দিনাজপুরে ছয় বছরে ২ ইউএনও’র ওপর হামলা
এলাকার অস্থিতিশীল পরিবেশ, স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে বিরোধ এবং গত ছয় বছরে দুই ইউএনও’র ওপর নৃশংস হামলায় দিনাজপুরে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
প্রথম হামলার শিকার হন নবাবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে। দ্বিতীয়টি হলো গত ৩ সেপ্টেম্বর ঘোড়াঘাটের ইউএনও’র উপর।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ইউএনওরা যখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের অন্যায় কাজ রোধ করার চেষ্টা করেন বা আর্থিক কেলেঙ্কারিতে সম্পৃক্ত হতে দ্বিমত করেন তখন তাদের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়।
ঘোড়াঘাটের ঘটনাটির পর বেশ কয়েকজন ইউএনও এবং অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা বলেছিলেন যে, তারা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত চাপের মুখোমুখি হন। এতে তাদের প্রশাসনিক কাজে বাধা সৃষ্টি করে।
তারা আরও জানান, উপজেলার ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের একাংশ টেন্ডারবাজি, জমি দখল, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, মাদকের চোরাকারবার ও সরকারি জমি বাজারের জন্য ইজারা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইউএনও বলেন, ‘চাপের মধ্যে আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমরা যদি তাদের (আওয়ামী লীগ নেতাদের) দাবি না মানি, তাহলে তারা আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন এবং বিভিন্ন হুমকি দেন।’
জেলার ১৩ জন ইউএনও’র মধ্যে অন্তত পাঁচ জন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে জেলার পরিবেশ নিয়ে একই মতামত জানিয়েছেন।
সম্প্রতি একজন ইউএনও কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার তিন মাসের মধ্যে তাকে আবারও বদলির সিদ্ধান্ত হয়। পরে তার বদলির আদেশ বাতিল করা হয়।
যোগাযোগ করা হলে সেই ইউএনও গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। তবে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করায় তাকে উপজেলা থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন দুর্বৃত্তরা।
২০১৪ সালে ইউএনও’র ওপর হামলা প্রসঙ্গে সূত্র জানায়, নবাবগঞ্জের তৎকালীন ইউএনও সৈয়দ ফরহাত হোসেন সঙ্গে ৩৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নাইট গার্ড নিয়োগের বিষয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরোধ হয়। তিনি কঠোরভাবে সুষ্ঠ নিয়োগ নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। তাতে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা অসন্তুষ্ট হন।
২০১৪ সালের ১ অক্টোবর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী তার বিরুদ্ধে মিছিল বের করে এবং ইউএনও অফিসে হামলা চালায়।
তাদের হাত থেকে বাঁচতে ওয়াশরুমে লুকানোর চেষ্টা করেন ইউএনও। কিন্তু দলীয় নেতাকর্মীরা তাকে টেনে বের করে নির্দয়ভাবে মারধর করে।
ওই ঘটনায় ২৯ জনের নামে এবং অজ্ঞাতনামা ৬০ থেকে ৭০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। আসামিদের বেশিরভাগই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। মামলাটি এখনো বিচারাধীন। ২০১৫ সালের শেষের দিকে পুলিশ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয়।
তাদের গ্রেপ্তারের কয়েকদিন পর প্রায় সবাই জামিনে মুক্তি পেয়ে যান বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে।
গত ৩ সেপ্টেম্বর ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সের সরকারি বাসভবন দুর্বৃত্তদের হামলায় গুরুতর আহত হন।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ঘটনায় যুবলীগ নেতা আসাদুল হক এবং রং মিস্ত্রী নবীরুল ইসলাম ও সন্তু দাসকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের প্রত্যেককে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, আরও ২০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়।
যোগাযোগ করা হলে রংপুর রেঞ্জ পুলিশের উপমহাপরিদর্শক দেবদাস ভট্টাচার্য্য জানান, তারা হামলাকারীদের খুঁজে বের করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন।
দিনাজপুর-৬ (নবাবগঞ্জ ও ঘোড়াঘাট উপজেলা) সংসদীয় আসনের অন্তর্ভুক্ত। আওয়ামী লীগের শিবলী সাদিক এই আসনের সংসদ সদস্য। বারবার চেষ্টা করেও এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইমাম চৌধুরী জানান, যেহেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই সংসদে এ বিষয়ে কথা বলেছেন, তাই তার আর কিছুই বলার নেই।
এই হামলায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা থাকলে তাদের অবশ্যই গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে এবং শাস্তির আওতায় আনতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা দলের ভাবমূর্তির বিষয়।’
বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে দলীয় নেতাকর্মী ও ইউএনওদের মধ্যে কোন্দল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশের অভিযোগপত্রে দলের কোনো সদস্যের নাম এলে তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হবে। সম্প্রতি ১৫ জনের বেশি সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
Comments