পদ্মার ভাঙনে হারিয়ে যাচ্ছে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর
পদ্মার করাল গ্রাসে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলা। ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে নয়টির অধিকাংশ এলাকাই চলে গেছে নদীগর্ভে। অব্যাহত ভাঙনে বসতবাড়ি, ফসলিজমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন লক্ষাধিক পরিবার। ভাঙন ঠেকাতে প্রতিবছরই কোটি টাকা খরচ করে জিও ব্যাগ ফেলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু তাতে কোন কাজে আসছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। ভাঙনের হাত থেকে বাঁচতে নদীপাড়ে স্থায়ী বাঁধের দাবি তাদের।
অবস্থানগত দিক থেকে হরিরামপুর উপজেলার পূর্বে ঢাকা জেলার দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলা, দক্ষিণে ফরিদপুর জেলা, উত্তরে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা এবং পশ্চিমে শিবালয় উপজেলা।
পদ্মা, যমুনা ও ইছামতি নদীবেষ্টিত এই উপজেলার চারটি ইউনিয়ন-আজিমনগর, লেছড়াগঞ্জ, সুতালড়ি ও কাঞ্চনপুর এখন শুধুই চর। অবশিষ্ট ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে -গোপীনাথপুর, রামকৃষ্ণপুর, বয়রা, হারুকান্দি ও ধুলসুরা ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকা নদীতে ভেঙ্গে গেছে।
গোপীনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস বলেন, `আমার ইউনিয়নের বাহাদুরপুর বাজার ও বড় বাহাদুরপুর গ্রামের কোন অস্তিত্ব নেই, নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ছোটবাহাদুরপুর গ্রামের অর্ধেকও নদীতে গেছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে ভাটিপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলিজমি, বসতবাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনা। একটি স্থায়ী বাঁধ না হলে গোপীনাথপুর ইউনিয়ন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।’
ইউনিয়নের ডেগির চর গ্রামের শরিফা বেগম বলেন, ‘ভাঙ্গা ফিরানোর জন্য অনেক কষ্ট করছি। বস্তা দিয়া, খোয়া দিয়া বেড়া দিছিলাম। কিন্তু সব ভাইঙ্গা নিছে। আমাগো এই জায়গা দিয়া রাস্তা আছিলো, সেই রাস্তাও ভাইঙ্গা গেছে।’
ষাটোর্ধ্ব খলিল মোল্লা বলেন, ‘আমরা এ জায়গা থিকা ওই যায়গা যাই, ভাইঙ্গা যায়। বাহাদুরপুর গ্রাম আছিলো। হেই গ্রাম ভাইঙ্গা গোপীনাথপুর আইসা ভাঙতাছে। রাস্তাঘাটও ভাঙতাছে। এহন যে বাড়িতে আমরা আছি, সেই বাড়িও সিকিবাড়ি ভাইঙ্গা নইয়া গেছে।’
কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আইজক্যা দুইটা বছর ধইরা আমরা অশান্তিতে আছি। এই গোপীনাথপুর ইউনিয়নডা ভাইঙ্গা-চুইরা শ্যাষ হইয়া গেছে। অনেক বাড়ি ঘর, রাস্তাঘাট ভাইঙ্গা গেছে। আমার বাড়ি ৪ বার ভাঙ্গা দিছে। এখন পদ্মার পাড়ে পইরা রইছি। আমরা কি করুম, কই যামু।’
হরিরামপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান সাইদুর রহমান বলেন, ‘হরিরামপুর উপজেলায় ১৪টি ইউনিয়ন ছিল। একটি ইউনিয়ন আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকি ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে নয়টির অধিকাংশ এলাকাই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। স্থায়ী বাঁধ ছাড়া ভাঙন ঠেকানো যাবে না। আমরা স্থায়ী বাঁধ চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপজেলা কমপ্লেক্সের অদূরে নদীতে একটি চর জেগে ওঠায় নদীর স্রোতের গতি এখন নদীপাড়ের দিকে। এ কারণে বয়রা, হারুকান্দি, ধুলসুরা ব্যাপকভাবে ভাঙছে। চরটি অপসারণ না করলে উপজেলা পরিষদ, ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়, মডেল স্কুল, পাটগ্রাম সরকারী স্কুল, থানা কমপ্লেক্স ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভেঙ্গে যাবে।’
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাইন উদ্দিন বলেন, ‘৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৫টি প্যাকেজে ৩৪টি স্থানে জিও ব্যাগ ফেলে তাৎক্ষণিকভাবে স্থানগুলো রক্ষা করা হয়েছে। পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে আবার বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। পদ্মার মাঝে যে চরটি জেগে উঠেছে তার প্রভাবেও নদী ভাঙছে। চরটা অপসারণ করে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা গেলে ভাঙনরোধ করা সম্ভব হবে। সেখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনাও সরকারের আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বন্যার পানি যেহেতু নামতে শুরু করেছে, আমরা আমাদের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী চর এলাকা পরিদর্শন করার পর চরটা কাটার উদ্যোগ নেব। আমি ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলেছি। নিয়মতান্ত্রিক ভাবেই চরটা অপসারণ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
Comments