কীভাবে মিয়ানমারের সামরিক অর্থায়নের সঙ্গে যুক্ত তা নিয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এর মধ্যে কিছু ইউনিট আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার সংস্থাটির ওয়েব সাইটে ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

অফিসিয়ালি ফাঁস হওয়া নথি বিশ্লেষণ করে তদন্ত প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। মিয়ানমারের সামরিক সংস্থাগুলো কীভাবে মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিংস লিমিটেডের (এমইএইচএল) শেয়ার থেকে বিপুল রাজস্ব অর্জন করেছ তা বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। এমইএইচএলের বেশ কিছু স্থানীয় ও বিদেশী ব্যবসায়ের সঙ্গে অংশীদারিত্ব আছে। এর মধ্যে জাপানের মাল্টিন্যাশনাল বিয়ার কিরিন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্টিল জায়ান্ট পোস্কোও আছে।

এমইএইচএলের শেয়ারহোল্ডার রেকর্ডে দেখা যায়, দেশটির সামরিক ইউনিটগুলো এমইএইচএলের প্রায় এক তৃতীয়াংশ শেয়ারের মালিক। এমইএইচএলের সঙ্গে ওয়েস্টার্ন কমান্ডের যোগাযোগ আছে বলেও ওই রেকর্ডে দেখা গেছে। ওয়েস্টার্ন কমান্ড সংগঠনটি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীসহ অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন চালাতে রাখাইন রাজ্যে অভিযান পরিচালনা করে। ১৯৯০ সালে এমইএইচএল প্রতিষ্ঠার পর থেকে শেয়ারহোল্ডাররা যে পরিমাণ বার্ষিক লভ্যাংশ পেয়েছে তার তথ্যও ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ব্যবসা, নিরাপত্তা ও মানবাধিকার বিভাগের প্রধান মার্ক ডুমেট বলেছেন, ‘এমইএইচএলের বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য থেকে কীভাবে মিয়ানমারের সামরিক খাত উপকৃত হয়েছে তার নতুন প্রমাণ এই দলিলগুলো। একইসঙ্গে এমইএইচএলের সঙ্গে সামরিক বিভাগ সংযুক্ত আছে তা এখানে পরিষ্কার। এটি এমইএইচএলের অজান্তে মানবাধিকার লঙ্ঘনে অর্থায়নের ঘটনা নয়... এর পুরো বোর্ড উচ্চস্তরের সামরিক কর্মকর্তা নিয়ে গঠিত।’

‘মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত কয়েকজন এমইএইচএলের ব্যবসায়িক কার্যক্রম থেকে উপকৃত হয়েছেন। যেমন- মিয়ানমারের সামরিক প্রধান মিন অং হ্লাইং ২০১১ সালে এমইএইচএলের পাঁচ হাজার হাজার শেয়ারের মালিক ছিলেন। এই ধরনের প্রমাণের মুখে, বর্তমানে এমইএইচএলের সঙ্গে জড়িত অংশীদারদের দায়বদ্ধতা থেকে ব্যবসায়িক সম্পর্ক অবশ্যই শেষ করতে হবে,’ যোগ করেন তিনি।

বৈশ্বিক ব্যবসায়িক যোগাযোগ

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গবেষণায় দেখা যায়, এমইএইচএলের ব্যবসায়িক অংশীদার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ আছে। এমইএইচএল মিয়ানমারে যৌথ উদ্যোগ বা লাভ-ভাগাভাগির চুক্তি প্রতিষ্ঠায় এই ব্যবসায়িক অংশীদারদের সহযোগিতায় কাজ করে। যখন এগুলো থেকে লাভ হয়, তারা এমইএইচএলকে শেয়ারহোল্ডার হিসেবে সরবরাহ করে। পরে এমইএইচএল তার নিজস্ব শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ বিতরণ করে।

মিয়ানমারে এমইএইচএলের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে এমন আটটি কোম্পানিকে চিঠি লিখেছিল অ্যামনেস্টি। এগুলো হলো- মিয়ানমারের একটি লজিস্টিক কোম্পানি এভার ফ্লো রিভার গ্রুপ পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড (ইএফআর), মিয়ানমারের জেড এবং রুবি খনির সঙ্গে জড়িত কানাবাজা গ্রুপ (কেবিজেড), জাপানি পানীয় সংস্থা কিরিন হোল্ডিংস, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রোপারটি ডেভলপর আইএনএনও গ্রুপ, দক্ষিণ কোরিয়ার পোশাক তৈরি ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যান-প্যাসিফিক, দক্ষিণ কোরিয়ার স্টিল প্রস্তুতকারক কোম্পানি পোস্কো, সিঙ্গাপুরের তহবিলে পরিচালিত তামাক প্রতিষ্ঠান আরএমএইচ সিঙ্গাপুর এবং চীনা ধাতব খনি সংস্থা ওয়ানবাও মাইনিং।

অ্যামনেস্টির চিঠির উত্তরে প্যান-প্যাসিফিক জানিয়েছে, অ্যামনেস্টির অনুসন্ধান ও ২০১৯ সালে ইউএন ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন রিপোর্ট প্রকাশের পর এমইএইচএলের সঙ্গে তাদের ব্যবসায়িক অংশীদারিত্বের অবসান হয়। কেবিজেড এবং কিরিন জানিয়েছে, তারা এমইএইচএলের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি পর্যালোচনা করছে। অন্যরা এ ধরনের প্রতিশ্রুতি বা সাড়া দেয়নি।

এমইএইচএলের সঙ্গে যুক্ত এসব কোম্পানির সব অংশীদার মিয়ানমারের মধ্যে ব্যবসা করে। তবে, কয়েকটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে। এর মধ্যে কিরিন হলো বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম বিয়ার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের পানীয় কিরিন, সান মিগুয়েল, লায়ন এবং ফ্যাট টায়ার সারা বিশ্বের বার এবং দোকানে বিক্রি হয়। আর পোস্কো হলো বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ইস্পাত প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। তারা মোটরগাড়ি, নির্মাণখাত এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য একাধিক ইস্পাত পণ্য উত্পাদন করে।

গোপনীয় সম্পর্কের উপর আলোকপাত

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এমন দুটি নথি দেখেছে যেখানে এমইএইচএল কীভাবে সামরিক বাহিনীকে অর্থ প্রদান তার নতুন বিবরণী প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো- ২০২০ সালের জানুয়ারিতে এমইএইচএল কর্তৃক মিয়ানমারের ডিরকটরেট অফ ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড কোম্পানি অ্যাডমিনিসট্রেশনের (ডিআইসিএ) কাছে পাঠানো নথি। এতে বলা হয়েছে, এমইএইচএল ৩৮১৬৩৬ স্বতন্ত্র শেয়ারহোল্ডারের মালিকানাধীন। যাদের সবাই চাকরিজীবী বা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মী। এছাড়া, ১৮০৩ ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ অংশীদার। যেগুলো ‘আঞ্চলিক কমান্ড, ব্যাটালিয়ন, সেনাবাহিনী, প্রবীণ যোদ্ধা সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত।

দ্বিতীয় নথিটি ২০১০-১১ অর্থবছরে এমইএইচএল শেয়ারহোল্ডারের গোপন প্রতিবেদনের অনুলিপি। এতে এমইএইচএলের শেয়ারহোল্ডারদের পরিচয় সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহের পাশাপাশি এটিতে ১৯৯০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে শেয়ারহোল্ডারদের প্রাপ্ত বার্ষিক লভ্যাংশ প্রদানের তথ্য উল্লেখ আছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে শেয়ারহোল্ডার প্রতিবেদনটি জাস্টিস ফর মিয়ানমার গ্রুপের মাধ্যমে শেয়ার করা হয়েছে। এই গ্রুপটি মিয়ানমারের জনগণের ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতার প্রচারণা চালাচ্ছে। এই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু ওই গ্রুপের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। গত ১ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের পরিবহন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এর অ্যাক্সেস বন্ধ করে দিয়েছে। ওই মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্রের মতে, ওয়েবসাইটটি ‘ফেক নিউজ’ ছড়িয়েছে।

গত ২০ বছরে শেয়ারহোল্ডারদের মোট লভ্যাংশ প্রদানের পরিমাণ ১০৭ বিলিয়নেরও বেশি মিয়ানমারি কিয়েট। যা সরকারি বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ৯৫ বিলিয়ন কিয়েটা বা ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সামরিক ইউনিটগুলোতে স্থানান্তরিত করা হয়।

দুটি নথিতেই নিশ্চিত হওয়া গেছে, এমইএইচএলের শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে সামরিক ইউনিট এবং উচ্চপর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তা অন্তর্ভুক্ত আছেন। যারা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।

উদাহরণস্বরূপ, ২০১০-১১ অর্থবছরের প্রতিবেদনে ৯৫টি পৃথক মিলিটারি ইউনিটকে শেয়ারহোল্ডার হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যা পশ্চিম কমান্ডের অন্তর্ভুক্ত এবং তারা রাখাইন রাজ্যে আঞ্চলিক অভিযান তদারকি করে। তারা একসঙ্গে ৪ দশমিক ৩ মিলিয়নের বেশি শেয়ারের মালিক এবং তাদের ২০১০-১১ অর্থবছরে ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন কিয়েটের বেশি (২০৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বেশি অর্থ প্রদান করেছে। ২০২০ সালে ডিআইসিএকে দেওয়া নথিতেও ওয়েস্টার্ন কমান্ডকে শেয়ারহোল্ডার হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

৩৩তম এবং ৯৯তম হালকা পদাতিক বিভাগের ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরগুলোকেও শেয়ারহোল্ডার হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই বিভাগগুলোকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং কাচিন ও উত্তর শান রাজ্যে যুদ্ধাপরাধে জড়িতে থাকার দায়ে তালিকাভুক্ত করেছে।

ডিআইসিএ’র প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধে জড়িত সিনিয়র সেনা কমান্ডারদের নামও আছে। সেনা প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লেইং এর তালিকাভুক্ত শেয়ারহোল্ডার নম্বর ৯২৫২। ২০১০-১১ সালে মিন অং হ্লাইংয়ের পাঁচ হাজার শেয়ারের মালিকানা ছিল এবং লভ্যাংশ হিসেবে ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন কিয়েট (দুই লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার) পেয়েছিলেন। ২০১৭ সালে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংস অভিযানের তদারকিকারী মিন অং হ্লেয়িং এর বিরুদ্ধে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধের তদন্ত ও বিচারের আহ্বান জানায়।

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

4h ago